খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-১
১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সাইয়েদ মুহম্মদ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. (১১৭৩-১২৩৫ খ্রি.) ছিলেন দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ধর্মপ্রচারক ও সুফি সাধক। ‘কুতুবুল আকতাব’ ছিল তাঁর উপাধি। চিশতি তরিকা শুধুমাত্র আজমীর এবং নাগাউরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিল্লীতে স্থায়ীভাবে এই তরিকা প্রতিষ্ঠায় তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বংশলতিকা হযরত হোসাইন ইবনে আলী রা.-এর মাধ্যম হয়ে হযরত মুহম্মদ সা.-এর সাথে মিলিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. ধর্ম, বর্ণ ও জাত নির্বিশেষে মানুষের উপর প্রচÐভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। মানবসেবা, সম্প্রীতি ও ক্ষুধার্তকে অন্নদান ছিল তাঁর জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি রাজদরবারের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার নীতি অনুসরণ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার চিশতিয়া তরিকার সাধকরা মনে করেন, শাসকগোষ্ঠীর এবং সরকারের সাথে সখ্য গড়ে উঠলে তাদের দুনিয়াবি চিন্তা ও পার্থিব ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারে।
খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. সবসময় মজলিসের আয়োজন করে তরিকতের গোপন রহস্যতত্ত¡ নিজ শিষ্যদের কাছে উন্মোচিত করতেন। মজলিসে যেসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হতো সেগুলো হলো- আত্মত্যাগ, বাসনাশূন্য প্রেম, আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস, পবিত্র কুরআনের বিধিবিধান অনুশীলন, সুন্নাতে রাসূলের পায়রবী, সব মানুষের সাথে একইরূপ আচরণ ও যথাসম্ভব দুস্থদের সাহায্য। তাঁকে মানুষ যেসব অন্ন-বস্ত্র হাদিয়া দিতেন, তিনি সে দিনই ওইসব মানুষের মাঝে দান করে দিতেন। প্রতিদানের আশা না করে অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করার আদর্শকে সারাজীবন ধারণ করেন তিনি। সবশ্রেণির মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন কোমল, দয়ার্দ্র ও ¯েœহপ্রবণ। বেদনাক্লীষ্ট ও দুঃখী মানুষদের প্রবোধ ও আশার বাণী শোনাতেন তিনি।
ইতিহাসবিদ ইয়াকুত হামুভী লিখিত মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. মধ্যএশিয়ার পরগনার আউশ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কামালুদ্দীন। তাঁর দেড় বছর বয়সে বাবা ইন্তেকাল করলে মা তাঁকে লালন-পালন করেন। পাঁচ বছরে উন্নীত হলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শাইখ আবু হিফস আউশীর কাছে পাঠান। পবিত্র কুরআন হিফয শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ গমন করেন। সেখানকার বড় বড় আলিমের কাছে তিনি কুরআন, হাদিস ও ফিকহে ইসলামীর ওপর পড়াশোনা করে ইলমে জাহেরিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. সফরের এক পর্যায়ে যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার রহ. তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। অতঃপর ২০ বছর যাবত তিনি তাঁর মুর্শিদে কামিলের সাহচর্যে অবস্থান করে আত্মশুদ্ধি অনুশীলনে ব্যাপৃত থাকেন। পবিত্র হজব্রতও তাঁর সাথে পালন করেন। বাগদাদে ফকিহ আবুল লাইছ সমরকন্দীর বরকতময় মসজিদে বহু বিখ্যাত আলিম ও শায়খদের উপস্থিতিতে হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. তাঁকে খিলাফত প্রদান করেন এবং সাথে করে দিল্লী নিয়ে আসেন (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, তারিখে দাওয়াত ওয়া আযীমত, ৩খÐ, করাচী, ১৯৮৩, পৃ.৩১)।
মুুর্শিদ হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. কর্তৃক তাঁকে দিল্লী আসার নির্দেশ প্রদানের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দিল্লী ছিল মুসলমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। প্রথমত, ভারতে ইসলামের সঠিক বাণী ও আদর্শ প্রচারের প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, শান্তি ও উদারতার নীতি অবলম্বন করে হিন্দুসমাজকে তাওহীদের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব সর্বোপরি রূহানী জিন্দেগীর দাওয়াত পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিল। এ দু’বুযুর্গের দ্বারা চিশতীয়া তরিকার মাধ্যমে হিন্দুদের সাথে সহনশীলতা ও উদারতার এক বৈপ্লবিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং ¯েœহ-মমতা ও ন¤্রতার দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করা সম্ভব হয় (ড. আবদুল জলীল, ইসলামী বিশ্বকোষ, ৮ম খÐ, পৃ.৩১৬)।
দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ খাজা বখতিয়ার কাকী রহ.-কে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতেন। তিনি সপ্তাহে দু’বার খাজা সাহেবের খানাকায় যেতেন। সুলতান ইলতুৎমিশ খাজা কাকী রহ.-কে বহু ধনসম্পদ ও জায়গীর দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। মালিক ইযযুদ্দীনের মসজিদের পাশে একটি ছোট্ট খানাকা তৈরি করে ইবাদতে মশগুল থাকতেন তিনি। দরবেশী ও অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর পছন্দ। দিল্লীর সর্বস্তরের মানুষ সর্বদা তাঁর খানাকায় ভিড় জমাতে থাকায় তৎকালীন শায়খুল ইসলাম শায়খ নাজমুদ্দীন ছোগরা রহ. মনোকষ্টে ভোগেন। হযরত খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. আজমীর থেকে দিল্লী তাশরিফ আনলে শায়খ নাজমুদ্দীন ছোগরা রহ. তাঁকে খাজা কাকী রহ.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. তাঁর শিষ্য খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-কে বলেন, ‘বাবা বখতিয়ার, এত তাড়াতাড়ি তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করেছ, আল্লাহর বান্দাদের মনে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি হয়েছে। দিল্লী ছেড়ে চলে এসো। আজমীর থাকো। তোমার খিদমতের জন্য আমি প্রস্তুত থাকবো।’ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. বলেন, ‘হে আমার শায়খ, আপনার সামনে বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোর যোগ্যতাও আমার নেই’ (তারিখে ফেরেশতা, ২খÐ, পৃ.১৯,৭২০; সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ৫৪)।
খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. আপন মুর্শিদের সাথে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দিল্লীর হাজার হাজার ভক্ত অনুরক্ত তাঁর পেছনে পেছনে জমায়েত হতে থাকেন। সুলতান ইলতুৎমিশও যাত্রায় শরিক হন। বখতিয়ার কাকী রহ.-এর কদম যেখানে পড়ছে সাধারণ মানুষ সেখানকার মাটি তুলে নিচ্ছেন বরকত মনে করে। চারদিকে বিদায়ের বিষাদে কান্নার রোলÑ এ অবস্থা দেখে খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. বলেন, ‘বাবা বখতিয়ার, তোমার বিদায়ে এতগুলো মানুষের অন্তরে কষ্ট দেখে আমি অভিভূত। তাঁদের মনে কষ্ট দিয়ে তোমাকে আজমীর নিয়ে যাওয়া আমি জায়েয মনে করি না। যাও দিল্লী শহর তোমার যিম্মায় দিয়ে দিলাম। আমি আজমীর চললাম’ (সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ৫৫)।
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড