মুহম্মদ বিন তুঘলক : কালের চেয়ে অগ্রসর-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের মৃত্যুর পর সুলতান হলেন তার জেষ্ঠ্যপুত্র ফখরউদ্দীন মুহম্মদ জুনা খান। মুহম্মদ বিন তুঘলক উপাধি গ্রহণ করে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাসীন হন তিনি। তার শাসন অব্যাহত থাকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ অবধি; দীর্ঘ ২৬ বছর।

শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও আকর্ষণীয়। প্রতিভার অনন্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শিতা, ধর্মীয় ও জাগতিক পা-িত্যে অসাধারণ গভীরতা, বিভিন্ন ভাষায় সুনিশ্চয় দক্ষতা, শিল্প-সাহিত্য, সংগীত ও নন্দনতত্ত্বে বৈদগ্ধ, দর্শন, গণিত, ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোলবিদ্যায় পারঙ্গমতা, রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদিতে অন্তর্দৃষ্টি তাকে করে তোলে বিরল ও নজিরবিহীন এমন শাসক, যিনি পলিম্যাথিক বৈশিষ্ট ধারণ করেন। সমকালে কোনো বিদ্বান বা বিশেষজ্ঞ তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাহস করতেন না। পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে বিশাল এক সাম্রাজ্য লাভ করেন তিনি। শাসনকাজে ব্যস্ত থাকতেন সারাদিন। কিন্তু রাত হলেই বালাখানার ছাদে মহাকাশ নিয়ে মগ্ন থাকতেন। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন। একদিকে তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিজ, অপরদিকে অন্যান্য ধর্মের গ্রন্থাবলীতেও ছিলেন বিশেষজ্ঞ। উদার ছিলো তার শাসননীতি। হিন্দুদের দিয়েছিলেন ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা। উচ্চপদে তাদের আসীন করেন। হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা দূর করতে সক্রিয় হন। কিন্তু ধর্মরক্ষায় হিন্দু বিদ্রোহের বাস্তব ভীতি তাকে পিছু হটালেও হিন্দু সমাজের অগ্রসর একটি শ্রেণীর মধ্যে এই প্রথা উচ্ছেদের আগ্রহ বিস্তারে সক্ষম হন। জিয়াউদ্দীন বারানি, আবদুল কাদির বাদাউনী প্রমুখের বয়ানে উঠে এসেছে তার প্রজাবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির কথা। প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাকাবি প্রকল্প গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হতো তাদের। দুর্ভিক্ষকালে সহায়তার জন্য ছিলো বিশেষ প্রকল্প। রাজকোষ থেকে তখন সাহায্য বরাদ্দ করা হতো অঞ্চলে অঞ্চলে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে আয়-ব্যয়ের সকল হিসাব যথাযথভাবে সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলকেও আয়-ব্যয়ের রিপোর্ট জমা দিতে হতো প্রশাসনে। হতো শক্ত-কঠোর অডিট। আদল বা ন্যায়বিচার না থাকলে সুশাসন অসম্ভব, এটা তিনি প্রচার করতেন জোরালোভাবে। ন্যায়বিচারের শর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষতা। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, সামাজিক অবস্থান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধনী-গরীব, আমির-ফকির ইত্যাদিতে ন্যায়বিচার বিভাজিত হতে পারে না। ন্যায় সবার প্রশ্নে একই দৃষ্টি পোষণ করে। এখানে ইনসাফ না থাকলে ন্যায়ের দাড়িপাল্লা জুলুমের পরাকাষ্ঠায় পরিণত হবে। এই প্রতীতি প্রগাঢ় ছিলো তার মধ্যে। ন্যায়বিচারক হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন ন্যায্য কারণেই। অপরাধীদের জন্য তিনি ছিলেন বজ্রকঠোর, আবার সুনাগরিকদের প্রতি দয়ালু ছিলেন, সদাশয় ছিলেন। জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত মানুষের জন্য তার শাসনকাল ছিলো সুখকর। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও বৈদগ্ধের চর্চাকে তিনি শুধু সহযোগিতা করতেন না, বরং সম্মান জানাতেন অকুণ্ঠচিত্তে। তার দৃষ্টি ছিলো দূরদর্শী। যুগের চেয়ে অগ্রসর ছিলো তার প্রকল্পগুলো, যার অনেকটাই তখনকার বাস্তবতায় ব্যর্থ হয়। কিন্তু এর আবেদন ও অর্থবহ প্রভাব পরবর্তী যুগগুলোকে পথপ্রদর্শন করেছে।

তার কৃতিত্বের আসল ক্ষেত্র হলো শাসনকর্ম। অনেকগুলো ক্ষেত্রে তিনি সংস্কার সম্পন্ন করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. প্রশাসনিক সংস্কার:
(ক) টোকেন কারেন্সি: তার অন্যতম প্রধান সংস্কার ছিল টোকেন কারেন্সির প্রবর্তন। মজুতদারি রোধ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তিনি রৌপ্য মুদ্রার সমান মূল্যের তামার মুদ্রা প্রবর্তন করেন। এর বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং অবশেষে অর্থনৈতিক ব্যাঘাত ঘটায়।

(খ) রাজধানী স্থানান্তর: মুহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের দেবগিরিতে (বর্তমানে দৌলতাবাদ) রাজধানী স্থানান্তর করেন। তিনি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলেন এবং মঙ্গোল আক্রমণের বিরুদ্ধে স্থায়ী সুরক্ষার উপায় সন্ধান করছিলেন। কিন্তু সেকালের বাস্তবতায় জনগণের ব্যাপক স্থানান্তর অসুবিধার সৃষ্টি করে। জনগণের প্রতিবাদে পরিকল্পনাটি পুরোপুরি সফল হয়নি।

২. সামরিক অভিযান:
(ক) সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ: তিনি সালতানাতের সীমানা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। এজন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তার বিজয় দাক্ষিণাত্য, বাংলা এবং দক্ষিণ ভারতের বড় অংশকে একই রাষ্ট্রসীমায় নিয়ে আসে।

(খ) প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা: মুহম্মদ বিন তুঘলক মঙ্গোল আক্রমণের বিরুদ্ধে উত্তর সীমান্ত রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেনাদের প্রশিক্ষিত করা, উন্নত যুদ্ধকৌশল রপ্ত করা, তাদের নৈতিক মান বৃদ্ধি এবং যুদ্ধনৈপুণ্য বৃদ্ধিতে তিনি জোর দেন। সামরিক প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজান। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য তার উদ্বেগ থেকে শক্তিশালী পদক্ষেপের জন্ম হয়।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড