ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইলতুতমিশ, যার হাত ধরে সার্বভৌম সালতানাতের প্রতিষ্ঠা-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২৩ জুন ২০২৩, ১১:২৩ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম

আবুল ফজল আরাম শাহকে আইবেকের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু খলিক আহমদ নেজামী দেখান, তিনি আইবেকের আত্মীয় ছিলেন না। বস্তুত আরাম শাহকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা হয়েছিল সময় মতো ঘটনাস্থলে আইবেকের অন্য কোনো নিকটজন না থাকার কারণে। আরাম শাহ অল্প সময়ের মধ্যেই তার অদক্ষতা প্রমাণ করলেন। ফলে অভিজাতরা রাষ্ট্ররক্ষার জন্য নতুন শাসকের তালাশ করছিলেন। তারা কুতুবউদ্দিনের জামাতা এবং বাদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুতমিশকে ক্ষমতা গ্রহণের আহবান জানালেন। ইলতুতমিশ এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দিল্লীর কাছে এক যুদ্ধে আরাম শাহকে পরাস্ত করে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করলেন।
একদল আমিরের সহায়তায় ক্ষমতা লাভ করলেও ইলতুতমিশের সিংহাসন ছিলো কাঁটায় পরিপূর্ণ। আভ্যন্তরীণ সমস্যা যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো বহিরাগত জটিলতার চোখ রাঙানি। গজনীর শাসক তাজুদ্দিন ইলদুজ নিজেকে ঘুরির উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়াসী ছিলেন। ভারতীয় যেসব এলাকা জয় করেছিলেন ঘুরি, তিনি সে সব স্থানের কর্তৃত্ব চান। মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচা নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করলেন এবং গোটা পাঞ্জাব দখলের অভিযান শুরু করলেন। বাংলার শাসক আলী মর্দান বাংলায় স্বাধীন শাসন শুরু করলেন। গোয়ালিয়র, রণথম্ভোরসহ কয়েকটি রাজপুত রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলো এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করলো। ইলতুতমিশকে হয় এদের দাবি মেনে নিতে হতো, না হয় তাদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হতো।

পরিস্থিতির ভয়াবহতার মুখে দৃশ্যত কোনো শক্তিই ইলতুতমিশকে মোকাবেলার পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছিলো না। কিন্তু বিদ্রোহগুলোর মোকাবেলা না হলে স্বাধীন রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা এই দ্রোহের স্রোত সামলাতে দরকার ছিলো ধৈর্য, বিচক্ষণতা, কূটনীতি এবং সামরিক দক্ষতার সুষম সমন্বয়। ইলতুতমিশ কঠিনেরে ভালোবাসিলেন। কিন্তু তার জন্য গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করলো দিল্লীর আশপাশের কিছু অভিজাতের আনুগত্যহীনতা। তুর্কি এই প্রভাবশালীরা তার অধীনতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এদের নেতা ছিলেন মুহজি ও কুতবি আমিরগণ। প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে তাদের প্রভাব ছিলো শক্ত। ফলে ক্ষমতাসীন হবার পরপরই দিল্লীর উপকণ্ঠে জুধ নামক স্থানে বিক্ষুদ্ধ মুহজি ও কুতবি আমীরদের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। তুমুল সংঘর্ষে তাদেরকে পরাজিত করে দিল্লী ও পার্শ্ববর্তী অযোধ্যা, বেনারস, বদায়ুন, সিউয়ালিক প্রভৃতি অঞ্চলের উপর তিনি নিজের আধিপত্য সংহত করেন। অপরদিকে ভারতের উত্তর সীমান্তে প্লাবনের মতো এগিয়ে আসছিলো চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা। ধ্বংস ও গণহত্যার কাহিনী বিস্তার করে স্বয়ং চেঙ্গিস খান নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের। সঙ্কটের এই সর্বাত্মক ঝড়ে ইলতুতমিশ ভেসে যাবেন, এমনই ধারণা ছিলো অনেকের। কিন্তু তিনি রুখে দাঁড়ালেন সবলে। প্রতিটি সঙ্কটের মোকাবেলা করলেন দক্ষ হাতে। দিল্লীর সালতানাতের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহগুলোকে দমন করতে তার দশ বছর লেগে যায়, ১২১০ থেকে ১২২০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ধারাবাহিক প্রয়াসে বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নির্বিঘœ হয়। এতে তিনি সামরিক শক্তিপ্রদর্শনে যেমন কসুর করেননি, তেমনি যুদ্ধ এড়াবার প্রয়াসেও কমতি ছিলো না তার।

১২১৪ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিজমের শাহ আলাউদ্দিন মুহম্মদের অভিযানে বিতাড়িত হয়ে গজনীর শাসক ইলদুজ ভারতে প্রবেশ করেন। পাঞ্জাব থেকে থানেশ্বর পর্যন্ত এক বিরাট এলাকার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুহম্মদ ঘুরির প্রকৃত উত্তরাধিকারী বলে নিজেকে দাবি করতেন তিনি। ইলতুতমিশকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। ইলতুতমিশ মনে করিয়ে দেন, বংশগত অধিকারের দিন চলে গেছে। এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নতুন সাম্রাজ্য, নতুন নিয়ম। পত্রযোগে এ আলাপের পরে যুদ্ধ ছিলো অবধারিত। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সন্নিকটে তরাইনের যুদ্ধে সুলতান ইলদুজকে পরাজিত ও বন্দী করেন। বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় ইলদুজের। এ বিজয়ের ফলে ইলতুতমিশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ময়দান থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেন। গজনী প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলেন তিনি। গজনীর তরফ থেকে তার কাছে অধীনতা দাবি করবে, এমন কেউ আর রইলো না।

নাসিরুদ্দীন কুবাচার হুমকি মোকাবিলায় ইলতুতমিশ অগ্রসর হলেন অতঃপর। চেনাব নদীর তীরে মনসুরায় উভয়ের যুদ্ধ হলো ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে। কুবাচা পরাজিত হয়ে পাঞ্জাবে পালালেন। এরপর লাহোর দিল্লীর অধীনে এলেও সিন্ধু অঞ্চলে কুবাচার শাসন টিকে রইলো। ইলতুতমিশের মনোযোগ তখন চেঙ্গিস খানের সম্ভাব্য অভিযানের দিকে। ১২২৭ সালে কুবাচা আবারো বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন ইলতুতমিশ। ১২২৭ সালের শেষ দিকে সিন্ধুর ভাক্কারে উভয়ের যুদ্ধ হয়। এতে ভীষণভাবে পরাজিত হয়ে পলায়নের পথে সম্ভবত সিন্ধুনদে ডুবে প্রাণ হারান কুবাচা। (চলবে)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
তারেক রহমানের রাষ্ট্র চিন্তা
মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) দ্বীন ও মিল্লাতের নবায়ন-৬
আরও

আরও পড়ুন

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম

দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম

সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত

সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত