ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান আলাউদ্দীন খিলজি : যুগনায়ক-৬
০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
ভারত মুসলিম শাসক হিসাবে তিনিই সর্বপ্রথম ভূমি জরিপব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রের কাজের জন্য ঘোড়াকে চিহ্নিত করার প্রথা প্রবর্তন করে তিনি সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান দুর্নীতি দমন করেন। আলাউদ্দীন খিলজির অর্থনীতিতে প্রতিটি দ্রব্যের উৎপাদনমূল্য, কৃষকের প্রয়োজন ও ভোক্তার বাস্তবতা বিচার করে দাম স্থির করা হতো। কোনো কারণে খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে মানুষ যাতে বিপদে না পড়ে, সেজন্য প্রতিটি শহরে শস্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়। উৎপাদনকারীর কাছ থেকে ১০ মণের অধিক খাদ্যশস্য নির্ধারিত মূল্যে কিনে নিতো সরকার। দুর্ভিক্ষ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় রেশনিং প্রথার প্রবর্তন করা হয়। দুর্যোগে যদি কোনো পণ্যের সরবরাহ কমে যেতো, আলাউদ্দীনের সরকার গুদাম থেকে সেই পণ্য সরবরাহ করতো জনগণকে। ভারতে এ প্রথা এর আগে ছিলো না কখনো। তার আগে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন ছিলো না। তাদেরকে বরং জমির জায়গির দান করা হতো। আলাউদ্দীন এই জায়গির ব্যবস্থা বাতিল করেন। সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট বেতন চালু করেন। এর পরিমাণও ছিলো পর্যাপ্ত।
আলাউদ্দীনের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কখনোই কোনো শ্রেণীকে অতিরিক্ত সুবিধা পেতে দেয়নি। আর গরিবদের জন্য কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসকে কখনো নাগালের বাইরে নিয়ে যায়নি। আলাউদ্দীন বলতেন, আমার আদেশ জারির মূলনীতি দুইটি; এক. যা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল, দুই. জনগণের জীবন-জীবিকা ও জরুরি অবস্থার জন্য যা আবশ্যক। গোটা সাম্রাজ্যে তিনি মদপান নিষিদ্ধ করেন। এমনকি মদ উৎপাদনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তার সময়ে ভারতে ব্যভিচার আর ‘বিকৃত যৌনাচার’ সমকামিতা নিষিদ্ধ করা হয়।
মৃত্যুর ক’বছর আগে বিজয়ের স্মারক হিসেবে কুতুব মিনার চত্বরে আলাই মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন খিলজি। তিনি চাইতেন এটা হবে সর্বোচ্চ মিনার, যার উচ্চতা হবে কুতুব মিনারের দ্বিগুণ। তবে ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুতে মাত্র ৮০ ফুট নির্মাণের পরেই এটি পরিত্যক্ত মিনারে পরিণত হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস তার শাসনামলের বিরাট সাফল্য। তিনি রাজস্ব আদায়কারী যুথ, মুকাদ্দাম ও চৌধুরীদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের পৃষ্টপোষক হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজির ছিলো বিশেষ খ্যাতি। মহাকবি আমির খসরু ছিলেন তার উপদেষ্টা, সভাকবি।
আলাউদ্দিন কি হিন্দুনির্যাতন করতেন? জবাব দিয়েছেন ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ। লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন হিন্দুদের অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছিলেন বলে যে কথাটি মশহুর, তা সত্য নয়।’ তাহলে জিয়াউদ্দীন বারানির আশ্রয় নিয়ে যখন বলা হয়, হিন্দুদের তিনি পীড়া দিয়েছেন, তার মানে কী? জবাব পেতে পারি ইরফান হাবিবের জবানিতে। তিনি লিখেছেন, ‘বারানি যেখানে হিন্দু কথাটার ব্যবহার করেছেন, সেখানে তিনি বুঝিয়েছেন যুথ, মুকাদ্দাম আর চৌধুরীদের। তারা ছিলো অত্যন্ত বলবান শ্রেণী। রাজনীতির দরকারে এদেরকে দুর্বল করার জরুরত ছিলো।’ প্রকৃতপক্ষে সবল ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর ক্ষমতাকে সীমিত করতে চেয়েছেন খিলজি। ফলে তার কঠোরতার শিকার যেমন হয়েছে হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষ, তেমনি মুসলিম অভিজাতশ্রেণী। তিনি উপেক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সুবিধার দরোজা খুলে দিতে চেয়েছেন। বিশেষত এর সুফলভোগী ছিলো স্থানীয় সাধারণ হিন্দু-মুসলমান। তার প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দুই সম্প্রদায়ের মিথস্ক্রিয়া ঘটে।
দাবি করা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তিনি চাপিয়ে দেন অতিরিক্ত নতুন কর। কিন্তু এর পক্ষে শক্তিশালী কোনো প্রমাণ নেই ইতিহাসে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা চ্যালেঞ্জ তীব্র হয়ে উঠায় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর জরুরত বেড়ে যায়। তাদের ব্যয়ভার বহনের জন্য নতুন করনীতি আরোপ করা হয়। এটা কেবল হিন্দুদের জন্য ছিলো না, ছিলো সকল সম্পদায়ের জন্য। তার উদ্ভাবিত সেই করব্যবস্থা বিগত শতক অবধি প্রচলিত ছিলো।
আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামল বিচ্ছিন্ন ভারতকে দেয় একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তা, যার উপর তার ভৌগোলিক ও ঐতিহ্যিক সংহতি নিশ্চিত হয়। ইতিহাসবিদ রুচিরা শর্মার দাবি, আলাউদ্দিন খিলজি ভিলেন তো ননই, বরং সমগ্র ভারত তার কাছে ঋণী। তিনি ভারতের ঐক্য আনেন, বারবার মোঙ্গল আক্রমণ ঠেকিয়ে ভারতকে ধ্বংস থেকে বাঁচান। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা বলা যায় তাকে। তার আগে ভারত বলে রাজনৈতিকভাবে অখণ্ড কোনো সাম্রাজ্য ছিলো না। সেটা যেমন ছিলো না গৌতম বুদ্ধের সময়, তেমনি ছিলো না আঞ্চলিক রাজবংশসমূহের কালে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে কলিঙ্গ রাজার ‘ভারত’ ছিলো ক্ষুদ্র এলাকায় সীমায়িত সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে বর্ণিত জম্বুদ্বীপ ছিল অনেক ছোট এলাকা নিয়ে গঠিত। তারপরও অশোকের শাসনসীমানাকে বিস্তৃত মনে করা হয়। কিন্তু অশোকের পরে আলাউদ্দীন ছাড়া কে আছে এমন, যে বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত ভারতীয় জনপদসমূহকে একই সূতায় বাঁধতে পেরেছে? ভারতকে হিন্দুস্তান নাম দিলেন মুসলিমরা। আর ‘হিন্দুস্তান’ বন্দনাও শুরু হয় তাদের কলমে। কী কাব্যে, কী গদ্যে। গদ্যে এর শ্রেষ্ঠতম নজির আল বেরুনীর কিতাবুল হিন্দ। কাব্যে এর অনুপম নমুনা আমির খসরুর নুহ সিফির (১৩১৮)। মহাকবি আমীর খসরু গর্বের সাথে বলেন, হিন্দ হচ্ছে তার মাতৃভূমি, হিন্দ হচ্ছে তার নিবাস, হিন্দ হচ্ছে তার ওতন; স্বদেশ। ওতনকে তিনি ভালোবেসে যাবেন। কেননা তিনি জানেন, হুব্বুল ওতনি মিনাল ঈমান- দেশপ্রেম ঈমানের অংশ।
দিল্লীভিত্তিক একটি রাজ্যকে আলাউদ্দীন পরিণত করেন গৌরবময় বিশাল সাম্রাজ্যে। ইতিহাসে ন্যায়সঙ্গতভাবে তাকে ভারতের আলেকজান্ডার বলা হয়েছে। দখলদারিত্ব লাভ করে ব্রিটিশ শাসনাবসানের কালে ভারত দ্বিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তারই এক রাষ্ট্র হিসেবে বর্তমান ভারত বিদ্যমান। অপর রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নাম ধারণ করেছে। (সমাপ্ত)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ