ঢাকা   রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইলতুতমিশ, যার হাত ধরে সার্বভৌম সালতানাতের প্রতিষ্ঠা-৪

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:২৯ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম

১২২৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহ ইলতুতমিশকে দেন ‘সুলতান-ই-আজম’ (শ্রেষ্ঠ সুলতান) উপাধি, যা ছিলো তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম স্বীকৃতি এবং মুসলিমদের কাছে বৃহত্তর বৈধতার স্মারক, যা শিশু মুসলিম রাষ্ট্রটিকে একটি আইনি মর্যাদা প্রদান করে। অন্যান্য সম্ভাব্য প্রতিদ্ব›দ্বীর পথরোধ করে। এভাবে সকল পথ ধরে সতর্ক সফলতার সাথে বংশভিত্তিক রাজতন্ত্রটিকে প্রতিষ্ঠা দিলেন ইলতুতমিশ। চরম প্রতিক‚লতা উজিয়ে এগিয়ে যাবার গভীর সামরিক ও ক‚টনৈতিক দক্ষতা ছিলো তার। তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রাজ্ঞতা বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু ধর্ম ও বহু ঐতিহ্যের অঞ্চলসমূহকে একই রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের আওতায় ঐক্যবদ্ধ করে। আইবেকের অসমাপ্ত কাজ তার হাতে পায় পূর্ণতা। মধ্যযুগের ভারত মোঙ্গল আক্রমণের ধ্বংসলীলা এড়াতে পেরেছিলো তার দূরদর্শিতায়। সে জন্য ভারতের ইতিহাস তার প্রজ্ঞার কাছে ঋণী।

ডক্টর এএল শ্রীবাস্তব লিখেছেন, ‘ইলতুতমিশ নাগরিক প্রতিষ্ঠানের নির্মাতা ছিলেন না এবং গঠনমূলক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না।’ কিন্তু আমরা একমত নই শ্রীবাস্তবের সাথে। ইলতুতমিশ সালতানাতের প্রাথমিক ভিত্তিকে বিন্যস্ত করেন। কেন্দ্রে স্থাপন করেন বিভিন্ন দফতর। হিসাব সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের বিবরণী রক্ষায় গুরুত্ব দেন। রাজস্ব ব্যবস্থা ও অর্থ পরিদপ্তরের পুনর্গঠন করেন। প্রশাসনের বিকেন্দ্রিকরণ করেন, গোটা সাম্রাজ্যকে ইকতা বা প্রদেশসমূহে বিভাজিত করেন। রাজ্যসমূহে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত হন ইকতাদারগণ। তার প্রশাসন প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে, একে করে স্থিতিশীল। যুদ্ধমুখর পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ঐক্য ও শৃঙ্খলা সুরক্ষা এবং কঠোর নীতিমালার আওতায় তাদের প্রশিক্ষিত ও উজ্জীবিত রাখা তার প্রশাসনিক দক্ষতার বিশিষ্টতা প্রমাণ করে। অর্থনৈতিক পদক্ষেপেও তিনি ছিলেন সাহসী। রৌপ্য ‘টাঙ্কা’ এবং তামার ‘জিতালে’র মতো আরবি মুদ্রার প্রচলন করেন তিনি। একে বলা হতো রুপাইয়াহ। একটি স্টান্ডার্ড মানের রুপাইয়ার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রেন।

তার দরবারে ঘটেছিলো বিজ্ঞ পÐিতদের সমাবেশ। মুহম্মদ জুনাইদি এবং ফখরুল মুলুক ছিলেন বহুবিদ্যাবিশারদ। প্রশাসনিক সংস্কার, সংগঠন ও জনকল্যাণ ব্যবস্থাপনায় তারা ছিলেন সুলতানের উপদেষ্টা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বন-জঙ্গলের প্রয়োজনীয় অপসারণ এবং স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন তিনি। বাজার ও শহরসমূহে সরাইখানা ও হাম্মামখানা নির্মাণ করেন তিনি। চোর-ডাকাতদের আশ্রয়স্থলসমূহ নির্মূল করেন তিনি। স্থাপত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার অবদান ইতিহাসস্বীকৃত। দিল্লীর কুতুব মিনার, আজমীরের আড়াই দিন কা ঝোপড়া’র অসমাপ্ত কাজ তিনি সম্পন্ন করেন। বাদাউনে তার তৈরি বিশাল ঈদগাহ কিংবা দিল্লীতে তৈরি নাসিরিয়া মাদরাসা তার সময়ের শিল্পশৈলীর স্বাক্ষর বহন করতো। তার শাসনামলে দিল্লী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। ভারতে পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চার বিকাশ হয় তার হাত ধরে। মহাপÐিত ও ঐতিহাসিক মিনহাজুস সিরাজ এবং হাসান নিজামীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তার পৃষ্ঠপোষকতায় মহাকাব্য রচনা করেন কবি মুহম্মদ আউফি। কবি রুহানিও ছিলেন তার দরবারের শায়ের। মালিক তাজ উদ্দিন রেজাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাচর্চায় তার সহায়তা ছিলো অকুণ্ঠ। তত্ত¡বাগীশ নুরুদ্দিন ছিলেন তার দরবারের পÐিত।

মহান সুফিদের সাথে সুলতানের ঘনিষ্টতা ছিলো, নিখাদ সত্যনিষ্ঠা, উত্তম চরিত্রের অনুশীলন ও নির্দেশনা এবং সর্বজনীন প্রেম ও কল্যাণ ছিলো যাদের শিক্ষার সার। মিনহাজুস সিরাজ, ইসামী প্রমুখের ভাষ্যে স্পষ্ট, কৈশোরে কিছুদিন তিনি বাগদাদে ছিলেন। সেখানে শায়খ সোহরাওয়ার্দী, আহাদুদ্দীন কিরমানীর মতো মনীষীদের সান্নিধ্য তার সত্তায় সুফি অনুভাবের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়া বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শেখ জালালউদ্দিন তাব্রিজী ও খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর শিক্ষা ও নির্দেশনা তার নৈতিকতাকে পরিচালিত করতো। ন্যায়বিচারের উপর কায়েম ছিলো এ নৈতিকতার বুনিয়াদ। ন্যায় বিচার ছিলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদর্শ। ইলতুতমিশ তার দরবারে ঝুলিয়ে রাখতেন শিকলে বাঁধা ঘণ্টা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ ঘণ্টা বাজিয়ে সরাসরি সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো। ইকতাদারগণকেও একই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হতো।

দানশীলতা ও বদান্য ছিলো তার স্বভাবে যুক্ত। সুফিশিক্ষা একে দেয় আরো প্রসার। ইলতুতমিশ এমনকি কুতুবউদ্দিন আইবেকের চেয়েও অধিক দানশীল ছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘আল্লাহর বান্দাগণের সাহায্যকারী’ (ঃযব যবষঢ়বৎ ড়ভ ঃযব ংবৎাধহঃং ড়ভ এড়ফ) এবং ‘আল্লাহর রাজ্যের রক্ষক’ (ধ ঢ়ৎড়ঃবপঃড়ৎ ড়ভ ঃযব ষধহফং ড়ভ এড়ফ) হিসেবে। দয়া ও সহানুভ‚তির জন্য এবং বিদ্যান ও বৃদ্ধদের প্রতি সহায়তায় তিনি অতুলনীয় ছিলেন, এই স্বাক্ষ্য দিয়েছেন মিনহাজুস সিরাজ।

আপন আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে ভাগ্যবিড়ম্বিত সুদর্শন যুবক আপন মেধা ও চরিত্র মহিমা দিয়ে অচেনা, অনাত্মীয় প্রভুদের জয় করলেন সহজেই। সাধারণ মানের প্রতিভা ও নৈতিকতা দিয়ে এটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। নতুন পরিবেশ ও প্রতিবেশে কোনো ভিত্তিভ‚মি ছাড়াই তাকে পদে পদে প্রমাণ করতে হয়েছে নিজেকে। আশ্রয়হীন সেই যুবক অবশেষে হয়ে উঠলেন দিল্লী সালতানাতের আশ্রয়। সাম্রাজ্যের গণনাতীত মানুষের ন্যায়ের বিধায়ক।

প্রভাবশালী এক বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকে তিনি প্রতিষ্ঠা দিলেন, যা তখনকার রাজনীতি ও প্রশাসনকে এতো গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো, যার ফলে ইলতুতমিশের মৃত্যুর ত্রিশ বছর ধরে সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসার একমাত্র যোগ্য বলে তার সন্তানদেরকেই বিবেচনা করা হতো। তিনি ভারতকে দিয়েছিলেন একটি পরিকল্পিত ও শক্তিমান রাজধানী, বিচ্ছিন্ন রাজ্যসমূহকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার আকাশতলে একটি বৃহত্তর যৌথতা। দিল্লীর পরিচয় ও আবেদনকে হাজির করেছিলেন নতুন যুগের প্রবেশদ্বারে। ইলতুতমিশ সম্পর্কে ডক্টর আরপি ত্রিপাঠি ঠিকই লিখেছেন যে, ‘ভারতে মুসলিম সার্বভৌমত্বের ইতিহাস তাঁর সাথে শুরু হয়েছে।’

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৪
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
আরও

আরও পড়ুন

কুরস্কে ৪০ শতাংশ এলাকার দখল হারিয়েছে ইউক্রেন

কুরস্কে ৪০ শতাংশ এলাকার দখল হারিয়েছে ইউক্রেন

আমরা জমিদার নই,মানুষের পাহারাদার : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমরা জমিদার নই,মানুষের পাহারাদার : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাসের কাছে গুলি, বন্দুকধারী নিহত

জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাসের কাছে গুলি, বন্দুকধারী নিহত

ট্রাম্পের জয়ের পর ইলন মাস্কের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে

ট্রাম্পের জয়ের পর ইলন মাস্কের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে

ভয়াবহ তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য, বহু ফ্লাইট বাতিল

ভয়াবহ তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য, বহু ফ্লাইট বাতিল

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ১২০ ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ১২০ ফিলিস্তিনি

ইভেন্টের  সেরা লড়াইটি উপহার দিলেন আফরা-সানজিদা

ইভেন্টের সেরা লড়াইটি উপহার দিলেন আফরা-সানজিদা

ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান পাহাড়ের পর জয়-জাকিরকে হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান পাহাড়ের পর জয়-জাকিরকে হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা