ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রাজিয়া সুলতান : উপমহাদেশে প্রথম নারী শাসক-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৬ এএম

মিনহাজুস সিরাজ জানান, সুলতান ইলতুতমিশ ডিক্রি জারি করলেন বটে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো সুলতানের রেখে যাওয়া বিশেষ পরিষদের পক্ষ থেকে। এই পরিষদের নাম ছিল বন্দেগান-ই চেহেলগানি; অর্থাৎ চল্লিশজন নিবেদিত সেবক বা চল্লিশচক্র। তারা ছিলেন মূলত ইলতুতমিশের ক্রিতদাস। সুলতানের অনুগ্রহে তারা হয়ে উঠেন অভিজাত, প্রভাবশালী। ইলতুতমিশের আমলে তারা সেবক ছিলেন বটে। কিন্তু তার মৃত্যুর পরই তারা হয়ে উঠতে চাইলেন সর্বেসর্বা। তারা সুলতানের শেষ ইচ্ছার প্রতি কোনো সম্মান দেখালেন না। নারী হওয়ার কারণে রাজিয়া তাদের দৃষ্টিতে ছিলেন সুলতান হওয়ার অনুপযুক্ত। তারা চাইছিলেন এমন কোনো শাসক, যাকে নিজেদের মতো করে চালানো যাবে। রাজিয়া ছিলেন স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম এক ব্যক্তিত্ববান নারী। তাই তাকে শাসক হিসেবে তারা নিতে পারছিলেন না। তারা বরং ইলতুতমিশের পুত্র (জীবিতদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ), রাজিয়ার সৎ ভাই রুকনুদ্দীন ফিরোজকে সিংহাসনে বসালেন।

তারা দাবি করেন, জীবনের শেষ বছরগুলোতে ইলতুতমিশ নিজের কোনো পুত্রকে উত্তরাধিকারী বানাতে সম্মত হন। রুকনুদ্দিনকে লাহোর থেকে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনেন তিনি। কিন্তু এ দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারেননি তারা। রুকনুদ্দীন ক্ষমতায় বসে তার অদক্ষতার প্রদর্শনী শুরু করেন। শাসনকর্ম ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার মা শাহ তুর্কনের হাতে। তুর্কন ছিলেন এক ষড়যন্ত্রপ্রিয় নারী। হেরেমে তিনি বিরোধীদের গোপনে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ইলতুতমিশের পুত্র কুতুবুদ্দিনকে অন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাকে দেওয়া হয় মৃত্যুদÐ। রাজিয়াকেও রাখা হয় হুমকির মধ্যে। চল্লিশচক্রের প্রভাব দৌরাত্ম্যে পরিণত হয়। অ-তুর্কি প্রভাবশালীরা এতে বিক্ষুব্ধ হন। প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক জুনাইদি ছিলেন মূলত তাজিক। তার পুত্র জিয়াউল মুলক এবং তাজুল মুলক মাহমুদসহ বিভিন্ন তাজিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্ররক্ষার জন্য রাজিয়ার জরুরত আরো তীব্র হয়ে উঠে। বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন শাহ তুর্কন। তাই তিনি রাজিয়াকে হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করেন। এটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল এমন এক সময়ে, যখন রুকনুদ্দীন দিল্লির বাইরে কুহরামের দিকে মার্চ করছিলেন বিদ্রোহ দমনের জন্য।

সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন রাজিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে জনতার শরণাপন্ন হন। তিনি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন জনতার কাছে। জানান, রাষ্ট্র স্বেচ্ছাচারীদের হাতে পড়ে গেছে। ন্যায় ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ শুরু হয়েছে। এর প্রতিকার করতে হবে জনতাকেই। জনগণ উদ্বুদ্ধ হলো। তারা তুর্কনের কবল থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করার জন্য রাজপ্রাসাদে আক্রমণ করল। প্রধানমন্ত্রী জুনাইদি আগেই বিদ্রোহ করেছিলেন তুর্কনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন প্রদেশের শাসকরা দিল্লিকে চাপ দিয়ে আসছিল, যেন ইলতুতমিশের শেষ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়। এ পরিস্থিতিতে বহু অভিজাত রাজিয়াকে সমর্থন করেন। সেনাবাহিনীও স্বীকার করে তার আনুগত্য। শাহ তুর্কনকে বন্দি করা হয়।

দিল্লির ক্ষমতায় আসীন হন রাজিয়া। নিজেকে ঘোষণা করেন সুলতানুদ দুনইয়া ওয়াদ দীন; দুনিয়া ও ধর্মের শাসক। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবার সিংহাসনে বসলেন একজন নারী। জনগণ সেদিন উৎসব করছিল। আবদুল মালিক ইসামী তাঁর আকরগ্রন্থ ফুতুহউস সালাতীন-এ দিয়েছেন রাজিয়ার ক্ষমতারোহণের বিবরণ। তিনি জানান, রাজিয়া সেদিন ঘোষণা করেন, জনগণ! যদি আমি ন্যায়ের শাসন নিশ্চিত না করি, তাহলে আমাকে আপনারা ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করবেন। প্রকৃতপক্ষে জনগণের সমর্থন ছিল তার শাসক হবার আসল চালিকাশক্তি। তিনি শাসনক্ষমতাকে জনতার সাথে একটি চুক্তিতে পরিণত করেন, যা বহাল থাকবে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার শর্তের ওপর। জনগণ তাদের চুক্তি রক্ষা করেছিল। যতদিন রাজিয়া দিল্লিতে ছিলেন, কোনো বিদ্রোহকে তারা মাথা তুলতে দেয়নি। কোনো প্রাসাদষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। রাজিয়াও তার চুক্তি রক্ষা করেছিলেন। জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের পক্ষে থেকেছেন সব সময়।

রাজিয়ার ক্ষমতারোহণের সংবাদে রুকনুদ্দীন দিল্লিতে একটি বাহিনী পাঠান। কিন্তু তারা এসেছিলো পরাজিত হবার জন্য। অচিরেই রুকনুদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয় এবং অন্যায় হত্যাগুলোর দায়ে আদালত তার মৃত্যুদÐ ঘোষণা করে। তা কার্যকর হয় সম্ভবত ১২৩৬ সালের ১৯ নভেম্বর। চল্লিশচক্র রাজিয়াকে সুলতান হিসেবে মানতে বাধ্য হয়। তারা চেয়েছিল রাজিয়া তাদের অধীনে পরিচালিত হবেন। কিন্তু রাজিয়া শুরু থেকেই তাদের কর্তৃত্বের পরিসরকে সঙ্কোচিত করতে থাকেন। তিনি তুর্কি নয়, এমন একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করতে চেষ্টা করেন, যা চল্লিশচক্রকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা পদে পদে রাজিয়ার বিরোধিতা শুরু করে। কিন্তু রাজিয়ার শক্তি কোনো অভিজাতদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। শুরু থেকেই তিনি জনকল্যাণে মনোযোগী হন এবং নিজের পক্ষে জনতার সমর্থনকে সুদৃঢ় করেন। উজির জুনাইদী রুকনুদ্দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। রাজিয়ার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিলেন। তার সাথে ছিলেন বাদাউনের মালিক ইজ্জুদ্দীন মুহাম্মদ সালারী, মুলতানের মালিক ইজ্জুদ্দীন কবীর খান আয়াজ, হানসির মালিক সাইফুদ্দীন কুচি এবং লাহোরের মালিক আলাউদ্দীন জনি। উজির ও এসব রাজ্যশাসক সুলতানের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শুরু হয় বিদ্রোহ, সেনাসমাবেশ।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
তারেক রহমানের রাষ্ট্র চিন্তা
মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) দ্বীন ও মিল্লাতের নবায়ন-৬
আরও

আরও পড়ুন

ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে

ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে

রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত

রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ