শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.)-২

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

২৭ জুলাই ২০২৩, ১১:২৯ পিএম | আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

হজব্রত পালন উপলক্ষে শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রহ.) আরবদেশে গমন করেন এবং মদিনায় পাঁচ বছর অবস্থান করে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস শায়খ কামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইয়ামানীর কাছ থেকে হাদিস অধ্যয়ন করেন এবং সনদপ্রাপ্ত হন। মদিনা থেকে তিনি জেরুজালেমে যান এবং সেখান থেকে বাগদাদ। বাগদাদে থাকাকালীন তিনি হযরত শায়খ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে সমগ্র আধ্যাত্মিক পাঠ্যক্রমটি উপলব্ধি করতে তার মাত্র ১৭ দিন সময় লেগেছিল। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে খেলাফত লাভে ধন্য হন। শায়খের নির্দেশে তিনি মুলতানে ফিরে আসেন। মুলতান ছিল তখনকার শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র এবং অনেক অসামান্য দরবেশের আবাসস্থলও ছিল।

প-িত হিসেবে শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং শায়খ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যদের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র স্থান অর্জন করতে সক্ষম হন। শিগগিরই তিনি মুলতানে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ইরাক ও খুরাসানের বণিকরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি শস্যভা-ার সম্বলিত একটি বিস্তৃত খানকাহ নির্মাণ করেন। সব মত ও সব ধর্মের মানুষ তাঁর খানকায় সমবেত হতেন এবং সমসাময়িক সামাজিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া ও মুলতানের গভর্নর নাসির উদ্দীন কাবাছার মধ্যে বিভেদ থাকলেও দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সঙ্গে ছিল তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। ইলতুতমিশের দিল্লির সিংহাসন লাভের ক্ষেত্রে শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার সমর্থন ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করেন।

শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া (রহ.) শুধু একজন মহান সুফী-সাধক ছিলেন না, তিনি একজন মহান ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকও ছিলেন। তিনি অনুর্বর বনভূমিকে সমৃদ্ধ সবুজ খেতে রূপান্তরিত করার পাশাপাশি সেচের খাল, বাগান এবং কূপ স্থাপনের মাধ্যমে সিন্ধু ও মুলতানের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের অবস্থার উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালান। এসব কর্মকা-ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও শক্তি ব্যয় সত্ত্বেও তিনি তার সুফী কর্তব্য ও নীতির প্রতি অটলভাবে ছিলেন নিবেদিত।

শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। তার বদান্য সর্বজনবিদিত। মুলতানের গভর্নর একদা তার কাছে খাদ্য সহায়তার জন্য আবেদন করেন। কারণ, শহরে শস্যের মজুত অবশিষ্ট ছিল না। শায়খ তার শস্যভা-ার থেকে শস্য দেওয়ার নির্দেশনা দেন এবং শস্যের মাঝখানে রৌপ্য মুদ্রায় ভরা একটি পাত্রও প্রদান করেন, যাতে গভর্নর দুঃখী ও অভাবক্লীষ্ট মানুষের মাঝে তা বিতরণ করতে পারেন। শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া একটি লঙ্গরখানা চালাতেন, যেখানে শত শত দরিদ্র মানুষ, পথিক, দরবেশ এবং অতিথিদের বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হতো।

শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া ধনী জীবনের বিরোধী ছিলেন না। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি আত্মার আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক পরিপূর্ণতার জন্য শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার শিক্ষা ও বাণী এখনো অমর হয়ে আছে।। যেমন, ‘আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য সকল পাপ ত্যাগ করতে হবে’। ‘দুনিয়ার সম্পদ, তা যতই হোক না কেন, সামান্যই। সাপের সঙ্গ সেই ব্যক্তির জন্য বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকর, যে প্রতিষেধক জানে না’। ‘দুনিয়ার সম্পদের ক্ষতি ও লাভ দরবেশদের কাছে কোনো পার্থক্য করে না। তারা সম্পদ চলে যাওয়ায় দুঃখ পান না এবং এর আগমনে তারা খুশিও হন না’। ‘সত্যিকারের ভালোবাসা বোঝায়, কেউ সকালে উঠলে, রাতে কী ঘটেছিল তা মনে রাখে না এবং রাতের কাছাকাছি সময়ে, দিনের কিছুই মনে থাকে না’। ‘যদি আল্লাহর জিকিরের পুনরাবৃত্তির অভাব হয়, তবে একজন ব্যক্তি আল্লাহর প্রেমের গন্ধও পেতে পারে না’। ‘কম খাওয়ার মধ্যে দেহের নিরাপত্তা নিহিত, কম ঘুমানোর মধ্যে আত্মার নিরাপত্তা নিহিত এবং প্রার্থনার মধ্যেই নিহিত ধর্মের নিরাপত্তা’। ‘জাগতিক বস্তুর প্রতি যে কোনও ঝোকপ্রবণতা থেকে হৃদয়কে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা দিতে হবে’। ‘একজন অতীন্দ্রিয় ব্যক্তিকে তার দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য সর্বদা তার স্তরে সর্বোত্তম চেষ্টা করা উচিত; কিন্তু পাশাপাশি, সবসময় আল্লাহর জিকির পুনরাবৃত্তি করা উচিত’।

শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার শিক্ষা দক্ষিণ পাঞ্জাব এবং সিন্ধুজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং হিন্দুধর্মের বিপুল সংখ্যক লোককে আকৃষ্ট করে। তারা অনেকে ধর্মান্তরিত হয়। তার উত্তরসূরিরা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ পাঞ্জাবের ওপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে থাকে, যখন তার আদর্শ ও শিক্ষা আরও পূর্বে উত্তর ভারতের অঞ্চলে, বিশেষ করে গুজরাট এবং বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।

১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া (রহ.) ইন্তেকাল করেন। মুলতানে রয়েছে তাঁর সমাধি সৌধ। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড