ইলতুতমিশ, যার হাত ধরে সার্বভৌম সালতানাতের প্রতিষ্ঠা-৩
০৭ জুলাই ২০২৩, ১১:১৯ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

চেঙ্গিস খানের হুমকির মোকাবেলায় ইলতুতমিশকে বিশেষভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় ১২২১ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি। চেঙ্গিস খানের আক্রমণে জালালউদ্দিন খোয়ারিজমি শাহ পরাজিত হন। তিনি চলে আসেন পাঞ্জাবে। এখানে যুদ্ধদক্ষ খোক্কর উপজাতি তাকে সহায়তা করে। তিনি দখল করেন উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব ও মুলতান। সিন্ধুতে তিনি কুবাচাকে পর্যুদস্ত করেন। জালালউদ্দিনকে আক্রমণের জন্য চেঙ্গিস খান চলে এলেন পিছে পিছে। সিন্ধু নদীর তীরে তিনি অবস্থান গ্রহণ করলেন। জালালউদ্দিন ইলতুতমিশের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। আর চেঙ্গিস খান তাকে অনুরোধ করলেন জালালকে সমর্থন না করার জন্য। ইলতুতমিশ চেঙ্গিস খানের আক্রমণকে এড়াতে চাইছিলেন। জালালউদ্দিনকে তিনি জানালেন, দিল্লির আবহাওয়া ভালো নয়। এই আবহাওয়া জালালউদ্দিনকে কষ্ট দেবে। এ ভাষা ছিলো জালালের প্রতি সহমর্মিতা ও কল্যাণ কামনায় পূর্ণ, যা মহান এই যোদ্ধার প্রতি সাধারণ মুসলিমদের অনুভূতিকে বিরক্ত করেনি। খোওয়ারিজম শাহ অবশেষে সিন্ধু হয়ে ইরান চলে যান। ভারত অভিমুখে চেঙ্গিসের অগ্রযাত্রা এরপর থেমে যায়। চেঙ্গিসের আক্রমণ মানেই হতো ভারতের অগনিত নগর-জনপদের বিনাশ। ইলতুতমিশ তার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছিলেন সর্বান্তকরণে। উভয়ের সাথে তার আচরণ ছিলো দূরদর্শী ও সম্পূর্ণ কূটনৈতিক।
তিনি সাম্রাজ্যকে সুগঠিত করতে বিশেষভাবে মগ্ন থাকেন ১২২৮ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এর পর মনোযোগ দেন বিদ্রোহী বাংলার প্রতি। ইতোপূর্বে আলী মর্দান এখানে স্বাধীন প্রশাসন গঠন করেছিলেন। ১২১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হলে হুসামউদ্দিন ইয়াজ খিলজি এই স্বাধীনতাকে আরো তীব্রভাবে কামনা করলেন। নিজ নামে তিনি মুদ্রা চালু করলেন। গিয়াসউদ্দিন উপাধি ধারণ করলেন এবং খুতবায় নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করলেন। জাজনগর (উড়িষ্যা), ত্রিহুত, মধ্যবঙ্গ ও কামরূপ হতে কর প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি লাভ করলেন। বাংলার স্বাধীনতা ও আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকে রুখে দিতে ইলতুতমিশ অভিযান প্রেরণ করেন ১২২৫ সালে। ইয়াজ খিলজি অভিযানের মুখে দিল্লীর বশ্যতা মেনে নেন। কিন্তু ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে আবারো ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। বিহার দখল করেন এবং বহিষ্কার করেন সুলতানের প্রতিনিধিকে। এবার ইলতুতমিশের পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বাংলায় অভিযান চালান। হত্যা করেন ইয়াজ খিলজিকে এবং দিল্লীর কর্তৃত্ব নিশ্চিত করেন। ১২২৬ থেকে ১২২৯ খিস্টাব্দে বাংলা শাসন করেন নাসিরউদ্দিন। তার মৃত্যুর পরে আবারো বিদ্রোহ করে বাংলা। আবারো অভিযান চালান সুলতান। আবারো প্রতিষ্ঠিত হয় দিল্লীর আধিপত্য।
এদিকে রাজপুত রাজ্যগুলোতে জ্বলছিলো বিদ্রোহের ধিকিধিকি আগুন। চান্দেল্লরা কালিঞ্জর ও অজয়গড়; প্রতিহাররা গোয়ালিয়র, নারোর, ঝান্সী; রণথম্ভোরের চৌহানরা যোধপুর ও সন্নিহিত অঞ্চল; জালোরের চৌহানরা নাদোল, মন্দোর, ভারমার, সাঞ্চোর, ঘেরা, রাসসিন ইত্যাদি অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলো, ভাট্টিরা এবং উত্তর-আলোয়ারও পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। দিল্লীকেন্দ্রিক বৃহত্তর যে সাম্রাজ্য ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে, তার দৃঢ়ভিত্তির জন্য উত্তর ভারতের এই বিচ্ছিন্নতার মোকাবেলা জরুরি ছিলো। সুলতান রাজপুত রাজ্যগুলোর প্রতি মনোযোগী হলেন। উত্তর ভারতে অভিযান পরিচালনা করলেন এবং একে একে নির্বাপিত করলেন মা-ু, বেয়ানা, আজমির ইত্যাদি এলাকার বিদ্রোহ। ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর এবং পরের বছর সিওয়ালিক পর্বতে অবস্থিত মান্দাওয়ার দখল করেন। এক বছর অবরোধের পর ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোয়ালিয়র অধিকার করেন। ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে মালবের রাজা মজলদেবের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে সুলতান ভিলসা ও উজ্জয়িনী দখল করেন। সুলতানের শেষ অভিযান ছিল সিন্ধু-সাগর দোয়াব অঞ্চলের পার্বত্য রাজ্য বানিয়ানের বিরুদ্ধে। এই অভিযানের মাঝপথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগ ছিলো প্রচ-। ফলে অভিযান অসমাপ্ত রেখে দিল্লি ফিরে আসেন। রোগের তীব্রতা বাড়ছিলো ক্রমেই। কোনো ঔষধেই নিরাময় হচ্ছিলো না। অবশেষে ২৫ বছর রাজত্ব করার পর ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল সুলতানের ইন্তেকাল হয়। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে নিজ কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইলতুতমিশ ছিলেন নতুন অধ্যায়ের জনক। তিনি যখন ক্ষমতা লাভ করেন, তখন চারদিকের শিকারী প্রাণীদের রক্তচক্ষুর সামনে আহত হরিণ ছানার মতো কাঁপছিলো নবগঠিত দিল্লী সালতানাত। বস্তুত তখন আইবেকের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ক্রিয়াশীল কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। আরাম শাহের অদক্ষতা ও ভয়াবহ ব্যর্থতা গোটা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছিলো বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতার হাতে। চারধারে বিদ্রোহের কাড়ানাকাড়া ও ভীষণ রাজনৈতিক আবর্ত। ইলতুতমিশ অদম্য মনোবল, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে সকল উপদ্রবের মোকাবেলা করলেন। যুক্তিনিষ্ঠ নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সাহায্যে ভারতের অসংবদ্ধ ঘুর অঞ্চলকে তিনি সুগ্রথিত দিল্লী সালতানাতের অংশে পরিণত করলেন। তার হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হয়ে উঠলো দিল্লী সালতানাত, যা বৈশ্বিক পরিসরেও সম্মান ও বরেণ্যতা লাভ করে। একদিকে অর্জন করে চেঙ্গিস খানের সমীহ, অপরদিকে আব্বাসী সালতানাতের তরফে সম্মান। (চলবে)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড