ভারতের সাথে পানির মামলায় এতটুকু ছাড় দেয়া যাবে না
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম
বাংলাদেশের উৎপত্তি নদী থেকে। দেশের মূল ভূখণ্ড নদী দ্বারা গঠিত হয়েছে। নদীগুলি এদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করে। বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর প্রণালী দ্বারা পাহাড়-পর্বত থেকে বয়ে আনা পলিমাটির ৫ থেকে ১৫ কিলোমিটার পুরু স্তরের উপর বসে আছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশের উর্বর মাটি মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো দূর-দূরান্ত থেকে মানুষকে আকৃষ্ট করে একটি মিশ্র জাতিগত জনগোষ্ঠি গঠন করেছে। জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি পরিবেশএবং ভৌত স¤পদের উপর চাপও পড়েছে। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫শ’ ৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশে ১৮ কোটি মানুষের বাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪২ শতাংশ। তবে এই হার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,১০০ জন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। জনসংখ্যার চাপের ফলে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি দেশের বাইরে জীবিকা অন্বেষণে রত আছে। দেশের স্বল্পোন্নত এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নত এলাকায় অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি সু¯পষ্ট প্রবণতা রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত কম বর্ধিষ্ণু অঞ্চলগুলি থেকে শহর এবং শহরতলিতে অভিবাসন বেশ কিছু নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
উজানে গঙ্গা ও অন্যান্য নদীর পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশে নদীগুলির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে এবং তার সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা, যা এই নদীগুলির উপর নির্ভর করে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনাÑ বাংলাদেশ তিনটি বড় নদী উপমহাদেশের প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি নিষ্কাশন করে। বাংলাদেশ অসংখ্য ছোট বড় নদী, খাল এবং খাঁড়ি দ্বারা বেষ্টিত, যা তার প্রায় ৯ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। পানি বিশেষজ্ঞরা বড় ২৩০টি নদী শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে ৫৭টি সীমান্তের ওপার থেকে আসছে, ৫৪টি ভারত থেকে এবং ৩টি মিয়ানমার থেকে। উপমহাদেশের দুটি বড় নদী গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত প্রবাহ সাগরে পতিত হওয়ার আগে বাংলাদেশে মিলিত হয়, তাদের মোট অবিবাহিকার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। নদী প্রবাহের বিশাল ঋতুগত তারতম্য রয়েছে। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত প্রবাহ বছরের প্রথমদিকে সাধারণত প্রতি সেকেন্ডে ১০,০০০ ঘন মিটার (কিউসেক) থেকে বেড়ে আগস্টের শেষের দিকে ৮০,০০০ থেকে ১৪০,০০০ কিউসেক-এর সর্বোচ্চ প্রবাহে পৌঁছে সেপ্টেম্বরের শুরুতে। উচ্চ অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাতের (বার্ষিক গড় ২,০০০ মিলিমিটার) সাথে এই ধরনের বড় নদীর প্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশের ভূমির নিম্ন গড় উচ্চতা এবং অপর্যাপ্ত নিষ্কাশনের ফলে প্রতি বছর ব্যাপকভাবে প্লাবন হয়। স্বাভাবিকভাবে দেশের এক তৃতীয়াংশ নিয়মিতভাবে প্রতি বছর প্লাবিত হয়। তবে ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের মতো বড় বন্যায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি তিন সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা গঙ্গা নির্ভরশীল এবং জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ এই নদীর সেবা পেয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। এই নদী মিঠে পানির প্রবাহের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি নিয়ে আসে এবং দেশের ৭০০ কিলোমিটার উপকূল বরাবর জীবজাগতিক বৈশিষ্ট্য (ইকোসিস্টেম) বজায় রাখে। নিচের দিকে রয়েছে উপকূল, গাঙ্গেয় বদ্বীপ এবং সুন্দরবন, যা বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৭২ সালের মার্চে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণার আওতায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথনদী কমিশন গঠন করা হয়, যেন দুই দেশের নদীগুলির সর্বোত্তম ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণপরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি করা যায়। তার দুই বছরের মধ্যে দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় যৌথ ঘোষণা জারি করা হয়। তার পরেই ফারাক্কা ফিডার খালের ট্রায়াল অপারেশনের জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম অন্তর্বর্তী চুক্তি করা হয় ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের পরীক্ষামূলক সময়ের জন্য ফারাক্কা ব্যারাজের খালের মাধ্যমে পানি ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে প্রবাহিত করার জন্য। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত পায় ফারাক্কায় প্রতি সেকেন্ডে ৩১০-৩৫০ ঘনমিটার পানি এবং ১২৪৫-১৪০০ ঘনমিটার বাংলাদেশের জন্য রাখা হয়। অন্তর্বর্তী চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারত পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে। ১৯৭৭ সালে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা হয়, ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহার এমনভাবে করতে হবে যেন বাংলাদেশে প্রবাহিত পানি চুক্তিতে স্বীকৃত পরিমাণের শতকরা ৮০-এর কম না হয়। ১৯৭৭ সালের চুক্তির মেয়াদ ১৯৮২ সালে শেষ এবং বাংলাদেশে সরকার বদল হলে উক্ত চুক্তির মেয়াদ বর্ধিত না করে ৫ বছরের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারকে ৮০ ভাগ পানি প্রাপ্তির গ্যারান্টি ক্লজটি বাদ দেয়া হয়। ৫ বছর মেয়াদি এই সমঝোতা স্বারক ১৯৮৮ সালে উত্তীর্ণ হলে আবার কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারতে গঙ্গার পানির যথেচ্ছ প্রত্যাহার অব্যাহত থাকে। পরবর্তী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে। এই চুক্তি ৩০ বছর মেয়াদি হলেও তাতে কোন গ্যারান্টি ক্লজ রাখা হয়নি। শুষ্ক মওসুমে (ঐতিহাসিক প্রবাহের হিসেবে তারতম্যসহ) পানি বণ্টনের বিস্তারিত সিডিউল এই চুক্তিতে থাকলেও ফারাক্কার উজানে নদীর পানি ব্যবহার এবং সে কারণে ফারাক্কায় প্রবাহ কমে গেলে কী প্রতিকার করা হবে তা অনুল্লেখ থাকে। চুক্তির এই দুর্বলতার কথা জিজ্ঞেস করলে তখনকার পানি মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানান, রাজনীতিক হিসেবে অতসব খুঁটিনাটি কি তারা বোঝেন? বিশেষজ্ঞ হিসেবে যারা দরকষাকষি করেছেন, তারা চুক্তিতে থাকা দুর্বলতার কথা তাকে জানাননি। এটা পরিষ্কার যে, পানি কূটনীতিতে বারবার হেরে বাংলাদেশকে যে ছাড় দিতে হয়েছে তা পুনরুদ্ধার ছাড়া দেশের গঙ্গা-নির্ভরশীল এলাকায় প্রয়োজনীয় পানির অভাবে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পরের বছরেই শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে (৬,০০০ কিউসেক তথা ১৬৯.৯ কিউসেকে) নেমে আসে। উল্লেখ্য, ফারাক্কার উজানে গঙ্গা নদীর উপর ১৬টি বড় বড় ব্যারেজ ছাড়াও অসংখ্য পানি প্রত্যাহারের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোর চাহিদা মেটানোর পর যে পরিমাণ পানি অবশিষ্ট থাকে তাই ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত আসে। ২০২৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তি শেষ হবে। চুক্তি নবায়নের জন্য প্রস্তুতি চলছে। এখনও দুই বছর সময় আছে।
আমাদের পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের আগে থেকেই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন ১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে পানি কূটনীতিতে যে হার আমরা মেনে চলেছি তার সুরাহা করে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্য লাভজনক একটি চুক্তিতে পৌঁছা যায়। এখন পানি এবং পরিবেশ বিষয়ক জ্ঞানের পরিধি অনেক বেড়েছে। যে কোনো নদী সীমান্তে ভাগাভাগির অ-টেকসই মান্ধাতা আমলের চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে একটা স্বত্তা হিসেবে বিবেচনা করে সার্বিক চুক্তি করতে হবে, যেন নদী সাগরে পতিত হবার আগ পর্যন্ত জীবিত থাকে। কারণ, নদী জীবিত থাকলেই তার সেবা পাওয়া যাবে। ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নদীর জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি রেখে বাদ বাকি অংশ উভয় দেশের মধ্যে বণ্টনের কথাবার্তা হয়েছিল। সেই চুক্তি অদ্যাবধি স্বাক্ষরিত না হলেও সে বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সূত্র ধরে তা গঙ্গার ব্যাপারে প্রয়োগ করতে হবে। চুক্তি হবে নদীর উৎসস্থল থেকে সাগর পর্যন্ত। নদীর জন্য এবং সাথে সাথে দুই পক্ষের স্বার্থে ক্ষতিকর কার্যকলাপের উপর স্বীকৃত পদ্ধতিতে উভয়ের নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক সুদৃঢ় রাখার সার্থে চুক্তির শর্ত মেনে চলার ব্যাপারে গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে। চুক্তির শর্ত নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলে তা নিরসনের জন্য মধ্যস্থতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এভাবে সবার ন্যায্য চাহিদা পূরণ হলে এবং সঙ্ঘাত নিরসনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশ শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের কাজে নিবিষ্ট থাকার সুযোগ পাবে। উল্লেখ্য, নেপালের সাথে মহাকালি এবং পাকিস্তানের সাথে সিন্ধু নদী নিয়ে ভারতের যে চুক্তি আছে, তাতে গ্যারান্টি ও আরবিট্রেশন ক্লজগুলো রয়েছে।
বাংলাদেশ এ বিষয়ে ব্যতিক্রম হতে পারে না। ফারাক্কায় পানির প্রাপ্যতা কম হলে বাংলাদেশকে বলা হয়, হিমালয়ে বরফ না গললে আমরা কীভাবে পানি দেব? গ্যারান্টি এবং সালিশি ধারা না থাকার কারণে চুক্তিটিতে যে ত্রুটি ছিল, তা প্রতিকারের জন্য কোনো প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। তার উপর আরেকটি দুঃসংবাদ হল এই যে, কোনো কোনো মহল বলতে শুরু করেছে, বাংলাদেশে গঙ্গার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে ভাগীরথী হয়ে এই নদী বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। জানা গেছে, ভারতের স্কুলের পাঠ্য বইয়ে গঙ্গা নদীর পরিচয় এভাবেই দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, আমাদের কিছু লোক, এমনকি গঙ্গাকে পদ্মা নদীর অংশ বলতে শুরু করেছে, যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে গঙ্গা নেই, আছে পদ্মা। আসলে গঙ্গা নদী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজবাড়ীতে এসে ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সাথে মিলিত হবার আগ পর্যন্ত গঙ্গা হিসেবেই চিহ্নিত। কিন্তু কোনো কোনো মহল এমনকি রাজশাহী নগরীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীকেও পদ্মা বলছেন এবং গঙ্গার ইতিবৃত্ত বিকৃতিতে সহায়তা করছেন। গঙ্গার প্রয়োজনীয় প্রবাহ না পাওয়ায় তার শাখা নদী গোড়াইতে শুস্ক মওসুমে পানি থাকছে না। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে ড্রেজিং করেও গোড়াইয়ের প্রবাহ দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত নেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি নদী মরে গেছে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য, কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও বনজ স¤পদের সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। মিঠে পানিরপ্রবাহ অব্যাহত না থাকায় সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা উপকূল অঞ্চল থেকে তিনশত মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পরিবেশের বিপর্যয় বৃদ্ধি করে চলেছে। মিঠে ও লবণাক্ত পানির মধ্যে ভারসাম্য না থাকার কারণে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছগুলো অব্যাহতভাবে মরে যাচ্ছে। ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় আয় উপার্জন করতে না পারায় খুলনা অঞ্চল থেকে মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ভিটে-বাড়ি ছেড়ে দেশের ভিতরে অন্যত্র অথবা দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশে প্রণীত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের দেশের সহায়তা প্রদানের আগ্রহের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, তিস্তা চুক্তির অভাবে শুষ্ক মওসুমে পানিশূন্যতা এবং বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা ও নদীর তীর ভাঙনের ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলার জন্য প্রণীত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগ্রহের কথা বলে কি তিস্তার পানি চুক্তি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে? আপাত দৃষ্টিতে গণচীনকে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা মনে হলেও বিনয় মোহন কোয়াত্রা কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর ত্বরান্বিত করার কথা বলেননি। তিস্তা চুক্তি স¤পাদন করলেই তো তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনেকখানি কমে যায়। ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অসহযোগিতার অজুহাতে চুক্তি স্বাক্ষর ঝুলে আছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারেজ থেকে তিস্তার শুস্ক মওসুমের সমস্ত পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে দুই দশক ধরে। তিস্তা ব্যারেজ থেকে চুইয়ে যে পানি আসে তাই বাংলাদেশ পেয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রতি বছর তিস্তার বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের এবং এর দুই তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষতির কারণে নীতি নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হন না। রংপুরের জনগণকে তিস্তাসৃষ্ট বন্যার অবনতি থেকে রক্ষা করতে এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প প্রণীত হয়েছে।
একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। কিছু মহল এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। ভারতের নীতি নির্ধারকরা বলছেন গণচীনকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেয়া যাবে না। কারণ, তাহলে প্রকল্প কর্মীর ছদ্মবেশে চীনের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ এবং নেপালের মাঝখানে ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য ¯পর্শকাতর ‘চিকেন নেক’-এর কাছাকাছি এসে যাবে। উজানের দেশ ভারত তিস্তার পানিও দিচ্ছে না, আবার বাংলাদেশের পানি-পরিবেশের জন্য আত্মরক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাধা দেবে, এটা কেমন কথা? আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পেলে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট। নিজের উদ্যোগে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখনো জোরালো কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় যে কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা দূরীভূত না করে প্রশমন করার প্রস্তাব গ্রহণ করা আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বিশাল হিমালয়ের নদী দ্বারা সৃষ্ট বদ্বীপ বাংলাদেশকে নদীর প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে এই ভূখণ্ড টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে, প্লাবন ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নদীগুলি জীবিত থাকতে পারে না। কারণ, শুস্ক মওসুমে যখন পর্বত থেকে বরফ গলা পানি আসে না, তখন প্লাবনভূমি থেকে চুঁইয়ে নেমে আসা পানি নদীগুলিকে বাঁচিয়ে রাখে। ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা নদীগুলিতে বড় কাঠামো নির্মাণের বিরুদ্ধে এবং নদীর পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিত করার পক্ষে বারবার মত প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তারা বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রচারণা চালান এবং পরবর্তীকালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বন উপদেষ্টা কমিটির পরামর্শে এটিকে স্থগিত করা হয়। এর বিপরীতে আমাদের কিছু লোক প্রকল্পের জায়গা দেখতে হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করেছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য সেখানে নামতে না পেরে আকাশ থেকে স্থানটি দেখে এসেছে। উক্ত প্রকল্পের ন্যায্যতার পক্ষে কথা বলার জন্য তখন বাংলাদেশের একজন সামরিক-রাজনৈতিক নেতা সেখান থেকে সাম্ভাব্য উৎপাদিত বিদ্যুতের অংশ দাবি করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সংস্থা এখনও উক্ত নদীতে কাঠামোগত হস্তক্ষেপের পক্ষে দৃঢ়ভাবে রয়ে গেছে। নদীতে স্থাপনা নির্মাণের দিন যে চলে গেছে, তা প্রমাণ করার জন্য গবেষণা সন্দর্ভের অভাব নেই। সারা বিশ্বে নদীগুলো পুনরুদ্ধার করতে এ ধরনের ৫ হাজার স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিহার থেকে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার দাবি উঠেছে। অথচ, একথা বলতে আমরা লজ্জা পাচ্ছি। অথচ, বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের সাথে সঙ্গতি রেখে তার অবস্থানকে আন্দোলিত করা এবং পানি সমস্যা সমাধানের জন্য উচ্চস্বরে আওয়াজ তোলা। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, পানি বণ্টনের ধারণাটি এখন নদীর উৎপত্তি থেকে সমুদ্রে পতিত হওয়া পর্যন্ত সমন্বিত পানি স¤পদ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তিত হয়েছে। নদীগুলি প্রাকৃতিক স¤পদ। মানবসৃষ্ট রাজনৈতিক সীমানায় তাদের ভাগ করা যায় না। একটি যৌথ অববাহিকাব্যাপী ব্যবস্থাপনায় নদী অববাহিকার দেশগুলি জানতে পারবে নদীর বিভিন্ন স্থানে কী ঘটছে। অববাহিকার দেশগুলিকে নদীগুলির পরিষেবা পেতে হলে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে একে অন্যের সাথে হাত মেলানো উচিত। এটি করা না হলে বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা ঘন ঘন এবং বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে তা আরো সর্বনাশা হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, নদীগুলি যদি সমুদ্রে প্রবাহিত হতে থাকে তবে অববাহিকার দেশগুলি অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং ইকোসিস্টেম (জীবজাগতিক) পরিষেবাগুলি পাবে। পাশাপাশি উজানে এবং ভাটিতে প্রতিবেশীদের মধ্যে শান্তির যুগ সৃষ্টি হবে। পরিশেষে, সতর্কতার একটি বার্তা দেয়া দরকার। পরিবেশগত অবনতির কারণে মানুষের কাছে যখন জীবনযাপন এবং জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ে, তখন তারা স্থান ত্যাগ করে আভিবাসী হয়। মানুষ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, সীমান্তের ওপার এবং সাত সমুদ্র, তের নদী পার হয়েও জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। তাই আমাদের পরিবেশের অবনতি করা সমীচীন নয় এবং জীবিকার জন্য মানুষকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা উচিত নয়।
লেখক: ইংরেজি অনলাইন দৈনিক গ্রিনওয়াচ পত্রিকার স¤পাদক ও নিউ নেশন পত্রিকার সাবেক স¤পাদক।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা
ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৮৬
রাজশাহীর বাঘায় আম বাগানে যুবকের লাশ
মতামত গ্রহণে ওয়েবসাইট চালু করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
ওরেশনিক সমগ্র ইউরোপে হামলা করতে পারে: রুশ কমান্ডার
দানে পাওয়া কাপড়ের মনোরম ডিজাইনে ভাইরাল ভারতীয় একদল ডিজাইনার
কেমন হল ভিভো ভি৪০ লাইটের অভিজ্ঞতা!
তাদের রাজনীতি করতে দেবে কি-না তা দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে: জামায়াতে সেক্রেটারি
উত্তরায় হাসপাতালে সন্ত্রাসী হামলাও লুটপাটের ঘটনায় থানায় মামলা
পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৩২
আল্লাহকে পেতে হলে রাসুলের পথ অনুসরণ অপরিহার্য: মাওলানা রুহুল আমিন খান
ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে : ডিএমপি কমিশনার
ভোটের মাধ্যমে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবন্ধ থাকতে হবে-লুৎফর রহমান আজাদ
গফরগাঁওয়ের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুছ ছালামের ইন্তেকাল
আওয়ামী দোসররা মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে: তানভীর হুদা
ফিলিস্তিনিদের জন্য কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে মিশরে পৌঁছেছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল
১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি
বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ
ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের