খাজা উসমান হারুনী (রহ.)-২

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

২৫ আগস্ট ২০২৩, ১১:২১ পিএম | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১১:২১ পিএম

ভারত, বুখারা, বাগদাদ, ফালুজা, দামেস্ক, মক্কা ও মদিনাসহ অনেক দেশ ও শহর পরিভ্রমণ করেন তিনি। হজব্রত পালনের সময় বহু মানুষকে তিনি সত্যের পথে আহবান জানান। প্রায় সব শহরেই তিনি সুফি ও দরবেশদের কাছে যেতেন এবং সাধনা করতেন। ঊশ যাওয়ার পথে ওশের শায়খ বাহাউদ্দিন (রহ.)-এর সাথে দেখা হয়। বাদাখশানে পৌঁছে তিনি বাগদাদের শায়খ জুনায়েদ (রহ.)-এর একজন পরিচারকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান ইলতুৎমিশের শাসনামলে খাজা উসমান হারুনী (রহ.) ভারত সফর করেন; হজের জন্য আরব গমনের পূর্বে ভারতের বিহারের নিকটবর্তী নালন্দার বেলছিতে তিনি কিছুকাল অবস্থান করে নামায, যিকির-আযকার আদায় করেন এবং বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করেন। স্থানীয় নানা ধর্মের মানুষ তাঁকে একনজর দেখার জন্য ভীড় জমান। তিনি তাদের আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান করেন এবং সৎজীবন যাপনের সবক দেন। তাঁর ভ্রমণের সময় সর্বদা সাথে ছিলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহ.), যিনি তাঁর খাবারের ঝুড়ি বহন করতেন। হজব্রত পালন শেষে খাজা উসমান হারুনী (রহ.) আবার ভারতে আসার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। কিন্তু হায়াত না থাকায় আর আসতে পারেননি।

দলীলুল আরিফীন কিতাবটি খাজা মইনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর মলফুযাত (বাণী সংকলন) করেছেন শায়খ বখতিয়ার কাকী (রহ.)। এতে একটি আশ্চর্য ঘটনার উল্লেখ আছে।

‘হযরত খাজা মইনুদ্দীন হাসান চিশতী আজমিরী (রহ.) বলেন, একবার আমি আমার পীর হযরত উসমান হারুনী (রহ.)-এর সাথে সফরে ছিলাম। আমরা ইরাকের দজলা (টাইগ্রিস) নদীর কিনারে পৌঁছলাম। নদী পার হওয়ার জন্য সেখানে কোনো নৌকো ছিল না। আর আমাদের তাড়া ছিল। হজরত খাজা উসমান হারুনী বলেন, চোখ বন্ধ করো। যখন চোখ বন্ধ করি নিজেকে ও পীর সাহেবকে দজলা নদীর ওপারে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। বিনয়ের সাথে আবেদন করি যে, কীভাবে আমরা এখানে পৌঁছুলাম? তিনি বললেন, পাঁচবার সূরা ফাতিহা পড়ে পানিতে পা দিয়েছি, এপারে চলে এসেছি। অতএব, যে ব্যক্তি ঐকান্তিকতার সাথে কোনো প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সূরা ফাতিহা পড়ে, যদি সেই কাজ ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ না হয় তবে সে আমার জামার হাতা ধরে রাখতে পারে’ (সূত্র: বখতিয়ার কাকী, দলীলুল আরিফীন, পৃ. ৪০, মজলিস: ৭)।

একবার এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি হযরত খাজা উসমান হারুনী (রহ.)-এর খেদমতে হাজির হন। ওই বৃদ্ধ লোকটির চেহারায় ছিল দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও পেরেশানীর স্পষ্ট ছাপ। খাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন: কী ব্যাপার? বৃদ্ধ লোকটি নিবেদন করলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে আমার বড় ছেলেটি নিখোঁজ। সে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা-ও জানি না। আল্লাহ তায়ালার দরবারে দুআর জন্য আমি আপনার খেদমতে উপস্থিত হয়েছি। শুনেছি, আপনার দুআ সব সময় কবুল হয়।’ হযরত খাজা উসমান হারুনী (রহ.) তখন ক্ষণিকের জন্য মুরাকাবা করে হাজিরীনে মজলিসকে বললেন, ‘কয়েকবার সূরা ফাতিহা পড় যেন এই মুসাফির লোকটির ছেলে ফিরে আসে।’ উপস্থিত লোকজন সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। এরপর খাজা ওই লোকটিকে বললেন, ‘যাও তোমার ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে।’ বাড়ি ফিরার আগেই পথে এক ব্যক্তি তাকে খরব দিল, ‘তোমার ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে’ (হযরত মুফতী ওলী হাসান টোংকী (রহ.) কৃত ‘আওলিয়ায়ে পাক ও হিন্দ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)।

খাজা উসমান হারুনী (রহ.) ৫ শাওয়াল, ৬১৭ হিজরিতে (১২২০ খ্রিস্টাব্দ) মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং জান্নাতুল মুয়াল্লায় সমাহিত হন। বিহারের বেলচিতে তাঁর অনুসারীরা গড়ে তোলেন একটি খানাকাহ ও উসমানী চিল্লাহ হল (এটি দাফনবিহীন স্মৃতিসৌধ)। এটিকে খাজা উসমান হারুনী (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক এবং তাঁর আশীর্বাদের উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন মত ও ধর্মের মানুষ সেখানে ইসলাম ধর্মের জীবনমুখী বাণী শুনতে আসেন। বছরে একবার বার্ষিক জমায়েতও অনুষ্ঠিত হয় এবং যিকির-আযকারে মশগুল থেকে হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করার প্রয়াস পান আগতরা। বেলচিতে তাঁর আগমনের ফলে বহু মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। কুসংস্কার, বলিদান, বর্র্ণবৈষম্য ও জাতপাতের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। (সমাপ্ত)

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড