রাজিয়া সুলতানা : উপমহাদেশে প্রথম নারী শাসক-৫

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১৮ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

যুদ্ধের খবর দিল্লিতে দ্রুতই পৌঁছে যায়। সেখানকার অভিজাতরা বিলম্ব না করে পরবর্তী সুলতান মনোনীত করেন ইলতুতমিশের ছেলে মুঈজুদ্দীন বাহরামকে। তিনি ক্ষমতারোহণ করেন ১২৪০ সালের ২১ এপ্রিল। এরই মধ্য দিয়ে অবসিত হয় সুলতানা রাজিয়ার ৩ বছর, ৬ মাস ও ৬ দিনের শাসনামল। নতুন সুলতান দ্রুতই ক্ষমতাকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেন। তার ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করায় অতীতের রাজদ্রোহী আইতিগিনকে হত্যা করেন। চল্লিশচক্র এর মধ্যে নিঃচেষ্ট ছিল না। তারা নিজেদের মধ্যে প্রদেশ ও প্রশাসন ভাগ করে নিচ্ছিল। আলতুনিয়াকে উপেক্ষা করছিল তারা। বঞ্চিত হচ্ছিলেন মালিক সালারি, মালিক কারাকাশসহ কোনো কোনো তুর্কি অভিজাত।

এমতাবস্থায় হতাশ আইতিগীন রাজিয়া সুলতানার সাথে ঐক্যগঠনের উদ্যোগ নিলেন। বন্দি রাজিয়াকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। ক্ষমতা পুনরোদ্ধার করতে চাইছিলেন রাজিয়া। সুলতান হবার প্রথম দিন থেকেই তিনি কূটনৈতিকতাকে অবলম্বন করে আসছিলেন। তার যোদ্ধারা হয় মারা গেছেন, না হয় হয়েছেন বন্দি। যারা তার শুভাকাক্সক্ষী ছিল, তারাও নতুন পরিস্থিতিতে নতুন শাসকের আনুগত্য কবুলে বাধ্য হয়েছেন। রাজিয়া গোটা বাস্তবতাকে বিচার করলেন। আলতুনিয়া বিয়ের মাধ্যমে নিজের পরবর্তী জীবনকে উজ্জ্বল ও নিরাপদ করতে চাইছিলেন। রাজিয়া সম্মত হন। ১২৪০ সালের সেপ্টেম্বরে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাদের।

আলতুনিয়া সেনাবাহিনী গঠন করেন। সৈন্যদের অধিকাংশ ছিল ভাড়াটে। খোক্কর, জাট ও রাজপুত যোদ্ধারা অংশ নেয় রাজিয়া জিতবেন ভেবেই। কিন্তু এটি কোনো নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বাহিনী ছিল না। দিল্লিতে প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে অসন্তুষ্ট যে নেতারা এতে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই রাজিয়ার বিরোধিতায় লিপ্ত ছিলেন বছরের পর বছর। তাদের না ছিল নৈতিক জোর, না শৃঙ্খলা ও বিশ্বস্ততা। আলতুনিয়া-রাজিয়ার বাহিনীকে দমনের জন্য সুলতান মুইজুদ্দীন বিশাল সৈন্যসমাবেশ করেন। ১২৪০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর প্রকম্পিত ছিল উভয় বাহিনীর উত্তেজনায়। দিল্লির উপকণ্ঠে সুলতান মুইজুদ্দীন জয়ের সুবাস পাচ্ছিলেন। এখানে শেষ যুদ্ধটি হয় ১৪ অক্টোবর। যুদ্ধে আলতুনিয়ার সৈন্যরা ছত্রখান হয়ে পড়ে। পরাজিত হয় তারা। আলতুনিয়া ও রাজিয়া বাধ্য হয়ে ফিরে যান হরিয়ানা রাজ্যের কৈথালে। সেখানে ভাড়াটে যোদ্ধারা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে। ক্লান্ত, অবসন্ন রাজিয়া ও আলতুনিয়া গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ডাকাতদের একটি দল ঘুমন্ত অবস্থায় উভয়কেই হত্যা করে। তার মৃত্যু সম্পর্কে রয়েছে নানা বর্ণনা, নানা মত। একটি মত হলো, পলায়নের পথে তার দলে যোগ দেওয়া এক তুর্কি ক্রিতদাস তার খাদ্যে বিষ দেয়, তাকে হত্যা করে। অন্য এক মত হলো, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমান। কৃষক দেখে তার শরীরে আছে রাজকীয় পোশাক, যাতে আছে প্রচুর রতœ, মণি-মুক্তা। কৃষক বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী অসাধারণ কেউ। সম্পদের লোভে ঘুমন্ত রাজিয়াকে সে হত্যা করে এবং রতœ নিয়ে পালিয়ে যায়।

১২৪০ সালের ১৫ অক্টোবর নিহত হবার মধ্য দিয়ে অবসিত হয় রাজিয়া সুলতানার সংক্ষিপ্ত কিন্তু গৌরবদীপ্ত জীবন। পুরোনো দিল্লির তুর্কমান গেটের কাছে মহল্লা বুলবুলিখানায় তাকে সমাহিত করা হয়। শাহ সুফি তুর্কমান বায়াবানির অনুরাগী ছিলেন তিনি। সততা, নির্ভীকতা, মহত্ব ও মানবপ্রেমের শিক্ষা ছিল তার পরিচালক।

১২৩৬ থেকে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ। রাজিয়ার মাত্র চার বছরের শাসনকাল। ভারতের ইতিহাসে তা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে। এটা হয়েছে মূলত রাজিয়ার একক যোগ্যতাবলে। আপন প্রতিভা ও প্রভাব দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী রাজা, মহারাজা, বাদশাহ আর সম্রাটদের ইতিহাসে নিজের উজ্জ্বল অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।

মিনহাজুস সিরাজ তাবাকাতে নাসিরিতে রাজিয়াকে চিত্রিত করেন শ্রেষ্ঠ এক সুলতান হিসেবে, যিনি জ্ঞানী, জ্ঞানের বিস্তারে উদ্যামী, ন্যায়-নিষ্ঠ, মহিম গুণাবলীর অধিকারী। প্রজাদের রক্ষায়, সেনাবাহিনীর দক্ষ পরিচালনায়, কর্তব্য সম্পাদনের দৃঢ়তায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। গুণের সমাদর করতে কখনো কুণ্ঠিত হতেন না। জালালউদ্দীন ইয়াকুবের উচ্চ রাজকার্যে নিয়োগ এর প্রমাণ। তার হাত ধরে সাম্রাজ্য আরো সুদৃঢ় হয় এবং জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি ও নিরাপত্তা। ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধিত হয়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষ লাগানো হয় এবং পানি সরবরাহের জন্য খনন করা হয় অসংখ্য কুয়ো। মুসাফিরদের জন্য বানানো হয় বিপুল সংখ্যক সরাইখানা। তিনি অমুসলিমদের ওপর অর্পিত জিজিয়া কর বিলোপ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে চড়ে একেবারে সামনে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। তিনি সাহিত্যিক, শিল্পী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সঙ্গীত ও চিত্রকলার সমজদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তিনি নিজে ছিলেন কবি, আরবি, ফার্সি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার ওপর তার ছিল বিপুল দখল। আবুল কাশেম ফেরেশতা লিখেন, অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর ছিল তার কুরআন তেলাওয়াত। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তার উদ্যমে। নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

উপমহাদেশের ইতিহাসে নারী প্রতিভার অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছিল রাজিয়ার ব্যক্তিত্বে। তার অগ্রসর নারিত্বের অভিগামী হতে চেয়েছে মানব অগ্রযাত্রার পরবর্তী ইতিহাস! (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড