রাজিয়া সুলতান : উপমহাদেশে প্রথম নারী শাসক-৩
০৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৬ পিএম | আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
রাজিয়া সুলতান দক্ষতার সাথে এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। তিনি লাখনৌ থেকে আওধের মালিক নুসরাতুদ্দীন তাইসিকে বাহিনী নিয়ে দিল্লিতে আসার আদেশ করেন। কিন্তু তাইসি রাস্তায়, গঙ্গা নদীর তীরে কুচি বাহিনীর কবলে পড়েন এবং পরাজিত ও ধৃত হন, মারা যান। এবার সুলতান নিজেই বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হন। দিল্লি থেকে বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে যমুনাতীরে শিবির স্থাপন করেন। প্রতিপক্ষ বাহিনীগুলোকে বিচ্ছিন্ন রেখে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। খ- খ- যুদ্ধ হয় এবং বিদ্রোহীদের ক্ষয়-ক্ষতি বাড়তে থাকে। একদিকে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়াতে থাকেন, অপরদিকে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের তাগিদ দিচ্ছিলেন কূটনৈতিক চ্যানেলে। ফলে মুহাম্মদ সালারি ও ইজ্জুদ্দীন কবির খান রাজিয়ার আনুগত্য কবুল করেন। তারা যোগ দেন রাজিয়ার বাহিনীতে। আলোচনাকে গুরুত্ব দিতেন রাজিয়া। কিন্তু যেখানে যুদ্ধ দরকার, সেখানে নিজেই ময়দানে অবতীর্ণ হতেন। যুদ্ধে রাখতেন কেন্দ্রীয় ভূমিকা। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রণাঙ্গনের আক্রমণে তার নৈপুণ্য ছিল শত্রুদের প্রধান আতঙ্ক। তারপরও রাজিয়া রক্তপাত এড়াতে চাইছিলেন। জুনাইদী ও অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের কৌশলে বন্দি করার পরিকল্পনা করা হয় সালারি ও কবির খানের সাথে। তবে পরিকল্পনাটি শত্রুদের জানা হয়ে যায়। তারা সতর্ক হয়ে যায়। রাজিয়ার বাহিনী তাদেরকে যখন ধাওয়া করছিল তখন উজির জুনাইদী কৌশলে পালাতে সক্ষম হন। সাইফুদ্দীন কুচি ও ফখরুদ্দীন যুদ্ধে পরাজিত হন। উভয়কে বন্দি করা হয় এবং মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। জুনাইদীর পিছু ধাওয়া ত্যাগ করেননি রাজিয়া। চারদিকে বিছিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। জুনাইদী আশ্রয় নিয়েছিলেন উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশের দক্ষিণতম জেলা সিরমৌরে। এটি ছিল দুর্গম অরণ্য ও পর্বতমালায় পূর্ণ। রাজিয়ার সৈন্যরা সেখানে তাকে তাড়া করে। তিনি পাহাড়েই মারা যান। আলাউদ্দীন জনি আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রত্যন্ত এক গ্রামে। সৈন্যরা তাকে ধাওয়া করলে তাদের সাথে লড়াইয়ে তিনি নিহত হন। বিদ্রোহীদের এভাবেই দমন করা হলো। দেশজুড়ে শান্তি নিশ্চিত হলো। মিনহাজুস-সিরাজের মতে, তখন ‘লক্ষ্মণাবতী থেকে দেবল ও দামরিলা অবধি সমগ্র দেশের মালিক ও আমীরগণ তাঁর আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করে নিলেন’।
সুলতান দক্ষ হাতে প্রশাসন সংস্কার করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন খাজা মুহাজ্জাব উদ্দীনকে। যিনি ছিলেন আগের উজির জুনাইদীর সহকারী। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক বাহতুকে। বাহতুর আকস্মিক মৃত্যুতে মালিক কুতবুদ্দীন হাসান ঘুরিকে বানানো হয় নির্বাহী সেনাপ্রধান। সাবেক বিদ্রোহী নেতা ইজ্জুদ্দীন কবির খানকে লাহোরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সাবেক বিদ্রোহী ইখতিয়ার উদ্দীন আইতিগীন হন হাজিব বা সুলতানের একান্ত সহকারী। মালিক জামালুদ্দীন ইয়াকুব হন আমির-ই আখুর বা ঘোড়াশালার অধিপতি।
অতঃপর প্রজাকল্যাণ, শিক্ষাবিস্তার ও সুশাসন ব্যবস্থাপনায় নিমগ্ন হন রাজিয়া। তিনি একজন নারী, এই ভাবনা থেকে কেউ যেন তাকে দুর্বল মনে না করে, এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন সুলতান। প্রথমে তিনি পর্দার আড়ালে থাকতেন। মহিলা প্রহরীরা তাকে ঘিরে রাখত। ফলে জনগণ ও তার মধ্যখানে দরবারিরা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। ইসামী লিখেন, এ পরিস্থিতিতে তিনি একটি পোশাক (কাবা) এবং একটি টুপি (কুলাহ) পরতে শুরু করেন। ঐতিহ্যবাহী পুরুষ পোশাক পরে জনগণের সভায় হাজির হতেন তিনি। দিল্লির রাস্তায় হাতির উপর চড়ে বাজার পরিস্থিতি অবলোকন করতেন এবং পূর্ববর্তী সুলতানদের মতো জনসমক্ষে অভিযোগ শুনতেন ও প্রতিবিধান করতেন। বিশেষ এই পোশাক পরে তিনি রাজাসনে সমাসীন হতেন। হাতি ও ঘোড়ায় আরোহণ করতেন। কোমরে ঝুলাতেন কোষবদ্ধ তরবারি। এ নিয়ে দরবারের অভিজাতদের মধ্যে ছিল ক্ষোভ, বিরক্তি, কানাঘুষা। প্রথম দিকে তিনি মুদ্রা জারি করেন পিতার নামে। কিন্তু ১২৩৭-১২৩৮ সালে নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেন। মুদ্রায় নিজেকে ‘উমদাদ-উল-নিসওয়ান’ বলে অভিহিত করেন। অভিজাতরা তার ক্রমবর্ধমান দৃঢ়তা ও প্রভাবকে মেনে নিতে পারছিলেন না।
ভারতের রাজস্থানের রনতেম্বারে চাহামানা শাসক বিদ্রোহ করেছিলেন। মালিক কুতুবুদ্দীন হাসান ঘুরির মোকাবিলায় প্রেরিত হন। চাহামানরা পরাজিত হয়নি, তবে তাদের হাত থেকে হাসান ঘুরি উদ্ধার করেন বহু তুর্কি অভিজাতকে। সংঘাত অব্যাহত ছিল। এরই মধ্যে মেওয়াতিদের সাথে মিলে চাহামান বিদ্রোহীরা উত্তর-পূর্ব রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে। গোয়ালিয়রেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। তা দমনে সুলতানের প্রেরিত বাহিনী সফল হতে পারেনি। রাজিয়া এ বিদ্রোহ দমনে মনোযোগী যখন, তখন সংগঠিত হয় মিয়া বিদ্রোহ।
কারামাতিয়া শিয়াদের নেতা নুরুদ্দীন তুর্ক সুন্নী ও হানাফিবিরোধী প্রচারণা শুরু করেন। তার উগ্র অনুসারীরা দিল্লিতে জড়ো হন। সুদূর সিন্ধু থেকে কালিকট অবধি শহরে ও জনপদে তার উত্তেজনা বিস্তৃত হয়। প্রায় এক হাজার মারমুখী কারামতিয়া একদিন দিল্লির জামে মসজিদে হামলা করে। সময়টি ১২৩৭ সালের ৫ মার্চ শুক্রবার। জুমার নামাজে যখন জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মুসল্লি তখন মসজিদে প্রবেশ করে কারামাতিয়ারা। প্রাণঘাতী আক্রমণ করে মুসল্লিদের ওপর। কারামতিয়াদের এই সাহসের পেছনে কিছু দরবারি অভিজাতের যোগসাজসের গুঞ্জন ছিল। রাজিয়া এই নৈরাজ্য দমন করেন।
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাজপথে পরিকল্পিত নৈরাজ্য
বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩
বেগম খালেদা জিয়াকে পেয়ে সেনাকুঞ্জ গর্বিত : প্রধান উপদেষ্টা
এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া : যার হাসিতে হেসে উঠেছে বাংলাদেশ
নতুন জেনারেশনের চিন্তা-চেতনা সবাইকে বুঝতে হবে : এ এম এম বাহাউদ্দীন
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন
পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক : শেখ হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত : মির্জা ফখরুল
পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মিলার : বাংলাদেশে মানবাধিকার বহাল থাকবে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পরামর্শক নিয়োগ পেলেন টবি ক্যাডম্যান
হাইকোর্টের অভিমত : কুরআন অবমাননা ও মহানবীকে কট‚ক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে পারে সংসদ
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে : সিপিডি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : খুনি হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তির সুপারিশ : সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন : ট্রাম্প ফেরায় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা
এডিস মশার ভয়াবহ রূপ : একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু
ব্যবসায়ীরা হতাশ : বাংলাদেশিদের ভিসা না দিয়ে উল্টো বিপাকে ভারত!
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ -এ পদার্পণ : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা