শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.)-১

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

২১ জুলাই ২০২৩, ১১:৩২ পিএম | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

মানবতার সেবাই সুফীদের মূল শিক্ষা। সুফীরা সর্বদা মানুষকে দীক্ষা ও শিক্ষা দিয়ে আসছেন। ভালবাসা, সহানুভূতি এবং স্নেহ দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়াই তাদের অভ্যাস। তাঁরা আল্লাহর মাখলুকের উদ্বেগ ও সমস্যার সমাধান করতে সদা তৎপর। সুফীরা তাদের আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার কারণে আল্লাহর সৃষ্টির সেরা, যা গোষ্ঠী, ধর্ম এবং বর্ণের বৈষম্য ছাড়াই মানবতার ভালবাসায় চিহ্নিত। মানবতার প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ সেবার কারণেই আল্লাহর এই শ্রেণির মাকবুল বান্দারা শত শত বছর অতিবাহিত হলেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের মুখনিঃসৃত বাণী ও লিখিত গ্রন্থাবলীর শিক্ষাগুলো আজও সত্যসন্ধানীদের জন্য পথনির্দেশ ও জ্ঞানের উৎস। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.) ছিলেন সেসব সুফীর অন্যতম। তিনি রসূল (সা.) ও সাহাবাদের তরিকায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জ্ঞান আহরণে পূর্ণতার আদর্শ। তিনি অল্প বয়সে পবিত্র কুুরআন হিফয সম্পন্ন করেন এবং পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানার্জনের জন্য আরববিশ্ব ভ্রমণ করেন। সুফীরা জ্ঞানের নিরন্তর বিদ্যার্থী এবং প্রত্যেক সুফী তার সময়ের বিশ্বাসযোগ্য ধর্মীয় প-িত। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী শুধু ক্বারী ও হাফিযই ছিলেন না, একজন মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরও ছিলেন।

শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.) ছিলেন উত্তর-পশ্চিম ভারতে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর (১১৭০-১২৬২) অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার, অন্যতম প্রধান সুফী-সাধক এবং বাগদাদের সুপরিচিত সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার একজন প্রচারক। তিনি শায়খ ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর এবং খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির সমসাময়িক ছিলেন। এই তিন মহান সুফী একে অপরের প্রতি গভীর বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.) ছিলেন কুরাইশী, আসাদী, হাশিমি এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর জামাতা হযরত আলী (রা.)-এর বংশধর। শায়খের মহানুভবতা, তাকওয়া, বিশ্বাসের প্রতি তার অটলতা, জ্ঞানের পথে অক্লান্ত অনুসন্ধান, সত্যের সন্ধানে তাঁর অজস্র ঘটনা অলৌকিকতার সাথে অভিন্ন। তাঁর শিক্ষা ও দীক্ষার ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের চরিত্র, মনন ও জীবনধারায় পরিবর্তন সূচিত হয়।

তাঁর পিতামহ, শেখ কামালউদ্দিন আলী শাহ, মক্কা থেকে খাওয়ারেজম এবং তারপর ২০০ হিজরিতে মুলতানের কাছে কোট করোরে চলে যান, যেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতা শায়খ ওয়াজিহউদ্দিন কোট করোরে বসতি স্থাপনকারী মাওলানা হুসামুদ্দিন তিরমিজির কন্যা বিবি ফাতিমাকে বিয়ে করেছিলেন। অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিবি ফাতিমা ছিলেন শায়খ ঈসার কন্যা, যিনি ছিলেন শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর বংশধর এবং শায়খ ওয়াজিহউদ্দীনের সাথে হামা নামক একটি শহরে ভ্রমণ করার সময় তার সাথে বিবাহ হয়। কোট করোরে ফিরে আসার আগে তিনি সেখানে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন। কতিপয় ইতিহাসবিদদের মতে, তাঁর মাকে শায়খ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকরের মাতার বোন বলা হয়। শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া ৫৬৬ হিজরি সনের ২৭ রমযান কোট করোরে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি যৌবনের প্রথম দিকে তাঁর জন্মস্থান মুলতান ত্যাগ করেন এবং ইসলামিক বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য মুসলিম প্রধান ভূখ-ের একটি দীর্ঘ ও বিপদজনক যাত্রা শুরু করেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে শহর থেকে শহরে ভ্রমণ করেন। জানা যায়, তুস, নেশাপুর, বুখারা, সমরকান্দ, দামেস্ক, আলেপ্পো, মক্কা, মদীনা এবং অবশেষে বাগদাদ ভ্রমণ করেন এবং বিশিষ্ট শিক্ষকদের সাথে সময় কাটান। পরবর্তী সময়ে মুলতানে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন একজন আইনজ্ঞ, যিনি বাগদাদে অবস্থানকালে আবু হাফস উমর আল-সোহরাওয়ার্দী (যিনি আবু আল-নাজিব আল-সোহরাওয়ার্দীর ভাইপো ছিলেন) এর শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন। যিনি তাঁকে সোহরাওয়ার্দী তরীকায় দীক্ষিত করেন এবং সোহরাওয়ার্দীয়ার বাণী প্রচারের জন্য স্বদেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.) ধর্মীয় বিচারকদের (কাযী) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই পরিবারের অত্যন্ত ধনী এবং মুসলিম শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। কালক্রমে তিনি পারিবারিক সৌভাগ্যের উত্তরাধিকারী হন। তিনি তাঁর অর্থ-বিত্ত ও সময় ধর্মের কাজে ব্যয় করেন। তিনি মুলতানে একটি বিশাল মাদরাসা নির্মাণ করেন, যেখানে ছাত্র, মুসাফির, আশ্রয়হীন এবং মুসলিম প্রধান ভূখ- থেকে আগত শিক্ষকদের রাখা হয়েছিল। তার খ্যাতি এবং ধর্মপরায়ণতা বহু মানুষকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে। তিনি মাদরাসার শিক্ষকদের তাবলিগের জন্য বহু দূরদেশে প্রেরণ করেন। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া ইসলাম প্রচারের জন্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য অঞ্চলের মতো দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতে শীষ্যদের দল পাঠিয়েছিলেন। ওই সব স্থানে বিপুল সংখ্যক অমুসলিম তাদের মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত হন।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড