রাজিয়া সুলতান : উপমহাদেশে প্রথম নারী শাসক-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৬ এএম

মিনহাজুস সিরাজ জানান, সুলতান ইলতুতমিশ ডিক্রি জারি করলেন বটে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো সুলতানের রেখে যাওয়া বিশেষ পরিষদের পক্ষ থেকে। এই পরিষদের নাম ছিল বন্দেগান-ই চেহেলগানি; অর্থাৎ চল্লিশজন নিবেদিত সেবক বা চল্লিশচক্র। তারা ছিলেন মূলত ইলতুতমিশের ক্রিতদাস। সুলতানের অনুগ্রহে তারা হয়ে উঠেন অভিজাত, প্রভাবশালী। ইলতুতমিশের আমলে তারা সেবক ছিলেন বটে। কিন্তু তার মৃত্যুর পরই তারা হয়ে উঠতে চাইলেন সর্বেসর্বা। তারা সুলতানের শেষ ইচ্ছার প্রতি কোনো সম্মান দেখালেন না। নারী হওয়ার কারণে রাজিয়া তাদের দৃষ্টিতে ছিলেন সুলতান হওয়ার অনুপযুক্ত। তারা চাইছিলেন এমন কোনো শাসক, যাকে নিজেদের মতো করে চালানো যাবে। রাজিয়া ছিলেন স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম এক ব্যক্তিত্ববান নারী। তাই তাকে শাসক হিসেবে তারা নিতে পারছিলেন না। তারা বরং ইলতুতমিশের পুত্র (জীবিতদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ), রাজিয়ার সৎ ভাই রুকনুদ্দীন ফিরোজকে সিংহাসনে বসালেন।

তারা দাবি করেন, জীবনের শেষ বছরগুলোতে ইলতুতমিশ নিজের কোনো পুত্রকে উত্তরাধিকারী বানাতে সম্মত হন। রুকনুদ্দিনকে লাহোর থেকে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনেন তিনি। কিন্তু এ দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারেননি তারা। রুকনুদ্দীন ক্ষমতায় বসে তার অদক্ষতার প্রদর্শনী শুরু করেন। শাসনকর্ম ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার মা শাহ তুর্কনের হাতে। তুর্কন ছিলেন এক ষড়যন্ত্রপ্রিয় নারী। হেরেমে তিনি বিরোধীদের গোপনে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ইলতুতমিশের পুত্র কুতুবুদ্দিনকে অন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাকে দেওয়া হয় মৃত্যুদÐ। রাজিয়াকেও রাখা হয় হুমকির মধ্যে। চল্লিশচক্রের প্রভাব দৌরাত্ম্যে পরিণত হয়। অ-তুর্কি প্রভাবশালীরা এতে বিক্ষুব্ধ হন। প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক জুনাইদি ছিলেন মূলত তাজিক। তার পুত্র জিয়াউল মুলক এবং তাজুল মুলক মাহমুদসহ বিভিন্ন তাজিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্ররক্ষার জন্য রাজিয়ার জরুরত আরো তীব্র হয়ে উঠে। বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন শাহ তুর্কন। তাই তিনি রাজিয়াকে হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করেন। এটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল এমন এক সময়ে, যখন রুকনুদ্দীন দিল্লির বাইরে কুহরামের দিকে মার্চ করছিলেন বিদ্রোহ দমনের জন্য।

সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন রাজিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে জনতার শরণাপন্ন হন। তিনি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন জনতার কাছে। জানান, রাষ্ট্র স্বেচ্ছাচারীদের হাতে পড়ে গেছে। ন্যায় ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ শুরু হয়েছে। এর প্রতিকার করতে হবে জনতাকেই। জনগণ উদ্বুদ্ধ হলো। তারা তুর্কনের কবল থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করার জন্য রাজপ্রাসাদে আক্রমণ করল। প্রধানমন্ত্রী জুনাইদি আগেই বিদ্রোহ করেছিলেন তুর্কনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন প্রদেশের শাসকরা দিল্লিকে চাপ দিয়ে আসছিল, যেন ইলতুতমিশের শেষ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়। এ পরিস্থিতিতে বহু অভিজাত রাজিয়াকে সমর্থন করেন। সেনাবাহিনীও স্বীকার করে তার আনুগত্য। শাহ তুর্কনকে বন্দি করা হয়।

দিল্লির ক্ষমতায় আসীন হন রাজিয়া। নিজেকে ঘোষণা করেন সুলতানুদ দুনইয়া ওয়াদ দীন; দুনিয়া ও ধর্মের শাসক। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবার সিংহাসনে বসলেন একজন নারী। জনগণ সেদিন উৎসব করছিল। আবদুল মালিক ইসামী তাঁর আকরগ্রন্থ ফুতুহউস সালাতীন-এ দিয়েছেন রাজিয়ার ক্ষমতারোহণের বিবরণ। তিনি জানান, রাজিয়া সেদিন ঘোষণা করেন, জনগণ! যদি আমি ন্যায়ের শাসন নিশ্চিত না করি, তাহলে আমাকে আপনারা ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করবেন। প্রকৃতপক্ষে জনগণের সমর্থন ছিল তার শাসক হবার আসল চালিকাশক্তি। তিনি শাসনক্ষমতাকে জনতার সাথে একটি চুক্তিতে পরিণত করেন, যা বহাল থাকবে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার শর্তের ওপর। জনগণ তাদের চুক্তি রক্ষা করেছিল। যতদিন রাজিয়া দিল্লিতে ছিলেন, কোনো বিদ্রোহকে তারা মাথা তুলতে দেয়নি। কোনো প্রাসাদষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। রাজিয়াও তার চুক্তি রক্ষা করেছিলেন। জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের পক্ষে থেকেছেন সব সময়।

রাজিয়ার ক্ষমতারোহণের সংবাদে রুকনুদ্দীন দিল্লিতে একটি বাহিনী পাঠান। কিন্তু তারা এসেছিলো পরাজিত হবার জন্য। অচিরেই রুকনুদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয় এবং অন্যায় হত্যাগুলোর দায়ে আদালত তার মৃত্যুদÐ ঘোষণা করে। তা কার্যকর হয় সম্ভবত ১২৩৬ সালের ১৯ নভেম্বর। চল্লিশচক্র রাজিয়াকে সুলতান হিসেবে মানতে বাধ্য হয়। তারা চেয়েছিল রাজিয়া তাদের অধীনে পরিচালিত হবেন। কিন্তু রাজিয়া শুরু থেকেই তাদের কর্তৃত্বের পরিসরকে সঙ্কোচিত করতে থাকেন। তিনি তুর্কি নয়, এমন একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করতে চেষ্টা করেন, যা চল্লিশচক্রকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা পদে পদে রাজিয়ার বিরোধিতা শুরু করে। কিন্তু রাজিয়ার শক্তি কোনো অভিজাতদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। শুরু থেকেই তিনি জনকল্যাণে মনোযোগী হন এবং নিজের পক্ষে জনতার সমর্থনকে সুদৃঢ় করেন। উজির জুনাইদী রুকনুদ্দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। রাজিয়ার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিলেন। তার সাথে ছিলেন বাদাউনের মালিক ইজ্জুদ্দীন মুহাম্মদ সালারী, মুলতানের মালিক ইজ্জুদ্দীন কবীর খান আয়াজ, হানসির মালিক সাইফুদ্দীন কুচি এবং লাহোরের মালিক আলাউদ্দীন জনি। উজির ও এসব রাজ্যশাসক সুলতানের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শুরু হয় বিদ্রোহ, সেনাসমাবেশ।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড