ঢাকা   রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গিয়াসউদ্দীন তুঘলক : দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

তুঘলকাবাদের স্থাপত্য ও নগরপরিকল্পনা: তুঘলকাবাদে তিনি যে নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, সেটি ছিল চিত্তাকর্ষক এক স্থাপত্য কীর্তি। একটি সুপরিকল্পিত বিন্যাস ছিলো শহরে। একটি বিশাল দুর্গ একে পাহারা দিচ্ছিলো। দুর্গটি ছিলো উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এবং বেশ কয়েকটি চিত্তাকর্ষক গেটওয়ে এবং জলাধার ছিলো তাতে। তুঘলকাবাদের মহিমা ছিলো দিল্লী সালতানাতের উন্নয়নের বিঘোষক। এর সর্বত্রই ছিলো একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাজধানী প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। তুঘলাকাবাদ দুর্গটি সরিস্কা টাইগার রিজার্ভের সাথে সংযুক্ত, যা একটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলকে ঘিরে। এই দুর্গ এবং অভয়ারণ্যের আশেপাশে ছিল বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান। যেমন অনঙ্গপুর বাঁধ, সুরজকুণ্ড জলাশয়, বাদখাল হ্রদ, দমদমা হ্রদ ইত্যাদি।
পানিব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা: আগেই বলেছি, গিয়াসউদ্দীন তুঘলক খাল এবং অন্যান্য সেচ ব্যবস্থা নির্মাণে বিনিয়োগ করেছিলেন। এই প্রকল্পগুলি কৃষি উৎপাদনশীলতাকে উন্নত করে। কূপ নির্মাণ, গভীর জলাধার তৈরি, খাল খনন করে দুই নদীর সংযোগ, পানিসঙ্কটে জর্জরিত মরু অঞ্চলে পানি সরবরাহ ইত্যাদি কর্মসূচি কি আজকের সময়ের প্রয়োজনকেও প্রতিনিধিত্ব করছে না? তার পদক্ষেপসমূহ প্রজাদের জন্য একটি স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপরদিকে বন্যাপ্রবণ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ আর খরাপ্রবণ এলাকায় পানি সরবরাহ কর্মসূচি তুঘলকের সময়কে অতিক্রম করে পরবর্তী সময়ের সঙ্কটেরও সুরাহা দেয়।
যোগাযোগ ও সরাইখানা নির্মাণ: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বিখ্যাত কুতুব-বদরপুর রোড নির্মাণ করেছিলেন। যা তার নতুন রাজধানী শহরকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সাথে যুক্ত করেছে। এই রাস্তাটিকে আজ মেহরৌলি-বদরপুর রোড বলা হয়। প্রদেশে প্রদেশে বহু সড়ক তিনি নির্মাণ করেন। সড়কসমূহের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করেন সেনাচৌকি। বাণিজ্য ও ভ্রমণের সুবিধার জন্য সড়কের ধারে বহু সংখ্যক সরাইখানা বা ‘সেরাই’ নির্মাণ করেন তিনি। এইসব সেরাই ভ্রমণকারী এবং ব্যবসায়ীদের জন্য আশ্রয় বিধান করতো। তাদের নিরাপত্তা দিতো এবং আন্তঃবিনিময়ের ধারা তৈরি করতো। সরাইগুলো সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৪. সামরিক অভিযান: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক শুধু একজন প্রশাসকই ছিলেন না, একজন সামরিক কৌশলবিদও ছিলেন। তিনি তার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার জন্য বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযানের মধ্যে রয়েছে:
খসরু খানের বিরুদ্ধে অভিযান: খসরু খানের সাথে মোকাবিলা করা ছিলো তার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ। খসরুর অধীনে এক সময় তিনি সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। খসরু খান এর আগে খিলজি রাজবংশকে উৎখাত করে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই শাসন ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলায় ছিলো জেরবার। গিয়াসউদ্দীন তুঘলক সফলভাবে খসরু খানকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করেন, যার ফলে সুলতান হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন।
দক্ষিণ ভারতে অভিযান: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে সালতানাতের প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী ছিলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন। মাদুরাই অঞ্চলে বিজয় সম্পন্ন করেন। উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য তার প্রচেষ্টা পরবর্তী তুঘলক রাজবংশকে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে গভীরভাবে যুক্ত করে।
মধ্য এশিয়ায় অভিযান: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক মধ্য এশিয়ায় সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে তার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো এমন সব এলাকায় আধিপত্য নিশ্চিত করা, যা ঐতিহাসিকভাবে দিল্লী সালতানাতের অংশ ছিল। এই অভিযানগুলো সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। তবে তা পুরোপুরি ব্যর্থও হয়নি। অভিযানগুলো তার উচ্চাকাক্সক্ষা এবং তার শাসন সম্প্রসারণের লক্ষ্যকে প্রচার করেছিল।
৫. চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরাধিকার: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক তার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তুঘলকাবাদের মতো উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো রাজ্যের সম্পদ এবং শ্রমশক্তির উপর একটি ভারী বোঝা চাপিয়েছিল। দাক্ষিণাত্য ও মধ্য এশিয়ায় সম্প্রসারণবাদী নীতি ছিল ব্যয়বহুল প্রচেষ্টা।
কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ছিল মোঙ্গল আক্রমণের হুমকি। তরমাশিরিন খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা ভারতীয় উপমহাদেশে একাধিক অভিযান চালায়। এই আক্রমণগুলি তুঘলক রাজবংশের শাসনের স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছিল। গিয়াসউদ্দীন এর মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকেন। গিয়াসউদ্দীন তুঘলক ১৩২৫ সালে মারা যান।
তার রাজত্বকে উল্লেখযোগ্য উচ্চাকাক্সক্ষা ও সংস্কারের সময় হিসেবে দেখা যায়। তার প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সামরিক অভিযান সালতানাতের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। রাজস্ব সংগ্রহে স্থিতিশীলতা আনতে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা উন্নত করতে তার প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মঙ্গলকে নিশ্চিত করে।
সংগঠিত শহর এবং অবকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের জন্য মঞ্চ তৈরি করে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৪
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
আরও

আরও পড়ুন

কুরস্কে ৪০ শতাংশ এলাকার দখল হারিয়েছে ইউক্রেন

কুরস্কে ৪০ শতাংশ এলাকার দখল হারিয়েছে ইউক্রেন

আমরা জমিদার নই,মানুষের পাহারাদার : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমরা জমিদার নই,মানুষের পাহারাদার : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাসের কাছে গুলি, বন্দুকধারী নিহত

জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাসের কাছে গুলি, বন্দুকধারী নিহত

ট্রাম্পের জয়ের পর ইলন মাস্কের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে

ট্রাম্পের জয়ের পর ইলন মাস্কের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে

ভয়াবহ তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য, বহু ফ্লাইট বাতিল

ভয়াবহ তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য, বহু ফ্লাইট বাতিল

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ১২০ ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ১২০ ফিলিস্তিনি

ইভেন্টের  সেরা লড়াইটি উপহার দিলেন আফরা-সানজিদা

ইভেন্টের সেরা লড়াইটি উপহার দিলেন আফরা-সানজিদা

ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান পাহাড়ের পর জয়-জাকিরকে হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান পাহাড়ের পর জয়-জাকিরকে হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা