ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

গিয়াসুদ্দীন বলবন স্থিতিস্থাপক সুলতান-৫

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম

শাসন-সংগঠনে বলবন ছিলেন একচ্ছত্রতাবাদী। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, পদপরিবর্তন, বদলি ও শাস্তিবিধানে একক কর্তৃত্ব ছিল সুলতানের। ইতোপূর্বে ‘নায়েবে মামলাকাত’ বা সাম্রাজ্যের সহকারী পদবি নিয়ে উজিরগণ কীভাবে ক্ষমতাকে দ্বন্দ্বের মল্লভূমি বানিয়েছিলেন এবং প্রশাসনের দক্ষতা নষ্ট করেছিলেন, সে অভিজ্ঞতা বলবনের ছিল। ‘নায়েব’ পদটিকে আগেই নাই করে দেয়া হয়েছিলো। বাকি ছিলো উজিরের পদ। পদটি বহাল রাখা ছিলো জরুরি। উজির থাকলেন বটে, কিন্তু তার হাতে সামরিক ও অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা থাকলো না। সে ক্ষমতা সুলতানের হাতে চলে গেলো। তুর্কি অভিজাতদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তুর্কি অভিজাতশ্রেণির সমর্থন ছাড়া তার ক্ষমতা বজায় থাকবে না, এটা তার অজানা ছিলো না। আবার তিনি জানতেন যে, অভিজাতদের আশা-আকাক্সক্ষাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ফলে তিনি দৃঢ়তার সাথে চল্লিশচক্র বা তুর্কান-ই-চাহেলগানীর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন, তাদের অস্তিত্ব প্রায় লোপ করে দেন। তাদের বদলে তরুণ তুর্কিদের ক্ষমতায়ন করেন।

তিনটি বিষয়ে তিনি সতর্ক ছিলেন সব সময়। সেগুলোর উৎসমুখ বন্ধ করে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। বিষয়গুলো হচ্ছে:
(ক) রাজা ও অভিজাতদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পুরানো গল্পের পুনরাবৃত্তি।
(খ) তার মৃত্যুর পর রাজ্যের জন্য তার পুত্র এবং তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
(গ) সীমান্ত অঞ্চলে তুর্কি রাজকুমারদের ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার। এই সব সমস্যা সমাধানে কঠোরতা ছিলো তার প্রধান পদ্ধতি। ইলতুতমিশের বংশধরদের মৃত্যু হতে থাকলো একেরপর এক। আর অভিজাতদের কোনো অন্যায় পাওয়া গেলেই চরম শাস্তি প্রদান করে সুলতানের চূড়ান্ত কর্তৃত্বের তত্ত্ব জাহির করা হতো। বাদাউনের শাসক মালিক বারবক নিজের কৃতদাসকে হত্যা করেছিলেন। এর কঠোর শাস্তি তাকে ভোগ করতে হলো প্রকাশ্য জনসভায়। অযোধ্যার গভর্নর হায়বৎ খাঁ মদ্যপ অবস্থায় চাকরকে খুন করলেন। তাকে পাঁচ শত বেত্রাঘাত করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রাখা হলো। নিহত ব্যক্তির বিধবাকে রক্তপণ দিয়ে সন্তুষ্ট করার আদেশ দেয়া হলো। তাকে লাঞ্ছিত করা হলো জনতার সামনে। অপমানে জর্জরিত হায়বৎ খাঁ আর কখনো জনতার সামনে হাজির হননি। অযোধ্যার গভর্নর আমির খাঁ ছিলেন চল্লিশচক্রের অন্যতম প্রধান। তিনি বাংলায় বিদ্রোহদমনে ব্যর্থ হলেন। অযোধ্যায় যখন ফিরলেন, তাকে শহরের প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দেওয়া হলো। অপরাধ পাওয়া গেলে অভিজাতদের মৃত্যু ও মর্যাদাহানির মাধ্যমে বলবন তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতাকে দমন করেন। অপরদিকে বিচারবিভাগের শক্তি ও কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করেন। বলবন জানতেন ন্যায়বিচার হচ্ছে সাম্রাজ্যের রূহ। এর অনুপস্থিতে প্রশাসন হয়ে উঠবে একটা লাশ। বিচারের প্রশ্নে কোনো পক্ষপাতকে তিনি সহ্য করতেন না। অভিজাতরা ইলতুতমিশের পরে এই প্রথমবার আইনের চাবুককে নিজেদের মাথার উপর প্রত্যক্ষ করলো। বলবনের এ ন্যায়বিচার অবশ্য নিরঙ্কুশ ছিলো না। বারাণী লিখেছেন, সাধারণক্ষেত্রে বলবন ন্যায়বিচারের চেষ্টা করলেও, কখনো কখনো তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি ন্যায়বোধ তোয়াক্কা করতেন না।

ছেলে মুহাম্মদের সাথে বলবনের দীর্ঘ আলাপ নথিভুক্ত করেছেন বারানি। এমন আলাপ বুগরা খানের সাথেও রয়েছে। উভয় আলাপে শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়।
বলবনের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং প্রশাসনিক নীতিগুলি এর মধ্যে চিত্রিত। এর সারসংক্ষেপ হলো:
(১) ক্ষমতাবানদের দ্বারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিরক্ষামূলক আইন প্রণয়ন করা উচিত। গরিবদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
(২) সংযম সরকারের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। জনসাধারণের সাথে আচরণ করা উচিত ভারসাম্যসহকারে। কঠোরতা চলবে না। কোমলতাও চলবে না। জনগণের কর এত বেশি হওয়া উচিত নয়, যা তাদেরকে দরিদ্র ও অসহায় করে তুলবে। এতো অল্প কর উচিত নয়, যা জনগণকে বিদ্রোহী ও স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে ছাড়বে।
(৩) সরকারের উচিত জনগণের চাহিদা পূরণ করা। এজন্য অর্থনৈতিক সক্ষমতা দরকার। সরকারকে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
(৪) সরকারের আদেশ কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সরকারের সিদ্ধান্তগুলো হবে স্থিরচিত্ত। তাকে বারবার বদলানো যাবে না।
(৫) রাষ্ট্রের অর্থের সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। প্রতি বছর আয়ের মাত্র অর্ধেক ব্যয় করতে হবে এবং বাকি অর্ধেক জরুরি অবস্থায় জনগণের সঙ্কট মোকাবেলার জন্য রাখা উচিত।
(৬) সরকারকে ব্যবসায়ীদের সচ্ছল ও সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতে হবে।
(৭) সৈন্যদের বেতন কঠোর ও যথাযথভাবে প্রদান করা উচিত এবং সেনাবাহিনীকে সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ রাখতে হবে।
এসব মৌলিক নীতি ও কাঠামোর উপর একটি শক্তিশালী ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন বলবন।
বারানীর মতে, বলবনের এই নীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো মানুষকে শান্তি ও ন্যায়বিচার দিয়েছে, যা মানুষের পরম আকাক্সক্ষা। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড