মুহম্মদ বিন তুঘলক : কালের চেয়ে অগ্রসর-৩

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

তুঘলকের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয় যে, তিনি উদ্ভট মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। রাজধানী স্থানান্তর ও অন্য কিছু পরিকল্পনা এর পক্ষে দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দিল্লীর আলিম, অভিজাত ও রাজকীয় কর্তাদের তিনি আদেশ করেন নতুন রাজধানী দৌলাতাবাদে যাওয়ার জন্য। তিনি কি এটা করেছিলেন সবার উপর নিজের দাপট প্রদর্শনের জন্য? মোটেও তা নয়। তিনি চেয়েছিলেন দৌলাতাবাদ হয়ে উঠুক একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দ্বিতীয় রাজধানীর ধারণাকে তিনি নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রশাসনব্যববস্থাপনার প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণও ছিলো এর একটি উদ্দেশ্য। যদিও এ প্রকল্পে অনেক খরচ হয়, কষ্ট ও জটিলতায় পড়তে হয় মানুষকে, অনেকেই যাত্রাপথে মারা যায়, কিন্তু এটা ঠিক নয় যে, দিল্লীর মানুষকে শাস্তি দেবার জন্য তিনি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যে সব গ্রন্থে প্রচার করা হয়েছে, তুঘলক অন্ধ ও খঞ্জদের জোর করে দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে নিয়েছেন, কুকুর-বিড়ালকেও রেহাই দেননি, সেসব গ্রন্থ চমকপ্রদ গুজবকেই ব্যক্ত করেছে মাত্র।

খোরাসান অভিযানের প্রশ্নেও এমনটি ঘটেছে। ট্রান্স অক্সিয়ানার আমির তারমাসিরিন খোরাসানের আমীর সোবহান কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তুঘলকের দরবারে এসে আশ্রয় নেন। সুলতান চাননি সেখানকার সমস্যায় জড়াতে। তিনি তারমাসিরিনকে শান্তনা ও আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু সোবহানের অত্যাচারে অতিষ্ট আমিররা একের পর এক হাজির হচ্ছিলেন তুঘলকের সমীপে। আমির নওরোজ ছিলেন তারমাসিরিনের জামাতা। তিনি তুঘলককে অনুরোধ করেন খোরাসানে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। মিশরের শাসকও একই অনুরোধ করেন। সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেন। মিশর থেকে এই অনুরোধ আসার মানে হলো খোরাসান সমস্যা বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছিলো তখন। এর ধাক্কা লেগেছিলো লাহোর-পাঞ্জাবের সীমান্ত অঞ্চলেও। তুঘলককে তাই বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। খোরাসানে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচার দমাতে তিনি অভিযান ঘোষণা করেন। তিন লাখ সত্তর হাজার সৈন্যের বাহিনী গঠিত হলো। কিন্তু খোরাসানে শাসক পরিবর্তন হয়ে গেলো এরই মধ্যে। নতুন শাসক হলেন সুলতান আবু সৈয়দ। তিনি মিশরের সাথে জটিলতার নিরসন করলেন। নৈরাজ্যের লাগামও টেনে ধরলেন। এ পরিস্থিতিতে তুঘলক তার অভিযান স্থগিত করলেন। বিচক্ষণতা ও কা-জ্ঞানের দাবি ছিলো এই অভিযানে আর অগ্রসর না হওয়া। সুলতান সেটাই করলেন। স্বেচ্ছাচারি হলে তিনি অভিযানটি সম্পন্ন করতে চাইতেন। বারানির মতে, এই অভিযানের প্রস্তুতি রাষ্ট্রের রাজস্বের সর্বনাশ করেছে। কিন্তু অভিযান হলে বিপুল রক্তপাত ঘটতো। রক্তপাত এড়ানোর মধ্যে দিয়ে তুঘলকের শান্তিকামী মানসিকতাই প্রকাশিত হয়। অপরদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে অনভিজ্ঞ প্রজাদের তিনি দক্ষ সৈনিক করে তুলেছিলেন। এটা ছিলো বড় এক অর্জন। ব্যাপারটিকে হটকারিতার নিদর্শন হিসেবে প্রচার করার মধ্যে বিচারশূন্য পরিহাস রয়েছে, ইতিহাস নেই।

তুঘলকের ব্যর্থ এক অভিযান তাকে সমালোচিত করেছে। হিমালয়ের ওপারে কুর্মাচলে বিদ্রোহী পাহাড়ীদের মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তারা সুলতানের সাথে কেবল বিদ্রোহ করছিলো, তা নয়, রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর তাদের নিপীড়ন চলছিলো, ডাকাতি, হত্যা ও অতর্কিত আক্রমণে তারা জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছিলো। তাদের দমন করা জরুরি এবং দায়িত্বটি রাষ্ট্রেরই। অতএব, সুলতান একটি বাহিনী পাঠালেন। দুর্গম ছিলো যাত্রাপথ। পাহাড়ি খাদ ও পিচ্ছিল গীরিপথে বাহিনীটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। বৈরী আবহাওয়া ও পরিবেশের হাতে পরাজিত হয় বাহিনীটি। প্রাণ হারান বিপুল সংখ্যক সৈন্য। এই প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য তো সুলতানকে দায়ী বানানো যায় না। কিংবা বাহিনী প্রেরণের জন্যও দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। বস্তুত সুলতান ও বাহিনী দুর্ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছিলেন।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড