রাজিয়া সুলতানা : উপমহাদেশে প্রথম নারী শাসক-৪
১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম

১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারেজমিদের তরফে নতুন হুমকি আসে দিল্লিতে। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে জোট গঠনের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আসেন গজনীর সাবেক খাওয়ারেজমি শাসক মালিক হাসান কারলুগের প্রতিনিধি। কারলুগ প্রতিনিধি হিসেবে নিজের পুত্রকেই প্রেরণ করেন। রাজিয়া তাকে সমাদর করেন, তার জন্য বারানের রাজস্ব বরাদ্দ করেন। কিন্তু মোঙ্গল হুমকির মুখোমুখি হতে রাজি হননি তিনি। কারণ, এমন জোট ভারতকে মোঙ্গল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাবে। এরই মধ্যে রাজিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ডালপালা মেলতে থাকে। জালালুদ্দীন ইয়াকুবের সাথে গোপন প্রেমের জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। দরবারের অভিজাতরা একে রাষ্ট্র করেন মূলত। তারা এই নারী শাসককে দমানোর উপায় খুঁজছিলেন। ক্রমেই গুজব ছড়াতে থাকলো চারদিকে। রাজিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই অভিযোগকে সত্য ধরে নেওয়া হয়েছে উপমহাদেশীয় কিছু চলচ্চিত্রে, জীবনীতে, উপন্যাসে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকও একে প্রচার করেছেন নির্বিচারে। তারা তাকে বলেছেন রাজিয়া ইয়াকুবী বা ইয়াকুতী। বস্তুত এ অভিযোগ ছিল উদ্দেশ্যমূলক, যা একান্তই কুসংস্কার ও অনুমানের ফসল। কিন্তু সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণে স্পষ্ট যে, জালালুদ্দীন ইয়াকুব ছিলেন আবিসিনীয় বংশের যোদ্ধা। তুর্কি অভিজাতদের একচ্ছত্র আধিপত্য কমিয়ে আনার চেষ্টায় সুলতান বিকল্প প্রভাবশালী শ্রেণি তৈরির চেষ্টা করছিলেন। এক্ষেত্রে যোগ্যতা ও আনুগত্যকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। ইয়াকুবের আনুগত্য ও নেতৃত্বগুণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাকে আমিরে আখুর পদ দেওয়াটা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ, এ পদমর্যাদা তুর্কি অভিজাতরা ভোগ করে আসছিলেন। সুলতান এখানে বিকল্প কাউকে পদায়ন করেন, এটা ছিল চল্লিশচক্রের ক্ষমতা হরণের ধারাবাহিকতার এক সিঁড়ি।
আবদুল কাদির বাদায়ুনীর মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখের ভাষ্য মতে, এই নিয়োগে তুর্কি অভিজাতরা প্রচÐ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এটা অনুমান করা যায় যে, ক্ষোভের প্রকাশে তারা কৌশলী ভ‚মিকা নেবেন। তখনকার সামাজিক বাস্তবতায় খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, এমন এক প্রচারণা তারা শুরু করবেন। বস্তুত হাবশি গোলামের প্রেমে পড়ে গেছেন সুলতান, এমন গুজব ছিল রাজিয়ার জনপ্রিয়তাকে হত্যার প্রয়াস। চারদিকে এর চর্চা হতে থাকে। প্রদেশে প্রদেশে অভিজাতদের মধ্যে কুÐুলি পাকাতে থাকে ক্ষোভ, উত্তেজনা। ইয়াকুবের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন রাজিয়া। চল্লিশচক্র নিজেদের বাইরের আর কাউকে এমন গুরুত্বের জায়গায় সহ্য করবেন না, এটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে তারা প্রবলভাবে শুরু করেন সুলতানের ভাবমর্যাদার বিনাশ। খাজা আবদুল মালিক ইসামী, আবুল কাশেম ফিরিশতা, ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দীর মতো ঐতিহাসিকগণ একমত যে, ইয়াকুবের সাথে রাজিয়ার ঘনিষ্ঠতা তার পতনকে ত্বরান্বিত করে।
রাজিয়ার বাবার এক মুক্ত ক্রিতদাস ছিলেন মালিক ইজ্জুদ্দীন কবির খান। তিনি প্রভাবশালী হয়ে উঠেন ইলতুতমিশের অনুগ্রহে। শুরুতে তিনি রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। আনুগত্যের শপথের বিনিময়ে রাজিয়ার ক্ষমা লাভ করেন। রাজিয়া তাকে লাহোরের গভর্নর পদে রেখে দেন। কিন্তু কবির খান ১২৩৮-১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে আবারো বিদ্রোহ করেন। দিল্লির অভিজাতরা তাকে প্রণোদিত করেছিল।
কবির খানকে দমনে অভিযান পরিচালনা করেন রাজিয়া। কবির পালিয়ে চলে যান মোঙ্গলদের শাসিত এলাকা সোধরায়। মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ এড়াতে চান রাজিয়া। তাই কবির ভেবেছিলেন তাদের সীমানায় তিনি সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করবেন না। কিন্তু রাজিয়া না থেমে কবিরকে ধাওয়া করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করেন কবির। রাজিয়া ক্ষমাশীলতা দেখান। নমনীয় আচরণ করেন। তবে লাহোরের প্রাদেশিক গভর্নরের পদ কেড়ে নেন। তাকে মুলতানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন।
ইতোপূর্বে মুলতানের গভর্নর ছিলেন ইখতিয়ারুদ্দিন কারাকাশ খান আইতিগিন। রাজিয়া তাকে নিয়ে আসেন দিল্লির রাজসভায়। বানান আমির-ই-হাজিব। আইতিগীনও ছিলেন তার বাবার ক্রিতদাস। ইলতুতমিশের আরেক ক্রিতদাস ছিলেন ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়া। রাজিয়া তাকে উত্তর-পশ্চিম ভারতের মালওয়া অঞ্চলে চÐিগড় ও পাঞ্জাবের নিকটবর্তী তাবারহিন্দের গভর্নর পদে সম্মানিত করেন। কিন্তু রাজিয়া যখন লাহোর অভিযানে ব্যস্ত, তখনই আইতিগীন ও আলতুনিয়া সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অভ্যুত্থান শুরু করেন। ষড়যন্ত্রকারী অভিজাতরা দিল্লির নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হন।
রাজিয়া দ্রæতই ফিরে আসেন রাজধানীতে। ১২৪০ সালের ৩ এপ্রিল দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। তাবারহিন্দে আলতুনিয়ার বিদ্রোহ জ্বলে উঠেছিল। দশ দিন পরে রাজিয়া সেদিকে যাত্রা করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাহিনী সংগ্রহ করেন আলতুনিয়া। তাকে রাজিয়ার সকল তথ্য দিয়ে সহায়তা করছিল দিল্লির অভিজাতরা। তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিপজ্জনক ফাঁদ। রাজিয়া আপন বাহিনী নিয়ে তাবারহিন্দে অবতীর্ণ হন। যতোটা যুদ্ধ হলো, তার চেয়ে বেশি হলো ষড়যন্ত্র। সেখানে প্রাণ হারান সুলতানের অনুগত বহু যোদ্ধা। নিহত হন ইয়াকুব। সুলতান লড়ছিলেন জানবাজ কয়েক সৈন্যকে সাথে নিয়ে। একে একে তারাও নিহত হলো। অবশেষে তাকে বন্দি করেন আলতুনিয়া।
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড