ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.)-১

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৪ পিএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের এক মহান সাধক ও আধ্যাত্মিক জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় চিশতী তরিকার প্রবর্তক এবং ইসলামী সুফি মরমীধারার প্রসারে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখেন। চিশতীয়া তরিকা মানবপ্রেম, সহনশীলতা, পরোপকারিতা এবং বস্তুবাদ থেকে দূরত্বে থাকার গুণাবলি শেখায়। এই বিশেষ তরিকা মধ্যযুগে ভারতে প্রভাবশালী মুসলিম আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল এবং বিখ্যাত অলি শায়খ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (মৃত্যু ১৩২৫) ও তুতিয়ে হিন্দ নামে পরিচিত কবি আমির খসরু (মৃত্যু ১৩২৫)-সহ অনেক প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ভারতীয় সুন্নি সাধক চিশতী ছিলেন। ‘সুলতানুল হিন্দ’ ও ‘গরীব নওয়ায’ (দরিদ্রদের উপকারকারী) নামেও তিনি সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। ৯৭ বছরের পুরো জীবন তিনি তাওহীদের প্রচার, দ্বীনের দাওয়াত, আত্মসংযম ও মানবসেবায় উৎসর্গ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার সিজিস্তানের অন্তর্গত সানজার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত। শৈশব থেকেই তিনি ধার্মিকতা ও ত্যাগের গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। কিশোর বয়সে তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তিনি তার পিতার পেশা গ্রহণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে ফিরে যান।

তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র সমরকন্দ ও বুখারায় অবস্থিত মাদরাসাগুলোতে তিনি পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য অধ্যায়ন করেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী ছিলেন একজন সুন্নী মুসলিম দার্শনিক এবং ধর্মীয় প-িত। মাযহাবে তিনি ছিলেন হানাফী ও চিন্তাধারায় মাতুরিদী। তিনি ত্রয়োদশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন এবং দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি দরিদ্র লোকদের সাহায্য করার জন্য আজমীরে খানাকাহ প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতোমধ্যে নিজ মাতৃভূমি সিজিস্তান, খুরাসানসহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ মোঙ্গলদের পৈশাচিকতার বীভৎস তা-বে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে তিনি হিজরত তথা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। মানবতার অধঃপতন রাজনৈতিক নোংরামি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য নৃশংস পন্থায় মানুষ হত্যা হযরত খাজা সাহেবের অন্তরকে বিচলিত করে তোলে। তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন যে, আর পরকালীন জবাবদিহি ও মহানবীর (সা.) আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে মানুষের মধ্যে ধনলোভ, নৃশংসতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালোভের উদগ্র মোহ সৃষ্টি হয়। সমকালীন এহেন অমানবিক ও অধার্মিক আচরণ হযরত খাজা সাহেবের অন্তরে বিদ্যমান আধ্যাত্মবাদের স্পৃহাকে তীব্রতর করে তোলে। মানুষকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে ইসলামের শাশ্বত পথে আহ্বান জানানোর উদ্দেশে তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ইরাক যাবার পথে নিশাপুর এলাকায় পৌঁছলে তিনি হযরত খাজা উসমান হারুনী (রহ.) নামক প্রসিদ্ধ দরবেশের দেখা পান। তার সান্নিধ্যে তিন বছর অতিবাহিত করে তিনি রুহানিয়্যাতের উচ্চমার্গে আরোহণ করেন। অতঃপর তিনি স্বীয় মুর্শিদের হুকুমে মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, তাবরেজ, ইস্পাহান, বলখ, গজনী পরিদর্শন করেন। দীর্ঘ সফরে মুসলিম বিশ্বের প্রসিদ্ধ সুফী-সাধক ও প-িত বিশেষত হযরত শাহ আব্দুল কাদের জিলানী, শায়খ নাজমুদ্দীন কোবরা, শায়খ নাজিবুদ্দীন, শায়খ আবদুল কাহির সোহরাওয়ার্দী, শায়খ আবু সাঈদ তাবরিজী, শায়খ আবদুল ওয়াহিদ গজনভীর সাথে সাক্ষাত ঘটে।

দেশ ভ্রমণের বিচিত্রতা ও যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর অলীদের সাহচর্য হযরত খাজা সাহেবের অভিজ্ঞতার ভা-ারকে সমৃদ্ধ করে এবং মুসলিম ধর্মীয় জীবনে সব গুরুত্বপূর্ণ তরিকার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। অতঃপর হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) ভারতের উদ্দেশে লাহোরের পথে রওয়ানা হন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি দিল্লী রওয়ানা হন। দিল্লী অবস্থানকালে বিপুলসংখ্যক মানুষ তার হাতে ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। হিজরী ৫১৬ সালে রাজপুতদের শক্তিশালী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্র আজমীরে গমন করেন। তথায় পাহাড়ের পাদদেশে খানকাহ স্থাপন করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আধ্যাত্মসাধনা, দাওয়াতী ও তাবলিগী খিদমাত আঞ্জাম দিতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর চরিত্রমাধুর্য, নিঃস্বার্থ ধর্মপ্রচার, মানবসেবা, আধ্যাত্মসাধনা ও অলৌকিক ঘটনাবলির খবর আজমীর ও আশপাশে তড়িতবেগে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য পথহারা মানুষ খাজা সাহেবের পুতঃসান্নিধ্যে এসে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার বর্জন করে তাওহীদের অমিয় বাণী গ্রহণ করতে থাকেন এবং তাদেরই প্রচেষ্টায় বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে বেশকিছু মসজিদ ও মক্তব।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড