জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষার সঙ্কোচন
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করার প্রয়াস দৃশ্যমান। বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ কমিটির প্রতিবেদনকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়েছে (পৃষ্ঠা-২)। অথচ কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব ছিল ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা ও উপহাসের বহিঃপ্রকাশ। আসলে কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ইসলামী আদর্শ বিরোধী এক কালো দলিল। এ রিপোর্ট ছিল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের আদর্শিক দীনতার এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এ কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিফলন দেখে অনেকে বিস্মিত না হলেও হতাশ হয়েছেন। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শিক নৈতিকতা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে রেখে একটি ধর্মবিবর্জিত ‘ইহ-জাগতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল’ তৈরির উপযোগী জনবল সৃষ্টিই বর্তমান শিক্ষা কমিটির অন্যতম উদ্দেশ্য।
ইসলামী শিক্ষার সঙ্কোচন
‘২০১০ সালে প্রণীত সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রধানমন্ত্রী ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। এ নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২। কিন্তু ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি, জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রতিফলিত হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ইসলামী শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা থেকে ইসলামী শিক্ষাকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছিল। আর বর্তমানে মানবিক শাখায় ইসলামী শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ শিক্ষা কলেজগুলোতে অবহেলিত অবস্থাতেই পড়ে আছে। এতে কলেজের ইসলামী শিক্ষার শিক্ষকরা ঐচ্ছিক বিষয়ের একজন গুরুত্বহীন শিক্ষকে পরিণত হয়ে আছেন। অন্যদিকে এ বিষয়ের ছাত্রসংখ্যাও আস্তে আস্তে লোপ পেতে পেতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অথচ ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষেও কলেজগুলোতে মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসা- সব শাখার শিক্ষার্থী ইসলামী শিক্ষাকে আবশ্যিক সাবজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করত। আবার প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০-এ ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, দশম শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়গুলোর বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এসব বিষয়ের ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত চালু থাকবে। বিষয়গুলোর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এ মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করেই একজন শিক্ষার্থীর গ্রেড নির্ধারিত হবে। এ প্রস্তাবে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’কে গুরুত্বহীন হিসেবে বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রাখা হয়েছিল। এর মানে দাঁড়ায়, ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়ে গ্রেড উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের পড়ার দরকার হবে না। শিক্ষকদেরও ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণের তেমন কোনো আগ্রহ থাকবে না। কারণ শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষা ছাড়া এটি পড়তে কখনোই আগ্রহী হবে না। আর শিক্ষকরাও এ বিষয়ে ক্লাস নিতে আর কোনো গুরুত্ব দেবেন না। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে এ কথা উল্লেখ ছিল, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা’। কিন্তু এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অমান্য ও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণভাবে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য প্রতিফলনের কোনো ব্যবস্থা ২০২০-এর শিক্ষাক্রমে রাখা হয়নি! আর শিক্ষানীতিতে ঘোষিত শিক্ষার্থীদের নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও জাতীয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ স্কুল ও কলেজে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়ে পড়াশোনার আর কোনো সুযোগ নেই’ (প্রফেসর ড. মো: কামরুজ্জামান, ইনকিলাব, ঢাকা, ১১ জুন, ২০২২)।
২০২৭ সালের মধ্যে বর্তমান শিক্ষা রূপরেখা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাভাবিক কারণে পুরো জাতি এতে শঙ্কিত। আমাদের বিবেচনায়, এ রূপরেখাতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা, লালিত সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধর্মপরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা সঙ্কোচন জনগণ সহজে মেনে নেবেন না। ধর্মবিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ও অকল্যাণ বয়ে আনবে। এ রকম শিক্ষাধারা হবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ। মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম, হিন্দুদের সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধদের বৌদ্ধধর্ম, খ্রিষ্টানদের খ্রিষ্টধর্ম, পাহাড়িদের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক ধর্মশিক্ষা, চর্চা ও প্রচার করার অধিকার থেকে রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করতে পারে না। আমাদের জানা মতে, শিক্ষা রূপরেখা প্রণয়ন কমিটি সেক্যুলার শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ ও মতামত নিলেও ইসলামী বিষয়ে পারদর্শী আলিম বা ইসলামিক স্কলারদের কোনো বক্তব্য বা মতামত গ্রহণ করেনি; ফলে নতুন শিক্ষা রূপরেখাটি হয়ে পড়েছে একদেশদর্শী, অপূর্ণাঙ্গ ও খণ্ডিত। জাতীয় শিক্ষা রূপরেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল প্রণয়নে যেভাবে ব্যাপকভিত্তিক মতামত নেয়া দরকার ছিল, তা করা হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সুপারিশ অনুযায়ী, এ শিক্ষা চালু হলে পুরো জাতি দ্রুত আদর্শিক মূল্যবোধবিবর্জিত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো: কামরুজ্জামান বলেন, মূলত ইসলামী শিক্ষার প্রতি একটি মহলের কুদৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে ২০০১ সাল থেকে। এ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি মহল ইসলামী শিক্ষাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করেন। দশম শ্রেণীর ১০টি সাবজেক্টের কোনোটিতে তারা হাত দেননি। তারা হাত দেন ১০০ নম্বরের ‘ইসলামী শিক্ষা’র প্রতি। তারা ১০০ নম্বরের ইসলামী শিক্ষাকে ৫০ নম্বরে সঙ্কুচিত করার হীন প্রয়াস শুরু করেন। দেশের সবাই জানেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তিন মাসের জন্য ক্ষমতায় থাকা সরকারের এ বিষয়ে নাক গলানোর কথাই নয়। কিন্তু ওই সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামবিদ্বেষী কিছু ব্যক্তি এ শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। ১০০ নম্বরের ইসলামী শিক্ষার প্রতি তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়। পরবর্তীতে ধর্মীয় জনতার প্রতিবাদে তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ইসলামী শিক্ষা নিয়ে এ ষড়যন্ত্র সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। অন্য কোনো শিক্ষা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ও ষড়যন্ত্র নেই। যত মাথাব্যথা ও ষড়যন্ত্র শুধু ইসলাম ধর্ম আর ‘ইসলামী শিক্ষা’ নিয়ে। ষড়যন্ত্রের এ ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে শুরু হয় স্কুলের ‘ইসলামী শিক্ষা’ নিয়ে নতুন কারসাজি। এ সময় ‘ইসলাম শিক্ষা’ বইয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম দেয়া হয় ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’। অথচ হিন্দুধর্ম শিক্ষা ও খ্রিষ্টান ধর্ম শিক্ষা বইতে এ রকম কোনো নাম দেয়া হলো না। এখানে প্রচ্ছন্নভাবে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ দুটো নামের মাঝখানে ‘ও’ অব্যয় দিয়ে দুটো ভিন্ন জিনিস বোঝানো হলো। আর উভয়ের মধ্যে বিরোধ আছে মর্মে সূক্ষ¥ একটি কারসাজির বীজ বপন করা হলো (ইনকিলাব, ঢাকা, ১১ জুন, ২০২২)।
যেকোনো ধর্মবিশ্বাসী মানুষ চায়, তার সন্তান যথাযথভাবে ধর্মশিক্ষা লাভ করুক। তাদের সন্তানরা ধর্মহীন হয়ে বেড়ে উঠুক, তারা কোনো দিন চান না। ধর্মচর্চা করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। ধর্মীয় শিক্ষা ও জ্ঞান না থাকলে ধর্মপালন করবে কী করে? পরিসংখ্যান মতে, তিন কোটি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যায়। এর মধ্যে ৫০ লাখের মতো শিক্ষার্থী আলিয়া ও কওমি মাদরাসায় অধ্যয়ন করে। বাকি দুই কোটি ৫০ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে পড়ে। দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব শিক্ষার্থী বিশেষায়িত সাবজেক্টে ও ডিসিপ্লিনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। সুতরাং সরল সমীকরণ, এসব শিক্ষার্থী পুরো শিক্ষাজীবনে ধর্মশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। বাস্তব জীবনে এসে ধর্মচর্চা করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০-৩০ বছর শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ধর্মপরায়ণ মানুষের সংখ্যা কমবে আশঙ্কাজনক হারে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরাই শেখাবেন। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে এখন থেকে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। আর শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক না বাণিজ্য বিভাগে পড়বে, সেই বিভাজন হবে একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে। নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দু’টি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এ পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। (প্রথম আলো, যুগান্তর, ৩০ মে, ২০২২)।
বিগত ২৩/০৬/২০২২ তারিখে এনসিটিবি-চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে যে, নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্মশিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত প্রচারণাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।’ এই প্রেস বিজ্ঞপ্তির অভিন্ন সুরে শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং ব্রিফ করেছেন। প্রকৃত পক্ষে, এই বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি শুভঙ্করের ফাঁকির মতো চাতুরতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি হলো, প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এস এস সি-র সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষা থেকে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে । যে পাঁচটি বিষয়ের বোর্ড পরীক্ষা হবে তা হলো-বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান। এর ভেতরে ধর্মশিক্ষা নেই। আর যে পাঁচটি বিষয়ের বোর্ড পরীক্ষা হবে না, তা হলো- জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ঃ পৃষ্ঠা-৯৭)। তাহলে ধর্মশিক্ষা আছে মাত্র স্কুলের ক্লাস ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার জন্য। এতে কি ধর্মশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকল? বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ধর্মশিক্ষা কখনই বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছিল না। শুধু বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেই ক্ষান্ত নয়, ধর্মশিক্ষার ক্লাসসংখ্যা বা শিখন ঘন্টাও অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় নির্মমভাবে সঙ্কোচন করা হয়েছে। যেমন দশম শ্রেণির ধর্মশিক্ষার বাৎসরিক শিখন ঘন্টা বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের চেয়ে ১০১ টি করে কম (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ঃ পৃষ্ঠা-৯১)।
এছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন রূপরেখায় ধর্মের কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা’ নামের শিখনক্ষেত্রের কথা। এতে আদৌ কোনো ধর্মশিক্ষার বই আবশ্যিক এবং বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বর্ণনাই ভরসা। ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমের ১১ নং পৃষ্ঠায় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ছয়টি শাখা রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত। এর মধ্যে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত, এই এই চার শাখায় ধর্মশিক্ষার কোনো আংশিক বা ঐচ্ছিক পাঠও নেই। শুধু মানবিক শাখার ঐচ্ছিক ১৭টি গুচ্ছ বিষয়ের মধ্যে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় ইসলাম শিক্ষা রয়েছে, যা বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়। শুভঙ্করের ফাঁকির আরো সূক্ষ্ম কাণ্ড হলো, ইন্টারে খোদ ইসলাম শিক্ষা নামেই একটি শাখা রাখা হয়েছে, যাতে তিনটি আবশ্যিক বিষয়ের একটি হচ্ছে আরবি। মূলতঃ এই শাখাটি কেতাবে থাকা কাজীর গরুর মতো। এ শাখাটি প্রচলিত নেই, এর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না; এ বিষয়টির কোনো পাইলটিং তো দূরে থাক, নতুন করে বিষয়টি ওপেন করার অনুমোদনও অঘোষিত ভাবে বন্ধ। পারিপার্শ্বিক কারণে এর বিষয়টির চাহিদা প্রকাশেরও সুযোগ নেই। কারণ, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক আরবি না শিখে একাদশে গিয়ে হঠাৎ করে কঠিন আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়া সক্রেটিসের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই এটিকে কার্যকর করার জন্য অবশ্যই যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নব্বই ভাগ মুসলমান তথা শতভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষের এই বাংলাদেশে কোনো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক এরকম ধর্মশিক্ষাকে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় রাখা, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে সঙ্কুচিত ও গুরুত্বহীন করাকে কিছুতেই সমর্থন করে না। সম্পূর্ণ জনমতের বাইরে থেকে কোন্ দেশের পরামর্শে, কাদের হীন স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, জাতির কাছে তা একদমই অবোধগম্য ও অনভিপ্রেত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মের মতো সর্বপ্রধান বিষয়টি বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রাখার ফলে, সেটি যে মারাত্মকভাবে গুরুত্বহীন হবে, সেটুকু বোঝার জন্য যুক্তিতর্কেরও প্রয়োজন হয় না। একে তো দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার প্রধান উৎসই ধর্মশিক্ষা; তদুপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বঙ্গবন্ধুর মতোই শিক্ষা-নীতিমালায় ধর্মশিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা অধিক গুরুত্বের সাথে বলেছেন। (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ঃ প্রাক-কথন, শিক্ষার উদ্দেশ্য-পৃষ্ঠা ০২) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করার মতো ঔদ্ধত্ব কারা কীভাবে দেখাতে পারল, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখার বিষয়। যার যার ধর্মশিক্ষা গুরুত্বের সাথে অর্জন করা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। প্রতিটি রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মশিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখে। ইসরাইলের মতো একটি বিতর্কিত-অস্বীকৃত রাষ্ট্র, যাকে সর্বাধুনিক মনে করা হয়, তারা যদি তাদের ধর্মশিক্ষা ‘তালমুদ’ ডিগ্রী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক রাখতে পারে, তাহলে উন্নত দেশ গড়ার জন্য কোন্ যুক্তিতে আমাদের ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করতে হবে? (ড. একেএম মাহবুবুর রহমান, সভাপতি ও মহাসচিব প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুর রহমান, ‘ইসলামি শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ’)।
ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পে কৌশলে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুর অবতারণা করায় দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয়। সরকার কমিটি গঠন করে পরিমার্জনের উদ্যোগ নেয়। বইয়ে ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে ভুল তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার একটি আদর্শ। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুকে হিজড়ার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া এক নয়। হিজড়া হল যৌনাঙ্গ প্রতিবন্ধি আর ট্রান্সজেন্ডার হল মেয়ে নিজেকে পুরুষ ভাবা এবং পুরুষ নিজেকে মেয়ে ভাবা। এটা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি পরিকল্পনাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার নামান্তর। এতে সমকামিতার বিকাশ ঘটবে। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত স্কুলে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প পড়ানো অব্যাহত আছে।
নুুরানি পদ্ধতির শিক্ষাধারা
নুুরানি পদ্ধতির প্রাথমিক শিক্ষাধারা গোটা দেশব্যাপী অভিভাবকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের যা দিতে পারেনি, নুরানি মাদরাসা সেটা দিয়ে গ্রহণযোগ্যতার তুঙ্গে ওঠেছে। ফলে অভিভাবকরা নুরানি মাদরাসার দিকে ঝুঁকছেন। এখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় রয়েছে। দায়িত্বশীল মহল থেকে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন নুরানি মাদরাসার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে হৃাস পেয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নাম থাকলেও পড়ালেখা করছে নুরানি মাদরাসায়। বাস্তবে এর জন্য নুরানি মাদরাসাকে দায়ী করার সুযোগ নেই বরং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিলেবাসের ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন শিক্ষার্থীদের টানতে পারছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
যত্রতত্র অনুমোদনহীন নুরানি মাদরাসা গড়ে ওঠছে, এমন একটি অভিযোগ দায়িত্বশীল মহল থেকে তোলা হচ্ছে। আসলে অধিকাংশ নুরানি মাদরাসা বেসরকারি নুরানি তালিমুল কুরআন বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকার এই বোর্ডকে স্বীকৃতি দিলে ঝামেলা চুকে যায় অথবা জাতীয় সংসদে স্বীকৃত ছয়টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করার পদক্ষেপ নিলে তাও ভাল। অনুমোদনহীন যত্রতত্র গড়ে ওঠা নুরানী মাদরাসাগুলোকে অবশ্য নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এই ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সেজন্য সরকারের সাথে ছয় বোর্ড কর্তৃপক্ষের সংলাপ হতে পারে।
নুরানি তালিমুল কুরআন বোর্ড কর্র্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলো পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও সময়োপযোগী। পবিত্র কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পরিবেশ ও সমাজবিজ্ঞানে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্যসুরক্ষাসহ বাংলাদেশের ফলমূল, পাখি, মাছের পরিচিতি এবং মেঘ, বৃষ্টি ও ঝড়ের বর্ণনা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, জসিমউদ্দিন, শেখ ফজলুল করিম, কাজী কাদের নেওয়াজ ও তালিম হোসেনের ছড়া ও কবিতা স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বইতে ‘দেশের তরে লড়বো’ শীর্ষক দেশাত্মবোধক নিবন্ধ রয়েছে। পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে ‘আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, ‘আমাদের জাতীয় পতাকা’, ‘জাতীয় প্রতীক’, আমাদের পরিবেশ’ নিয়ে নিবন্ধ রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর ‘নুরানি পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ বইয়ে ‘ছাগল পালন’, ‘আমাদের কৃষি’, ‘বাংলাদেশের সম্পদ’, ‘যানবাহন পথ ও রাস্তা পারাপার’, ‘আমরা সবাই মানুষ’,‘বাংলাদেশের ঋতু’, বিষয়ে লেখা রয়েছে।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নীতিমালা
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নীতিমালা ২০১৮, আওয়ামী লীগ-এর নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এর ঘোষণা এবং বাংলাদেশের সাংবিধান প্রদত্ত অধিকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার- এসবের কোনো কিছুই ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাগ্য বদলাতে পারেনি। ১৯৭৮ সালের মাদরাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৭৮-এর ১৭(২) (বি) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে জনসাধারণের দানে পরিচালিত ফোরকানিয়া মাদরাসাগুলোকে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক ১৯৮৩ সালের ২৫শে আগস্ট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নামকরণ করা হয়। পরবর্তী বছর ১৯৮৪ সালে মঞ্জুরি প্রদান করে। এরপর ১৭ই নভেম্বর ২০০৮ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড নতুন করে পাঠদানের অনুমতি প্রদান বন্ধ করে দেয়। ফলে বিগত ১৫ বছর ধরে বাদ পরা বা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো সরকার হতে পাঠদানের অনুমতি লাভ করতে পারেনি। ১৫ বছর আগে পাঠদানের অনুমতি পাওয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের হিসাবে ৬ হাজার ৮৮১ টি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ৭ হাজার ৫১টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে ৮ হাজার ৯৫৬ টি। এর মধ্যে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার সংখ্যা ১ হাজার ৫১৯টি। এ যাবৎ কালে প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান হিসেবে শুধু ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সরকার মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড হতে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত প্রায় প্রতিটি মাদরাসাকে দুই কিস্তিতে এককালীন ৪ হাজার ২০০ টাকা ও পরবর্তী কিস্তিতে ৭হাজার টাকা করে মোট এগারো হাজার দুইশ’ টাকা প্রদান করে। অনুমোদন প্রদানের চার বছর পরে মাদরাসা উন্নয়নের জন্য মাত্র এগারো হাজার দুইশ’ টাকা প্রদান করা এটা এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সামিল। ১৯৯৪ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের অধীনে (স্মারক তারিখ: ০৮/০৫/১৯৯৪ পত্রমূলে) প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যাচাইয়ের বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে ৬৪ জেলার ৪ হাজার মধ্য হতে মাত্র ১ হাজার ৫১৯ টি মাদরাসাকে অনুদানভুক্ত করে শিক্ষকদের মাসিক ৫শত টাকা হারে অনুদান দেওয়া হয় (প্রফেসর ড. হানিফ খান, চেয়ারম্যান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোর ভাবনা, পৃ.১৪-১৬)।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরেও প্রায় ৯ হাজার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষক বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে বহু বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও সম্মতিকে সরকারের কোন অংশ বাধাগ্রস্ত করছে তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। দেশে ১ লাখ ৩০ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে। এছাড়াও এনজিও পরিচালিত হাজার হাজার স্কুল উপজেলা প্রশাসন থেকে কোড নম্বর নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ ও বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ৬৮৮২টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের আওতায় নেওয়া জরুরি।
একই দেশে ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি প্রাপ্ত প্রাইমারি হেড মাস্টার ও শিক্ষকরা যে কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুসরণ করে পাঠদান করছেন, ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধানগণ ফাজিল (ডিগ্রি) ও কামিল (মাস্টার ডিগ্রি) সনদ নিয়ে একই কারিকুলাম ও সিলেবাসে পাঠদান করে যাচ্ছেন। উপরন্ত মাদরাসার স্বকীয় ৪টি অতিরিক্ত বিষয় পাঠদান করে যাচ্ছেন। অথচ ইবতেদায়ি প্রধান একজন অফিস সহকারীর সমান বেতন পাচ্ছেন। একই দেশে এই বৈষম্য মেনে নেয়ার মত নয়। ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহিদুল হক নয়া নিবন্ধের লেখকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো অর্ধশতাধিক পিটিআই রয়েছে। অথচ সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ১৫ হাজারের অধিক মাদরাসার জন্য বিগত ৪৮ বছরেও একজন শিক্ষকের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রাইমারি শিক্ষার উন্নয়নকল্পে প্রাক-প্রাথমিক স্তর রয়েছে। সেখানে শিক্ষক বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৩৭ হাজার ৬৭২ জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু মাদরাসার জন্য এ স্তর খোলার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ৪৫ হাজার ইবতেদায়ি মাদরাসাশিক্ষকরা তাদের ১১ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন বহুদিন ধরে। অবহেলা, গ্লানি ও আর্থিক দীনতা অশ্রু হয়ে গড়াচ্ছে। শিক্ষকরা অবহেলার শিকার হলে জাতির উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হয়। ইবতেদায়ি মাদরাসাশিক্ষকদের দাবি ন্যায্য, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত।
আমরা প্রস্তাব করছি নৈতিকতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। ধর্মশিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আবশ্যকীয় করতে হবে। আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে আমাদের শঙ্কা, সংশয়, প্রস্তাব ও দাবিগুলো যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করার আবেদন জানাই। একইসাথে জনগণকে ধর্মীয় শিক্ষা ও জাতীয় মূল্যবোধপরিপন্থী এ শিক্ষা রূপরেখা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাই।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লেবাননে যুদ্ধবিরতি কার্যকর,বাসিন্দাদের বাড়ি না ফেরার নির্দেশ
যেসব এলাকায় ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভের কারণ কী? যা জানা যাচ্ছে
হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে অবশেষে সম্মত হলো ইসরায়েল
নিহত আইনজীবীকে নিয়ে অপপ্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম
চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা: যৌথবাহিনীর অভিযানে আটক ২০
আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে মাভাবিপ্রবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ
রাশিয়া গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করল
ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মধ্যরাতে উত্তাল যবিপ্রবি
ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল পবিপ্রবি
ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ
চিন্ময়ের মুক্তি দাবিতে মিছিল থেকে আ.লীগের ৬ নেতাকর্মী আটক
এক ইসরায়েলি সহ গাজায় নিহত ১৪ ফিলিস্তিনি
ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল সারা দেশ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে দেয়া আইনজীবী সাইফুলের সেই স্ট্যাটাসটি ভাইরাল
হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র
দেশে সম্প্রীতি নষ্ট করার পরিকল্পনা নিয়ে চিন্ময় কাজ করছিল: উপদেষ্টা নাহিদ
চিন্ময় সম্পর্কে দিল্লির বক্তব্যকে বন্ধুত্বের চেতনার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে ঢাকা
দুর্বল ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ইবি