সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-৫

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১৭ মে ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১২:১১ এএম

আগ্রায় ফেরার পথে হুমায়ুনের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন শের খান। আফগান সৈন্যদের নিয়ে বিহারের বক্সার থেকে ১০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে চৌসা নামক স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়ালো। চৌসা অঞ্চল গঙ্গা আর কর্মনাশা নদীর মিলনস্থলের দক্ষিণে। উভয় নদীর মোহনার পাশে সংকীর্ণ স্থলভ‚মিতে বেকায়দায় অবস্থান করছিলো আফগানরা। তাদের দুই দিকে ছিলো নদী। আর হুমায়ুন ছিলেন কর্মনাশার অপর পাড়ে। বড় ও প্রসারিত জায়গায়। চাইলেই তিনি সামনে এগিয়ে আফগানদের ঘেরাও করতে পারতেন। দুই দিকের নদীপথে পালানো ছাড়া আফগানদের তখন উপায় থাকতো না। কিন্তু হুমায়ুন সময়ক্ষেপণ করলেন। এপ্রিল থেকে জুন অবধি তিন মাস শুধু শিবির গেড়ে অবস্থান করলেন। শের খান অপেক্ষা করছিলেন বৃষ্টির এবং সাহায্যকারী বাহিনীর। সাহায্যকারী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল মুসাহিব খান বা ছোট খাওয়াস খান।

তিন মাস সময় পেয়ে শেরখান ধীরে ধীরে শক্তি বাড়ালেন। আর হুমায়ুনের বাহিনীতে দেখা গেলো খাদ্যঘাটতি। পশুখাদ্যের অভাবে মারা যেতে লাগলো পশু। সম্রাট অপেক্ষা করছিলেন সাহায্যকারী সৈন্যদের। চুনার ও জৈনপুর থেকে তারা আসলো বটে, কিন্তু তাদের সাথে ছিলো না যথেষ্ট রসদ। নিদারুণ খাদ্যাভাবে সেনাবাহিনীর মনোবল পৌঁছে গেলো তলানিতে। রাজধানী থেকে রসদ আসার বদলে আসতে থাকলো বিপজ্জনক খবর। সেখানে বিদ্রোহ ও অস্থিরতা ছিলো ক্রমবর্ধমান। হিন্দাল বিদ্রোহ করলেন, কামরান মির্জা তা দমন করলেন। তারপর কামরান নিজেই চেপে বসলেন আগ্রার উপর। নিজের প্রদেশে তিনি ফেরত যাননি। থেকে গেছেন আগ্রায়।

এর মধ্যে চৌসায় ঘটে নানামুখী চতুর কর্মকাÐ। তা অবশ্য শের খানের তরফেই। তিনি হুমায়ুনকে শান্তির জন্য আলোচনায় প্রবৃত্ত করেন। চুক্তি হয় এবং সাহায্যকারী বাহিনী আসার পরে নিজেই তা ভঙ্গ করেন। বৃষ্টি শুরু হলে শের খান মুঘল বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি। প্রবল বৃষ্টিতে মোঘল শিবির পানিতে ভরে গেলো। এরই মধ্যে ১৫৩৯ সালের ২৬ জুন রাতের শেষ প্রহরে আফগান বাহিনীর কৌশলী আক্রমণের শিকার হলো তারা। ঘুমন্ত, অপ্রস্তুত মোঘলরা আফগানদের হাতে নিহত হন প্রচুর। হুমায়ুনের প্রায় ৮,০০০ সৈন্য ডুবে গেলো গঙ্গার প্লাবনে। শের খান দখল করলেন অস্ত্র-শস্ত্র, কামান-গোলাবারুদ। হারেমের নারীরাও হলেন বন্দি। শের খান তাদের সাথে সদয় আচরণ করেন এবং নিরাপদে তাদের দিল্লি ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নিজাম নামের এক ভিস্তিওয়ালার সাহায্যে সম্রাট হুমায়ুন জীবন রক্ষা করেন।

সেই সময়ের নামকরা ইতিহাসবিদ জোহর আফতাবচি তার বই ‘তজকিরাত-উল-ওয়াকিয়া’তে লিখেছেন, ১৫৩৯ সালের ৭ জুন চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হন হুমায়ুন। ওই লড়াইতে সম্রাট নিজে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তার হাতে একটা তীর বিঁধে গিয়েছিল। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন অন্য সৈনিকদের এগিয়ে যেতে, কিন্তু একজনও সেই নির্দেশ পালন করেনি। নিজের প্রাণ বাঁচাতে হুমায়ুনকে লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। গঙ্গা পেরনোর সময়ে প্রবল স্রোতে তার ঘোড়া ভেসে যায়। তখন এক লোক তার প্রাণ বাঁচায়। পরে সেই ব্যক্তিকে আধা দিনের জন্য নিজের সিংহাসনে বসিয়ে ঋণ চুকিয়ে ছিলেন তিনি।’

গঙ্গা পার হয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বীরপুরে এসে পৌঁছান হুমায়ুন। হাজার হাজার মোঘল যোদ্ধার মৃতদেহ পেছনে ফেলে তিনি অবশেষে আশ্রয় নিলেন চুনার দুর্গে। সেখানে তিন দিন অবস্থান করে এলাহাবাদের আরাইলে উপনীত হন। গহোরের রাজা বীরভানের বিশ্বস্ত সহায়তা নিয়ে আফগান সৈন্যদের পিছু ধাওয়ার মধ্যেও হুমায়ুন আগ্রায় উপনীত হন।

এই পরাজয়ের পেছনে হুমায়ুনের সামরিক ও ক‚টনৈতিক দুর্বলতা ছিলো সুস্পষ্ট। শের খানের কাছ থেকে হারানো অঞ্চল ও মর্যাদা উদ্ধারের জন্য তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। তখনো সম্রাটের ভাইয়েরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। সাহায্য চেয়েও ব্যর্থ হন তিনি। তাদের বৈরিতা ছিলো মর্মান্তিক। শেষ অবধি গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে তিনি শের খানের মুখোমুখি হন। তুমুল যুদ্ধে দুর্ভাগ্যবশত পরাজিত হন সম্রাট।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড