গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-৩
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
রাজতন্ত্রকে মহিমান্বিত করবার চেষ্টা ছিলো বলবনের। অভিজাতবর্গ থেকে সুলতান কত বেশি আলাদা, সেটা স্পষ্ট করা হতো। বলবনের কর্তৃত্ব বৈধতা পেয়েছিলো বাগদাদের খলিফার তরফে। বাগদাদের খলিফা হীনবল এবং খেলাফত প্রায় অবসিত। কিন্তু বলবন তাঁর মুদ্রায় খলিফার নাম উল্লেখ করতেন, খুৎবায় তাঁর নাম পাঠ করতেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি ইসলামী খেলাফতের ঐতিহ্য রক্ষা করেন। পাশাপাশি মোঙ্গল হুমকির বিরুদ্ধে এ ছিলো একটা বার্তা। কারণ দিল্লীর সালতানাত বাগদাদের খেলাফতকে কতৃত্ববান মনে করে এবং তার স্থায়িত্বের জন্য প্রার্থনা করে। এতে বাগদাদের বহু দূরেও তার পক্ষে শক্তিশালী একটি বন্ধন ও নৈতিক সহায়তার আওয়াজ উচ্চারিত হলো। অপরদিকে পারস্যের প্রাচীন শাসক বংশের সাথে নিজেকে যুক্ত করতেন বলবন। এর মধ্য দিয়ে নিজের অসাধারণত্ব ও স্বাতন্ত্র্যকে খোলাসা করতেন। ফলে রাজকর্তৃত্বের জন্য যে পবিত্র বৈধতা ও স্বীকৃতি জরুরি, তা যেমন বলবনের আছে, তেমনি আছে সেই কৌলিন্য, যাকে শাসক হবার জন্য অবধারিত বলে দাবি করতেন তিনি। বলবন ইলতুতমিশের দাস ছিলেন। অনেকের মতে, একারণেই নিজেকে অনেক উঁচুতে নেবার জন্য আভিজাত্যের সকল উপাদান তিনি অনুসন্ধান করেছেন। তার আভিজাত্য-প্রবণতার এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে মূল কারণ এটা নয়। বস্তুত প্রতাপ ও আভিজাত্য ছিলো তার মানসগঠনের প্রধান উপাদান।
ইরানের কাল্পনিক মহানায়করাই ছিলো তার আদর্শ। তাদের অনুকরণে তিনি কতিপয় তত্ত্ব গঠন করেন। এসব তত্ত্বের মৌলিক দিকগুলি হচ্ছে :
১. রাজ্য হলো পৃথিবীতে খোদাপাকের প্রতিনিধিত্ব (নিয়াবাতে খোদায়ী ) এবং তার মর্যাদা নবুওয়াতের পরের স্তর। শাসক হলেন খোদার ছায়া এবং তার হৃদয় খোদায়ী হেদায়াত ও নুরের আধার।
তিনি তার রাজকীয় দায়িত্ব পালনে সবসময় খোদায়ী দিকনির্দেশনা দ্বারা পরিচালিত হন। এই তত্ত্ব জোরালোভাবে দাবি করে যে, রাজার ক্ষমতার উৎস অমাত্যবর্গ বা প্রজারা নয়, একমাত্র খোদাতাআলা। তাই তার কাজগুলো জনসাধারণের যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় হতে পারে না।
২. দৃশ্যমান মর্যাদা ও মহিমাকে রাজত্বের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করা হয়েছিল। বলবন তার শাসনামল জুড়ে জনগণ থেকে খুব সচেতনভাবে দূরত্ব বজায় রাখতেন এবং কঠোরভাবে তা অনুসরণ করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে একেবারেই অস্বীকার করেছিলেন। দিল্লির এক ধনী ব্যক্তি ফখর বাওনী দরবারের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়, তখন কর্মকর্তারা সুলতানের সাথে তার কথা বলার সুযোগ করে দেন। কিন্তু সুলতান তার অফিসারদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
৩. তিনি যেভাবে রাজত্বের মহিমার উপর জোর দিয়েছিলেন, তেমনি রাজসভার আদবের দিকেও খুব জোর দিতেন। তিনি তার দরবারে পশমী পোশাক এবং রাজকীয় আবরণ ছাড়া কখনো যাননি। এমনকি তার সেবকরাও তাকে কখনো রাজকীয় পোশাক, মোজা আর টুপি ছাড়া দেখেনি।
নি¤œবর্গীয় লোকদের সাথে যে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখা বা শাসনব্যবস্থার যে কোন পদে নি¤œবর্গের লোকদের নিয়োগদানকে একজন শাসকের মর্যাদাপরিপন্থী বলে মনে করতেন।
৫. বংশীয় আভিজাত্য বলবনের একটি দুর্বলতা ছিল। তিনি নিজেকে মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামার দেওমালাই এ বিবৃত রাজা আফরাসিয়াবের বংশধর বলে দাবি করতেন। তিনি বেশ গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে দরবারে এর আলোচনা করতেন।
সাইয়েদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী তার মাকতুবাতে আশরাফি-এ সংকলিত এক চিঠিতে লিখেছেন, বলবন তার অফিসার ও প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বংশপরিচয় খুব গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করতেন। তাদের বংশপরিচয় নির্ণয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য রাজ্যের প্রতিটি অঞ্চল থেকে অভিজ্ঞ বংশবিশারদদের দিল্লিতে জড়ো করা হয়েছিল।
৬. বলবন বিশ্বাস করতেন, ইরানী রীতিনীতি এবং জীবনধারা গ্রহণ না করে রাজত্ব করা সম্ভব নয়। পারিবারিক ও জনজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ইরানি ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন। তার সিংহাসনে আরোহণের আগে যে ছেলেরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাদের নাম রেখেছেন মাহমুদ এবং মুহাম্মদ। কিন্তু তার যে নাতিরা তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাদের নাম রাখতেন পারস্যের রাজাদের আদলে; কায়কোবাদ, কায়খসরু, কায়কাউস প্রভৃতি।
বলবন তার দরবারকে ইরানি রীতি অনুযায়ী সাজিয়েছিলেন এবং সাসানিদের মজলিসি কায়দা ও রসম-রেওয়াজ অনুসরণ করতেন প্রতিটি ক্ষেত্রে।
‘তিনি তার সূর্যের মতো উজ্জ্বল মুখ এবং কর্পূরের মতো দাড়ি নিয়ে মহান সাসানি সম্রাটদের আদলে আপন সিংহাসনে বসতেন।’ ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ফাজুনি ইস্তারাবাদি লিখেছেন, ‘তাঁর মুখ ছিল লম্বা, দাড়ি ছিল দীর্ঘ এবং একটি উঁচু মুকুট পরিধান করতেন। তার দাড়ির ডগা থেকে তার মুকুটের উপরের প্রান্ত পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক গজ। জাঁকজমক ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত ছিলো প্রখর একজোড়া চোখ। ছোট ছোট বিষয়েও মজলিসের আচার-আচরণ ও গঠনতন্ত্রের সতর্ক অনুকরণ করতে হতো। নীতি ও নিয়মের শাসনের প্রতীক ছিলো তার ব্যক্তিত্ব। হাজিব, সালাহদার, জোশ, নকীব ইত্যাদি পদাধিকারীরা তার চারপাশে স্থির থাকতো। এদের মধ্য থেকে যারা তার সামনে হাজির হওয়ার মর্যাদা লাভ করতো, তারা তাকে অবনত মস্তকে প্রণতি জানাতো এবং তার পায়ে চুম্বন করতো। তার উপস্থিতিতে কোন হাস্যকৌতুক বা স্বাধীনভাবে কোন বক্তব্যদানের অনুমতি ছিল না। মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক নিজেদের পদমর্যাদার অধিকারে তার সামনে দাঁড়াতেন। বাকি সবাই সিংহাসনের পিছনে বসে থাকতেন। সুলতান তার মহিমার প্রতাপে সবাইকে তটস্থ রাখতেন।
কেউ কখনো তাকে হাসতে ও কৌতুককর কথা বলতে দেখেনি। তার জীবনে ব্যক্তিগত শোক-দুঃখের অপ্রত্যাশিত ঝড় তার ভিতরের লোকটিকে হত্যা করলেও সুলতানের সময়সূচিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দরবারি আদব-শিষ্টাচারের এ ধারা অব্যাহত ছিল।’
সাধারণ প্রশাসন এবং সামরিক প্রশাসন সম্পর্কে বলবন দৃঢ় ও নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ক্ষমতাকে আগে বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছিলো। তিনি একে নিয়ে আসেন এক হাতে। এর মধ্য দিয়ে সুলতানের একচ্ছত্রতা নিশ্চিত করা হয়। যখন তিনি সিংহাসনে বসেন, শাসন শাসনকাঠামো ছিল বিশৃংখল অনুশীলনের অধীন, নেতৃত্ব ছিলো প্রায় অকার্যকর। তুর্কি-আমির ও মালিকদের হাতে অনিয়ম পরিণত হয় নিয়মে। রাজকর্তৃত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের আস্থা কমে যাচ্ছিল। মধ্যযুগীয় প্রশাসনের মূলশক্তি যে রাজতান্ত্রিক শৌর্যবীর্য এবং তীব্রতা, তা তখন উধাও। বলবন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে শাসনকাঠামোকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করান। তার কার্যকরিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেন।
দক্ষ সেনাবাহিনী ছাড়া সাম্রাজ্য টিকবে না। ইলতুতমিশ দক্ষ সেনাসংগঠন গড়েছিলেন বটে। কিন্তু অর্ধশতাব্দীর পরে তা দিয়ে আর চলছিলো না। নতুন করে সামরিক প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
অতএব, (১) কেন্দ্রীয় বাহিনীতে বলবন বিপুল পরিমাণে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তার সেনাবাহিনীর মূল অংশের নাম ছিলো ক্বালব-ই-আলা। এতে থাকতেন বিপুল সংখ্যক অনুগত ও অভিজ্ঞ অফিসার। সৈন্যদের বেতন বাড়ানো হয়। বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। নানা রকম পুরস্কার ও সম্মানির ব্যবস্থা রাখা হয়। নগদ অর্থের পরিবর্তে সৈন্যদের নিষ্কর জমি ইজারা দেওয়া হয়।
(২) তার সামরিক নীতির প্রধান অংশ ছিলো সৈন্যদের আর্থিক নিশ্চয়তা বিধান। সেনাবাহিনীর জন্য অর্থব্যয়ে তিনি ছিলেন অকৃপণ। তাদের অস্ত্র ও উপাদানগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ছিলেন মনোযোগী। বর্ধিত পারিশ্রমিক দিয়ে সেনাবাহিনীর আনুগত্য ও সেবালাভ তিনি নিশ্চিত করেন। ‘সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত ব্যয়কে কখনো অপ্রয়োজনীয় মনে করো না।’Ñ এই উপদেশ তিনি দিয়েছিলেন নিজের পুত্র বুগরা খানকে।
(৩) নিয়মিত অনুশীলন, ঘোড়সওয়ারি, আক্রমণ প্রতিরোধের নিত্য-নতুন টেকনিক, মোঙ্গলদের যুদ্ধ কৌশলের প্রতিরোধী রণরীতি, নৌযুদ্ধ ও নৌব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে ছিলো তার মনোযোগ। অত্যন্ত দক্ষ, ক্ষিপ্র এবং বিশ্বস্ত এক হাজার সৈন্যের একটি দল সরাসরি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন বলবন।
(৪) সৈন্যদের জন্য নীতি ও শৃঙ্খলার অনুসরণে কঠোর নির্দেশনা ছিলো। যুদ্ধযাত্রার সময় সেনাবাহিনী যাতে বেসামরিক মানুষ, সম্পত্তি বা ফসল নষ্ট না করে, সেদিকে বলবনের তীক্ষè দৃষ্টি ছিলো, কঠোর নিয়ম ছিলো। নৈতিক উন্নয়ন ও প্রভাব তৈরির জন্য দরবেশ-যোদ্ধারা সেনাবাহিনীতে বিশেষ অবস্থান পেতেন।
(৫) পরিকল্পনা ও প্রায়োগিকতাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। কৌশলকে মনে করতেন প্রধান শক্তি। কোনো সামরিক অভিযান কর্মসূচি গ্রহণের আগে বলবন তার উপযোগিতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীর বিচারবিশ্লেষণ করতেন। তাই ব্যর্থ সামরিক অভিযান দ্বারা অর্থ নষ্ট করার দায় তাঁর ওপর বর্তায়নি।
(৬) বলবন তার সমস্ত অভিযানের উদ্দেশ্য কঠোরভাবে এবং কারও কাছ থেকে গোপন রাখতেন তার গতিবিধি ও গন্তব্য আগে থেকে জানাতেন না। সেনাকর্মকর্তারা আগের রাতে জানতেন অভিযান সম্পর্কে। ফলে সেনাবাহিনীকে সব সময় সকল পরিস্থিতিতে তৈরি থাকতে হতো।
(৭) সেনাবাহিনীর জন্য ছিলো স্বতন্ত্র বিচারক। যারা ন্যায়পরায়নতা ও দ্রুত বিচারে দক্ষতার জন্য ছিলেন বিশিষ্ট। এ বিচারব্যবস্থা সেনাবাহিনীর কর্মকা-কে কঠোরভাবে তদারকি করতো।
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত