ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪ | ১৩ আষাঢ় ১৪৩১
ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১০

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম


প্রত্যেক বিভাগের নির্বাহীদের দেওয়া হতো স্বর্ণের তৈরী বাণ বা পরিচয়পত্র, যারা যে বিভাগের আওতায় থাকতেন, প্রত্যেকের তালিকা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করা হতো। শ্রেণী বিভাজনের এই খাতে সমস্যা হতো প্রায়ই। অনেকেই একই সাথে আহলে দাওলাহ ও আহলে সায়াদাতে স্থান পেতেন। কারণ, তারা পণ্ডিত হিসেবে যেমন ছিলেন স্বীকৃত ও বরেণ্য, তেমনি ছিলেন সেনা বা প্রশাসনিক কর্তা। বস্তুত এমনতরো শ্রেণী বিন্যাস প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য খুব একটা সহায়ক ছিলো না।

হুমায়ুন চেয়েছিলেন শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ। দিল্লি, আগ্রা, জৌনপুর, লাহোর, কনৌজ ইত্যাদি স্থানে শাসনকেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ নেন তিনি। সেখানে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ আমিরদের নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। নিজের কাছে ১২ হাজারের বেশি সৈন্য থাকবে না, এটা ছিলো তার সিদ্ধান্ত। তার সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি সহসা মৃত্যুর ফলে।

তিনি এক চলমান বাজার প্রচলন করেছিলেন, যেটাকে বলা হতো নৌকাবাজার। এই বাজারে থাকতো প্রয়োজনীয় সকল কিছু। তরকারি থেকে নিয়ে যুদ্ধের সরঞ্জাম, সবকিছু। ভ্রাম্যমাণ এই বাজার থেকে দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জের নাগরিকরাও উপকৃত হতেন। একই সাথে তিনি প্রচলন করেন নৌকা উদ্যান, চলমান সেতু, এমনকি চলমান রাজপ্রাসাদও।

ন্যায়বিচার ছিলো হুমায়ুনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কোনো বিচারপ্রার্থী যেন ন্যায় থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো সময় যে কোনো বিচারপ্রার্থী হুমায়ুনের দরবারে প্রবেশ করতে পারতো। দরবারের পাশেই ছিলো বড় এক ঢোলক। এর নাম ছিলো তবলায়ে আদালত। ন্যায়বিচারের ঢোলক। নিজের উপর অবিচার হচ্ছে মনে হলে যে কেউই এসে এই তবলা বাজাতে পারতো।

এই তবলা বাজানোর আবার নির্দিষ্ট নিয়ম ছিলো। সাধারণ অভিযোগ হলে তবলা একবার বাজাতে হতো, বেতন না পেলে দুবার, সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ হলে তিনবার আর খুনোখুনির অভিযোগে চারবার তবলা বাজানোর নিয়ম ছিলো। হুমায়ুন দ্রুত বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন। কোনো মজলুমের ফরিয়াদ আকাশে পৌঁছার আগেই তার বিচারকে গ্রহণ করতে হবে।

পারস্য থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় হুমায়ুন মীর সৈয়দ আলী এবং খাজা আব্দুস সামাদকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল চিত্রকলার শুভ সূচনা হয়েছিল। ইরান থেকে আনা কলাতত্ত্বের সঙ্গে ভারতীয় কলাতত্ত্বের মিশ্রণে মোগল-কলার সৃষ্টি করেছিলেন হুমায়ুন। তার রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষ সাধিত হয়। ‘হুমায়ুনের মকবরা থেকে মোগল আমলের বাস্তুকলার বাস্তবিক ইতিহাস শুরু হয়। মোগল কলাতত্ত্ব মানেই ইরানীয় প্রভাব। ইরানি প্রভাব থাকলেও তা হয়ে উঠল সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় মোগল কলাতত্ত্বের ইমারত। হুমায়ুনের ইমারত নির্মাণে খুব আগ্রহ ছিল। সময় ও সুযোগ পেলেই তিনি ইমারত নির্মাণের আদেশ দিতেন।’

হিন্দি ঐতিহাসবিদ ডক্টর হরিশঙ্কর শ্রীবাস্তব ছিলেন হুমায়ুন প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ গবেষক। তার অসাধারণ গ্রন্থ ‘মোগল সম্রাট হুমায়ুন’ এর ভূমিকা লিখেন ডক্টর তারাচাঁদ। এতে অল্পকথায় হুমায়ুনকে তিনি চিত্রিত করেছেন এভাবে, ‘হুমায়ুন তৈমুরী বংশের এক বিচিত্র রত্ন ছিলেন। ওই বংশে অদ্ভুত সব বিভূতিরা জন্ম নিয়েছেন, যাঁদের ধারাবাহিকতা তৈমুর থেকে নিয়ে আওরঙ্গজেবÑ দশ-বারো পুরুষ অবধি চলতে থাকে। এমন রাজবংশ জগতে অতি দুর্লভ, যে বংশে এমন ওজস্বী নায়কদের আবির্ভাব ঘটেছে। হুমায়ুন এই সুদীর্ঘ সোনালি শৃঙ্খলে এক অমূল্য সংযোজন ছিলেন। তাঁর চরিত্রে দোষে-গুণের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল, যা তাঁকে একদিকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ, অন্যদিকে নির্বাসিত বাদশাহ রূপে ইরানের বাদশাহের অনুগ্রহের পাত্র বানিয়ে দেয়। এক সময় যিনি দিল্লির সম্রাট ছিলেন, যাঁর সামনে রাজা ও নবাবগণ অবনতমস্তক হতেন, আর সেই হুমায়ুন বাদশাহ রাজস্থানের মরুভূমিতে নির্ধন, অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সকল অবস্থাতেই খুশি ছিলেন, দুঃখ-দুর্দশায় তিনি হতাশ হতেন না, আবার জয়-পরাজয়ে বিহ্বল হতেন না।’ (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ব্যাটিংয়ে শীর্ষে হেড, অলরাউন্ডারদের তালিকায় ছয়ে সাকিব

ব্যাটিংয়ে শীর্ষে হেড, অলরাউন্ডারদের তালিকায় ছয়ে সাকিব

প্রশ্ন : জুমা মসজিদে মাগরিবের আজান এবং নামাজ না হওয়া প্রসঙ্গে।

প্রশ্ন : জুমা মসজিদে মাগরিবের আজান এবং নামাজ না হওয়া প্রসঙ্গে।

পাহাড়িকা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত : সিলেটে সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

পাহাড়িকা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত : সিলেটে সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাবের স্মরণিকা নির্ভীক এর মোড়ক উন্মোচন করলেন ওবায়দুল কাদের

কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাবের স্মরণিকা নির্ভীক এর মোড়ক উন্মোচন করলেন ওবায়দুল কাদের

কেনিয়ায় কর বৃদ্ধি বিরোধী বিক্ষোভে নিহত ২২

কেনিয়ায় কর বৃদ্ধি বিরোধী বিক্ষোভে নিহত ২২

ঝিনাইদহে ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় দুই জনের যাবজ্জীবন

ঝিনাইদহে ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় দুই জনের যাবজ্জীবন

তারেককে ফিরিয়ে আনতে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

তারেককে ফিরিয়ে আনতে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করেই ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর-নবায়ন করা হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করেই ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর-নবায়ন করা হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কালীগঞ্জে হত্যা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

কালীগঞ্জে হত্যা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

১০ বছর পর ফাইনালে খেলার স্বপ্নে বিভোর ভারত

১০ বছর পর ফাইনালে খেলার স্বপ্নে বিভোর ভারত

গৌরীপুরে ৩দিন ধরে নিখোঁজ কৃষক, পরিবারে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা

গৌরীপুরে ৩দিন ধরে নিখোঁজ কৃষক, পরিবারে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা

সার্বজনীন নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি : স্থানীয় সরকার মন্ত্রী

সার্বজনীন নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি : স্থানীয় সরকার মন্ত্রী

ফার্মেসিগুলোর অনৈতিকতা বন্ধ করা হোক

ফার্মেসিগুলোর অনৈতিকতা বন্ধ করা হোক

বোরো ধানের যত কথা

বোরো ধানের যত কথা

দুর্নীতি যেই করুক এক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স : কাদের

দুর্নীতি যেই করুক এক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স : কাদের

বিনিয়োগের বাধা দূর করতে হবে

বিনিয়োগের বাধা দূর করতে হবে

রেল ট্রানজিটে ভারতের লাভ, বাংলাদেশের ঝুঁকি

রেল ট্রানজিটে ভারতের লাভ, বাংলাদেশের ঝুঁকি

এমবাপে ফেরায় স্বস্তিতে দেশ্যম

এমবাপে ফেরায় স্বস্তিতে দেশ্যম

মার্কিন আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে মাতৃভূমিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

মার্কিন আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে মাতৃভূমিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

ভারতে বিরোধী নেতা হচ্ছেন রাহুল গান্ধী

ভারতে বিরোধী নেতা হচ্ছেন রাহুল গান্ধী