নাসিরুদ্দীন মাহমুদ : কূটনীতি ও দরবেশির সালতানাত-৪
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৬ পিএম | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
৬৫১ মুহররমের শেষ তারিখে (১ এপ্রিল, ১২৫৩ ) বিশ বছর বয়সী সুলতানের আদেশ শান্তিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে, উলুগ খান নিজের শাসনাধীন বিরাট অঞ্চল বিরোধীদের ছেড়ে দেন। কিন্তু এই সমঝোতা খুব কম সময়ই স্থায়ী ছিলো।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পারস্পরিক সংঘাতে তার শাসনের পরবর্তী বছরগুলো জর্জরিত থেকেছে। তার ১৯ বছরের শাসনকাল তুর্কি অভিজাতদের হানাহানিতে ক্ষত-বিক্ষত এবং শেষ বারোটি বছর তীব্র এই লড়াই প্রতিকারহীন বাস্তবতায় পরিণত হয়। গিয়াসউদ্দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.) সুষ্পষ্ট প্রাধান্যে নিজের একক অবস্থান গড়ে নেবার মধ্য দিয়েই এর প্রতিকারের পথ তৈরি হয়। সেই পথও নির্মাণ করে দেন নাসিরুদ্দীন মাহমুদ। তার রাজত্বের সময় যতগুলো বিদ্রোহ হয়েছে, তার সবই গিয়াসউদ্দীন বলবন সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেন। ফলে প্রকৃত সুলতান বলবনই হয়ে উঠেছিলেন। ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে মুলতান থেকে মোঙ্গলদের বিতাড়িত করার সময়, তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এর পুরস্কার স্বরূপ নাসিরুদ্দীন তাঁকে প্রধান মন্ত্রিত্বের পদ দান করেন। পরে তিনি তাঁর নিজ কন্যার সাথে গিয়াসউদ্দীনের বিবাহ দেন।
এটা সত্য যে, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সহজসরল জীবন যাপন করতেন। নিজের হাতে কুরআন বিক্রি করে তিনি ব্যক্তিগত খরচের ব্যস্থা করতেন। তার কোনো চাকর ছিল না এবং তার স্ত্রী-পরিবারের জন্য খাবার রান্না করতেন নিজেই। এই সরল জীবনযাত্রার সাথে কুটিল রাজনীতি ও দ্বন্দ্বস্রোতে নিজের টিকে থাকা সহজ কোনো ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এবং আমৃত্যু শাসক হিসেবে টিকে থাকাই কি নাসিরুদ্দীনের আসল কৃতিত্ব? মোটেও নয়। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ তার নেতৃত্ব, কৃতিত্ব এবং দিল্লি সালতানাতের সীমানা বৃদ্ধি এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও স্থিতিশীলতা ধরে রাখার অবদানের জন্য একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসে দাঁড়িয়ে আছেন। তার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা, সামরিক প্রতিপত্তি এবং সবল ও গতিশীল উত্তরাধিকার তাকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। কয়েকটি দিক বিচার করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
(ক) অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বাহ্যিক হুমকিসহ ভয়ানক চ্যালেঞ্জের সাথে তার রাজত্ব শুরু হয়েছিল। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সূক্ষ্মভাবে মোকাবেলার ফলে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয়। তাঁর সময়টি মূলত কূটনৈতিক দক্ষতা দ্বারা পরিচালিত একটি শাসনামল।
(খ) সুলতানের প্রাথমিক অর্জনগুলির মধ্যে একটি ছিল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ভূখ-ের স্থিতিশীলতা। তিনি প্রশাসনিক সংস্কার প্রবর্তন করেন, যার লক্ষ্য ছিল শাসনব্যবস্থাকে প্রবাহিত করা এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, আমলাতন্ত্রের দক্ষতার উন্নতি এবং দুর্নীতি কমানোর উপর দৃষ্টি রেখে তিনি নীতি প্রণয়ন করেন। সুশাসনের প্রতি মাহমুদের প্রতিশ্রুতি সালতানাতের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে শক্তিশালী করেছিল।
(গ) সাম্রাজ্যের অখ-তা ও আঞ্চলিক স্থিতি রক্ষার জন্য সামরিক শক্তিকে বিকশিত করেন নাসিরুদ্দীন মাহমুদ। তিনি দিল্লি সালতানাতের সীমানা সম্প্রসারণের জন্য সফল সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। প্রতিবেশী অঞ্চলের বিরুদ্ধে তার অভিযানে তার সামরিক সামর্থ্য স্পষ্ট প্রকাশিত হয়, যা শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের সীমানাকে প্রসারিত করেনি, বরং ভারতীয় উপমহাদেশে তার আধিপত্যকে মজবুত করেছে।
(ঙ) নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আগ্রহের স্বাক্ষর রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তিনি প-িত, কবি এবং শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, দিল্লির দরবারে একটি প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। এই পৃষ্ঠপোষকতার ফলে পারস্য ও ইন্দো-ইসলামিক সাহিত্য, স্থাপত্য এবং সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে। সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার প্রতি সুলতানের সমর্থন শুধুমাত্র সুলতানি ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেনি বরং উপমহাদেশীয় বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণেও অবদান রেখেছে।
(চ) নাসিরুদ্দীন মাহমুদের স্থাপত্যের উত্তরাধিকার তার শাসনামলে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ এবং কাঠামোতে স্পষ্ট। স্থাপত্য প্রকল্পগুলিতে তার পৃষ্ঠপোষকতার ছাপ রয়ে গেছে জটিল নকশায়, উদ্ভাবনী কৌশলে। দিল্লির ল্যান্ডস্কেপে যা স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে। কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে তার নানা কাজে তার স্থাপত্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ পাওয়া যায়।
(ছ) নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনকালে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংহতির নীতি বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। সাম্রাজ্যের বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় ফ্যাব্রিককে তিনি স্বীকৃতি দেন। বহুত্বকে অভিনন্দিত করেন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির প্রেরণা বিস্তার করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং নেতাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা সামাজিক সংহতি এবং সাম্রাজ্যের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকাশে অবদান রাখে।
(জ) সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনকাল দিল্লি সালতানাতের ঘরের ভেতরে ঝড়বিক্ষুব্ধ একটি সময়। কিন্তু জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে একেবারে কম। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামরিক সম্প্রসারণ, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতায় তার কৃতিত্ব একটি পথের ইশারা করে। তার আগের শাসকরা সেই পথের সূচনা ঘটান এবং তিনি সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসকদের জন্য একে আরো সুগঠিত করেন।
নাসিরুদ্দীন মাহমুদের উত্তরাধিকার এই অঞ্চলের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে, সেই প্রভাবের ধার এবং ভার বহন করছে ইতিহাস। তার নীতি এবং অর্জনগুলি ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক অদম্য প্রভাব ফেলেছিল।
একজন দূরদর্শী নেতা হিসাবে, তিনি দিল্লি সালতানাতের উপর একটি অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছেন। সহনশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক সমাজের নমুনা আজকের দিল্লিকেও পথপ্রদর্শন করতে পারে। (সমাপ্ত)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা