ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

লোদি বংশ : বেলাশেষের আলো-৬

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

ইবরাহীম লোদির লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেও তিনি জয়লাভ করেন। বাবর এই যুদ্ধে তুলুগুমা ও আরাবা নামক নতুন কৌশল ব্যবহার করেন। তুলুগামা হলো পুরো সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত করা। বাম, ডান এবং মাঝখানে আলাদাভাবে রাখা।

এতে শত্রুপক্ষকে একটি ছোট বাহিনী ব্যবহার করেই চারদিক থেকে ঘিরে রাখা সম্ভব। আরাবা কৌশলে সেনাদলের মধ্যভাগের সম্মুখ অংশে গরুর গাড়ি (আরাবা) স্থাপন করা হয়। এগুলোকে দড়ি দিয়ে যুক্ত করে রাখা হয়। এসব গাড়ির পিছনে স্থাপন করা হয় কামান। কৌশলে অগ্রবর্তিতার পাশাপাশি বাবর দিল্লীর আমীরদের সহায়তা লাভ করেন নানাভাবে। গোয়েন্দা তথ্যে অগ্রসর হবার ফলে তিনি কৌশল নির্ধারণ করতে পারতেন সহজেই। পানিপথের যুদ্ধে ইবরাহীম লোদির পতন হলো। তিনি নিহত হলেন, অধিকাংশ সেনাপতি ও রাজ্যপ্রধান নতুন শাসনকে মেনে নিতে থাকলো। অবসান নিশ্চিত হলো লোদি রাজবংশের, সাথে সাথে দিল্লী সালতানাতের।
লোদি রাজবংশ ধীর ও নম্র পদক্ষেপে নিজেকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলো। তারপর ক্রমেই সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সমৃদ্ধ পদচ্ছাপ নিশ্চিত করেছিল। তাদের শাসন ছিলো সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক পরিমার্জন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আঞ্চলিক বিস্তৃতির এক অধ্যায়।

শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীভূত শাসনের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাহলুল লোদি। চতুর কূটনীতি, সামরিক দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী নীতির মাধ্যমে ক্ষমতাকে একীভূত করেছিলেন সিকান্দার লোদি। তারা রাজবংশের স্থায়ী শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

রাজনৈতিক সংস্কার এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধতা এই রাজবংশের বিশেষ দিক। এই বংশের সুলতানরা আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে সুবিন্যস্ত করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, শাসন বৃদ্ধি করেছিলেন এবং মেধাতন্ত্রকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। মেধা-ভিত্তিক সিভিল সার্ভিস সিস্টেম বাস্তবায়ন করেছিলেন সিকান্দার লোদি, যা স্বজনপ্রীতির বদলে দক্ষতাকে পুরস্কৃত করতো। এই সংস্কার বিভিন্ন পটভূমির প্রতিভাবান ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছিলো প্রশাসনে, যা একটি যোগ্য এবং নিবেদিত প্রশাসনিক যন্ত্রকে গতিশীল করেছিল।

লোদি রাজবংশ ন্যায়সঙ্গত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখে একটি সংহত আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। আইনি পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা সামাজিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে এবং সাম্রাজ্যের সংহতিকে জোরদার করে।

লোদি রাজবংশকে শিল্প, সাহিত্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের স্বর্ণযুগের সভাপতিত্বের আসন দেওয়া যায়। শিল্পকলা তখন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলো, বিকাশ লাভ করেছিল, যা সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনকে প্রাণাবেগ দান করে। সুলতান সিকান্দার লোদি ছিলেন শিল্পকলার একজন প্রখ্যাত পৃষ্ঠপোষক। বুদ্ধি ও নন্দন চর্চার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিত স্পন্সরে পরিণত হয়েছিলেন, যা একটি সমৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে বিকশিত করেছিলো। সাহিত্যিক কাজ, দার্শনিক গ্রন্থ এবং শৈল্পিক মাস্টারপিসগুলোর সাথে সাম্রাজ্য জড়িত ছিলো গভীরভাবে। আধুনিক সাংস্কৃতিক আলাপেও যার প্রভাব গভীর ও গতিশীল। এ রাজবংশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্থায়ী প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে আগ্রা শহর। এই সাম্রাজ্য রেখে গেছে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা এবং প্রকৌশলের মতো ক্ষেত্রে অগ্রগতির স্বাক্ষর। তখন পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, দক্ষ কৃষি কৌশল এবং নির্মাণকলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল।

লোদি রাজবংশের প্রকৌশলীরা বিস্তৃত রাস্তার নেটওয়ার্ক তৈরি করেন, উন্নত সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন, সাম্রাজ্য জুড়ে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং কৃষি উৎপাদনের সুবিধাকে বিস্তৃত করেন।
সামরিক বিজয় এবং আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ছিল লোদি রাজবংশের উত্তরাধিকারের প্রধান উপাদান। সুলতানরা ছিলেন দক্ষ সামরিক কৌশলবিদ, সফল অভিযানে নেতৃত্ব দেন তারা, যা সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত করেছিল এবং এর সীমানাকে সুরক্ষিত করেছিল।

এসব বিজয় শুধু সাম্রাজ্যের সীমানাকে প্রসারিত করেনি, বরং সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বাণিজ্য পথকেও সহজতর করেছে, সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করেছে। লোদি রাজবংশের যোগ্যতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার নীতিগুলি যে কোনো কালের উপযোগী ও প্রভাবশালী। প্রগতি, সংস্কৃতি এবং শাসনের আলোকবর্তিকা হিসাবে লোদি বংশের শাসন ইতিহাসে স্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে আছে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড