খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-৩

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩ এএম

মাহবুবে ইলাহী হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া সম্পর্কে ইতোপূর্বে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে। গোটা ভারতে চিশতিয়া তরিকার প্রসারে তার পূর্বসূরীদের মতো তারও বিশাল অবদান রয়েছে। অবদান রয়েছে তার খলিফাদের। তিনি ছিলেন হযরত খাজা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকরের প্রধান খলিফা। আর তার প্রধান খলিফা ছিলেন হযরত খাজা নাসির উদ্দীন চেরাগে দেহলবী। তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খলিফার মধ্যে কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি উল্লেখযোগ্য।

হযরত নিজাম উদ্দীন আওলিয়া সর্বোচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা ও তরিকা-তাসাউফের বিকাশ-বিস্তারে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার ও তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীদের চেষ্টা-শ্রম ও চারিত্রিক মাধুর্যে অগণিত অমুসলিম ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে জীবন ধন্য করেছেন। তার নির্দেশ মোতাবেক খলিফা ও মুরিদরা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন। শহরে, গ্রামে, প্রত্যন্ত এলাকায় খানকা ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে আধ্যাত্মিক চর্চা-সাধনাকে বুলন্দ করেন এবং ইসলামী শিক্ষার বিস্তার ঘটান। একই সঙ্গে হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া মানবসেবার এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মানুষের প্রতি তার এত ভালোবাসা, এত দরদ ছিল যে, মনে হতে পারে মানুষের সেবা ও কল্যাণই ছিল তার জীবনব্রত।

তার সুনাম-সুখ্যাতি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তার কাছে ছুটে আসতেন মুরিদ হওয়ার জন্য। তিনিও তাদের নিরাশ করতেন না। তাদের বায়াত গ্রহণ করতেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি এ সম্পর্কে লিখেছেন: সে সময় শায়খুল ইসলাম হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া বায়াত গ্রহণের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি পাপী-তাপী সবাইকে তওবা পড়িয়ে মুরিদ করতেন। এ ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, রাজা-ফকির, শিক্ষিত-মূর্খ, গ্রাম্য-শহুরে, মুক্ত ও দাস-দাসী ইত্যাদির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। তিনি সবাইকে টুপি ও মেসওয়াক দান করতেন। জিয়াউদ্দীন বারানি আরো লিখেছেন: সবাই যেহেতু নিজেদের শায়খের মুরিদ ও খেদমতগার মনে করতেন, সেহেতু তারা পাপ ও অনৈতিকতা থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকার চেষ্টা করতেন। ভুলক্রমে বা অনিচ্ছা সত্তে¡ কেউ কোনো পাপ বা অপরাধ করলে নতুনভাবে বায়াত হয়ে খেরকা গ্রহণ করতেন। এরা তার মুরিদ হওয়ার কারণে গোপনে কোনো পাপ করতেও লজ্জিত হতেন। তখন বিশেষ-অবিশেষ সব শ্রেণী-পেশার লোক নেক কাজের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা, গোলাম-মনিব সবাই নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। তার অধিকাংশ মুরিদ চাশত ও ইশরাকও পড়তেন।

প্রতিদিন কত মানুষ যে তার সান্নিধ্য লাভ ও মুরিদ হওয়ার জন্য আসতেন, সে বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায় জিয়াউদ্দীন বারানির পরবর্তী কথায়। তিনি লিখেছেন: গিয়াসপুরের প্রবেশমুখে এবং গিয়াসপুরমুখী পথে পথে তখন ছাদ বিশিষ্ট বহু চত্বর নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে বিছানা ছিল। বহু কূপ খনন করা হয়েছিল। মটকা ভরা পানি ছিল। মাটির লুটাবাটিও ছিল। সহজে ওজু- গোসল করার ভালো ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক চত্বরে একজন করে হাফেজ ও খাদেম ছিল। তারা মুরিদ হওয়ার জন্য আগতদের নিয়ে ওয়াক্তমতো নামাজ আদায় করতেন। (তারিখে ফিরোজশাহী)।

পীর-আওলিয়া ও সুফী-সাধকদের স্বভাব এই যে, তারা নির্জনে থাকা পছন্দ করেন। নিজেদের যতটা সম্ভব গোপন রেখে ইবাদত-বন্দেগি করতে ভালোবাসেন। এটা অবশ্য অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। পীর-আওলিয়া ও সুফী সাধকগণ সাধারণত সুলতান, স¤্রাট বা শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক করা, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করা পছন্দ করেন না। হযরত খাজা নিজাম উদ্দীনও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার প্রিয় মুরিদ হযরত আমির খসরু এ সম্পর্কে বলেছেন: তিনি শুরুর দিকে লোক সমাগম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। তখন তিনি গিয়াসপুরে বসবাস করতেন। সেখানে লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় তিনি অন্যত্র যেতে চাইলে অনেকেই বাধা হয়ে দাঁড়ান। তারা অনুনয়-বিনয় করে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি সেখানেই থেকে যান।

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড