কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম
উজান-ভাটির বৈচিত্র্যপূর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ। বীর ঈশা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত এ জেলার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অনুপম নিদর্শন। রয়েছে মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য সাধারণ নিদর্শন। সুলতানি আমল এবং মুঘল আমলে জেলাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য মসজিদ। এসব প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের পরিচয় বহন করে চলেছে। তবে ঈশা খাঁ এবং তার বংশধরদের সময়ে এ জেলায় ইসলামের বিকাশ ও প্রচার বিশেষ ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে। তাদের পৃষ্টপোষকতায় এখানে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান ও পাগলা মসজিদের মতো ধর্মীয় স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় শোলাকিয়া ময়দানে। শোলাকিয়ার পরিচিতি ও সুনাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে কিশোরগঞ্জ মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। অন্যদিকে পাগলা মসজিদ সাম্প্রতিক সময়ে কিশোরগঞ্জের পরিচিতি ও খ্যাতির শিরোস্ত্রাণে যুক্ত করেছে নতুন পালক। দিন যত যাচ্ছে পাগলা মসজিদের খ্যাতি ও জৌলুস ততই বাড়ছে। স্বভাবতই ঐতিহাসিক এই মসজিদকে নিয়ে জেলার সকলেই গর্ববোধ করে।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে পাগলা মসজিদ প্রতিষ্ঠিত। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বেশকিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি জনশ্রুতি হচ্ছে, একবার নরসুন্দার প্রবল স্রোতে মাদুর পেতে এক আধ্যাত্মিক পুরুষ ভেসে আসেন। তার আসন ছিল নদীর ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে। বর্তমান মসজিদের কাছে এসে ওই আধ্যাত্মিক পুরুষ স্থিত হন। এভাবেই কয়েকদিন কেটে যায়। তারপর ধীরে ধীরে নদীর সে স্থানটিতে জেগে ওঠে চরাভূমি। সাধক তখনও ধ্যানমগ্ন। জেলেরা মাছ ধরতে এসে এ অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পায়। সবাই বিস্মিত এবং হতবাক। কেউ কাছে এগিয়ে আসার সাহস করে না। এরই মধ্যে মসজিদের বিপরীত দিকে অবস্থিত রাখুয়াইল গ্রামের এক গোয়ালা হঠাৎ লক্ষ করল, তার পালিত সদ্য প্রসূত গাভীর ওলানে কোনো দুধ আসছে না। অনেক চেষ্টা করেও সে একফোঁটা দুধও পেল না। এরই মধ্যে একদিন গাভীটি পাল থেকে বেরিয়ে নদী সাঁতরে সেই আধ্যাত্মিক সাধকের চরায় উঠে আসে। সাধকের পাশে রক্ষিত একটি পাত্রে ওলানের সম্পূর্ণ দুধ ঢেলে দিয়ে গাভীটি আবার নদী সাঁতরিয়ে ফিরে আসে পালে। এরকম পরপর কয়েকদিন ঘটলো। সব দেখে গোয়ালা নিশ্চিত হলো যে, এ সাধক এক কামেল পুরুষ। তাই গোয়ালা সেই সাধক পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। কিছুদিনের মধ্যেই গোয়ালার সংসারে অভাবনীয় উন্নতি হতে থাকে। গোয়ালার উন্নতি দেখে আশেপাশের জেলে-তাঁতী থেকে শুরু করে অনেকেই সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। পরে শিষ্যদের মাধ্যমেই এ স্থানে গড়ে ওঠে একটি হোজরাখানা। সাধকের মৃত্যুর পর হোজরার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে হোজরাখানার পাশেই নির্মিত হয় একটি মসজিদ; যা পরে পাগলা সাধকের নামানুসারে পাগলা মসজিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
এ ব্যাপারে আরেকটি জনশ্রুতি হচ্ছে, ঈশা খাঁ’র ৫ম পুরুষ হয়বতনগর এলাকার জমিদার দেওয়ান হৈবৎ খাঁনের অধঃস্তন পুরুষ জোলকরন খানের স্ত্রী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই মসজিদটি স্থাপন করেন। নিঃসন্তান জমিদার-জায়া আধ্যাত্ম সাধনায় ব্রতী থাকতেন। জনসাধারণের কাছে পাগলাবিবি নামে তিনি পরিচিত ছিলেন বলে তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নাম হয় পাগলা মসজিদ। এছাড়া এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত জনশ্রুতিটি হচ্ছে, দেওয়ান হৈবৎ খাঁ’র ধারাবাহিকতায় ঈশা খাঁ’র ৭ম পুরুষ দেওয়ান জিলকদর খান সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হয়বতনগরের জমিদার হয়েছিলেন। বংশ-তালিকার ধারাক্রমে জিলকদর খান দেওয়ান হৈবৎ খাঁ’র পৌত্র বা দৌহিত্র ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। জমিদারি প্রাপ্ত হলেও দেওয়ান জিলকদর খানের জমিদারির প্রতি কোনোরূপ মোহ ছিল না। তিনি জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে অনেকটা আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী থাকতেন। সংসার-বিবাগী ও উদাসী প্রকৃতির এই মানুষটি সবার কাছে ‘পাগলা সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। জমিদারির নৈমিত্তিক দায়িত্বের প্রতি তার কোনো মনোযোগ ছিল না। প্রায়শই তিনি আজকের পাগলা মসজিদ যেখানে স্থাপিত, সেখানে এসে ধ্যানমগ্ন বসে থাকতেন। নরসুন্দাপাড়ের এই স্থানটিকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তার প্রাত্যহিক ধ্যানের স্থান হিসেবে। পরে জমিদারবাড়ির তত্ত্বাবধানে পাগলা সাহেবের আরাধনার জন্য এই স্থানটিতে একটি ক্ষুদ্র মসজিদ তৈরি করে দেওয়া হয়। এ কারণেই পরবর্তী সময়ে মসজিদটির নামকরণ করা হয়- পাগলা মসজিদ।
প্রায় চার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পাগলা মসজিদ দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সব শ্রেণিপেশার মানুষ মসজিদটিতে দান করে থাকেন। তাদের দানে মসজিদটির দানসিন্দুক ভরে যায়। প্রতিবার খুললেই মেলে কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া পাওয়া যায় বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। কথিত রয়েছে যে, এ মসজিদে দান করলে মনের বাসনা পূরণ হয়। মুশকিল আসানসহ মেলে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি। এই বিশ্বাস থেকে স্থানীয়রা ছাড়াও দূর-দূরান্তের মানুষও পাগলা মসজিদে দান করতে ছুটে যান। মসজিদটিতে নয়টি দানসিন্দুক রয়েছে। তিন মাস পর পর এসব দানসিন্দুক খোলা হয়। মসজিদে দান করতে এসে অনেকেই এখানে নামাজ আদায় করেন। বিশেষ করে জুমআর দিনে মসজিদটিতে মুসল্লিদের ঢল নামে। এ সময় মূল মসজিদ ছাড়িয়ে সামনের ও আশপাশের খোলা জায়গা, সেতু ও সড়কেও নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যান মুসল্লিরা। এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন ধনী-গরিব নির্বিশেষে। সবার উদ্দেশ্য একটাই- যেন কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া হয়ে না যায় মহান আল্লাহর অনুকম্পা লাভের সুযোগ। পাগলা মসজিদকে ঘিরে মানুষের এমন আবেগ-ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় সকল হৃদয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাগলা মসজিদটি ওয়াক্ফ প্রশাসনের আওতায় নিবন্ধিত হয়। এ সময় মোতওয়াল্লীর দায়িত্ব পান হয়বতনগর জমিদারবাড়ির দেওয়ান ছাত্তারদাদ খান ওরফে সায়রা মিয়া। ১৯৭৯ সালে মসজিদটির নিয়ন্ত্রণ কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রশাসন গ্রহণ করে। তখন থেকেই মহকুমা প্রশাসক পদাধিকার বলে মসজিদ কমিটির সভাপতি। ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা হওয়ার পর থেকে জেলা প্রশাসক মসজিদ কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়াক্ফ স্টেটের অডিটর দ্বারা প্রতি বছর পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়।
শুরুতে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর পাগলা মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের বিবর্তনে আজ এ মসজিদের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্যও। বর্তমানে ৩.৮৮ একর ভূমির ওপর সম্প্রসারিত পাগলা মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদটি তিনতলা বিশিষ্ট, ছাদে ৩টি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার রয়েছে। এখানে এক সাথে ৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। পুরুষ ও নারীদের নামাজের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যবস্থা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাগলা মসজিদে মুসল্লিদের ব্যাপক সমাগমকে ঘিরে পুরাতন অবকাঠামো ভেঙ্গে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, পাগলা মসজিদ মানুষের একটি আবেগের জায়গা। অনেক মানুষ এখানে তাদের ইচ্ছাপূরণের জন্য দান করেন। মসজিদটিতে বর্তমানে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। দানের টাকায় এখানে ছয়তলাবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স হবে। এতে আনুমানিক ১২০ থেকে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
লেখক: কিশোরগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী শুধু ফ্যাসিস্ট নয়, তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট: মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন