ফারাক্কা : ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম
বাংলাদেশ থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ ও চালুর পর গত পাঁচ দশকে এটি গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। সোজা কথায় এটি আজ বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এই নদী এবং পানিসম্পদ কারো একক সম্পদ নয় যে, চাইলেই নিজে ব্যবহার করবে এবং ন্যায্য অধিকার থাকা সত্ত্বেও অন্যকে বঞ্চিত করবে। পদ্মায় বর্তমানে শুকনো মওসুমে পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। এর বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণে ও পশ্চিমাঞ্চলে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। অসংখ্য নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রায় শতাধিক নদীর মধ্যে ৫৪টির মূল উৎস তিববত, নেপাল, ভুটান ও ভারতের পর্বতময় অঞ্চল। ফলে পানির অবাধ প্রবাহ ফারাক্কার মত বাঁধগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, এই বাঁধের প্রভাবে দেশের মানচিত্র থেকে প্রায় ৪৯টিরও বেশী নদ-নদী ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে এবং আরো প্রায় ১০০টি ছোট-বড় নদী একই পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন ক্রমশ: ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করলে নদীর পানি ঠেলে সেই লোনা পানিকে সমুদ্রে ফেরত পাঠায় । কিন্তু ফারাক্কার কারণে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত পদ্মা অববাহিকায়। এই লবণাক্ততার ফলে এদেশের বিরাট্ অংশের ক্ষেত-ক্ষামার, শিল্পকারখানা আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। মৎস্য ও পশু সম্পদ বিলুপ্ত হবার পথে। পদ্মার উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ জীবিকা হারা। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই শুধু নয়, বাংলাদেশের উপর আর্থ-সামাজিক একটি বড় বিপর্যয় ধেয়ে আসছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধুমাত্র বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে ক্ষতি হচ্ছে প্রতি বছর গড়ে একহাজার কোটি টাকা! নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্যের সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কাসহ এধরণের বিভিন্ন বাঁধের নির্মাতা ভারতের পানি আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশের প্রায় ২০০০ মাইল নৌপথ আজ এক চতুর্থাংশ কমে প্রায় ৫০০ মাইলে সংকুচিত হয়েছে।
মানবসৃষ্ট এই দুর্বিপাকে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শুকনো মওসুমে নদীর পানি কমে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নীচে নেমে গেছে। ফলে টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের পানীয় জল ও গৃহস্থালী কাজে পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। আর এ অবস্থায় দেশ মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গঙ্গার এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয় আরও ভয়াবহরূপ নিয়েছে। লবণাক্ততা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ, যা বিশ্ব হেরিটেজ নামে পরিচিত, ধ্বংসের মুখে। পদ্মার একটি বড় শাখা নদী গড়াই কার্যত শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে খুলনার আশপাশে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৫০০ মাইক্রোমোস এবং ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের ফলে খুলনার লবণাক্ততা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ মাইক্রোমোস। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেও বেশি। আর পরোক্ষ ক্ষতির হিসেব দাঁড় করালে সে ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফারাক্কা বাঁধ আজ বুমেরাং হয়ে ভারতেরও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার উজানে বিপুল পরিমাণ পলি জমে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে ভারতের বিহারসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি আটকে রাখার ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশ। ফারাক্কার প্রভাবে নদীর স্বাভাবিকতা হারিয়ে গঙ্গার উজানে বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক কালে এক বন্যায় বিহারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল অন্তত ২০ লাখ। এর ফলে বিহারের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফারাক্কার সমস্যা তুলে ধরে এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের দাবী জানিয়ে ফারাক্কা বাঁধ অপসারনের কথা বলেছিলেন।
ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের সাথে ভারত কখনই সেই অর্থে আন্তরিক সুপ্রতিবেশী ও বন্ধুসুলভ মনোভাব দেখায়নি। বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উপর আন্তর্জাতিক সকল আইন-কানুন, নিয়ম-নীতিকে অগ্রাহ্য করে পানিসম্পদ উজান থেকে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। পাহাড় ও পর্বতশৃঙ্গসমূহে সৃষ্ট জমা বরফগলা পানিপ্রবাহ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বাঁধ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রবাহপথ রোধ করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে দিনের পর দিন স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হরণ করে নিচ্ছে। ফারাক্কাসহ আরো অন্যান্য নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ইচ্ছেমত পানিপ্রবাহকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের উঁচু ও মরু অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চল, এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকাসহ সবকিছুই নির্ভরশীল নদী ও তার পানির উপর। বাংলাদেশের নদীগবেষণা ইনস্টিটিউট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম ইনামুল হক এব্যাপারে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন: ‘ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার আগে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার হাজার কিউসেক। ফারাক্কায় ওদের ডাইভারশন ক্যানেল, ব্যারেজের মাধ্যমে তারা ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নিতে পারে। সেটি সরিয়ে নেয়ার পরে যেটি থাকে সেটি পায় বাংলাদেশ। গঙ্গা চুক্তিতে অন্তত ২৭ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের।’
ফারাক্কা সমস্যার সূত্রপাত ঘটে ’৫০ দশকের গোড়ার দিকে। গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগের খবর জেনে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি সরকারের প্রতিবাদের উত্তরে ভারত ১৯৫২ সালে জানিয়েছিল যে, গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই রয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত প্রথম এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সাথে বৈঠকে বসে। এ প্রক্রিয়া চলা অবস্থাতেই ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বেই ১৯৭০ সালে ফিডারখাল ব্যতিত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করে ফেলে ভারত। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ফিডার ক্যানেল চালুর কথা বলে ভারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঐ ৪১ দিনের পরিবর্তে ৫০ বছর ধরে চালু আছে। ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক চাপে ভারত বাংলাদেশের সাথে একাধিক পানি চুক্তি করলেও ভারত কোনোদিনই সেই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশকে পানি দেয়নি। বাংলাদেশের কোন আহবানেই ভারতের তরফ থেকে সাড়া না পেয়ে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ফারাক্কার বিষয়টি উত্থাপন করেন। ফলে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয় ভারত। এরই ফলে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী এ চুক্তিতে বাংলাদেশের ন্যূনতম পানি প্রাপ্তির জন্য ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের ফলে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে যে অর্জন আসে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে সমঝোতার মাধ্যমে সে অর্জনকে দুর্বল করে ফেলা হয়। ১৯৭৭ সালের পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লোজ থাকায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯২ সালের মে মাসে নয়াদিল্লীতে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের এক বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অন্যান্য প্রধান নদীর পানি প্রবাহ বণ্টনের জন্য সমতাভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ফারাক্কায় গঙ্গার পানি প্রবাহ সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি সমস্যা এড়ানোর জন্য সব প্রচেষ্টা চালানো হবে। কিন্তু পরে ভারতের পক্ষ থেকে এ চুক্তির ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি ।ফলে ১৯৯৩সা লের ১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার ভাষণে ফারাক্কা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।১৯৯৫ সালের মে মাসে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি আবারো উত্থাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা সমাধানের কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। ফলে ১৯৯৫ সালের ২৩ আক্টোবর জাতিসংঘের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ফারাক্কা প্রসঙ্গ পুনরায় তুলে ধরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষ গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় এই ৪ কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত হয়েছে। তিনি এই সংকট সমাধানের সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘে সমবেত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকট এ আহ্বান জানান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি ইস্যু নিয়ে ৩০ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদী দুর্বল একটি চুক্তি করেন। কিন্তু ৩ মাসের মধ্যেই সে চুক্তি ভারত অকার্যকর করে দেয়। ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ মাত্র ৬ হাজার ৪৫৭ কিউসেক পানি পায়, যা ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক। চুক্তির শর্ত অনুসারে ফারাক্কা পয়েন্টে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার কিউসেক পানি থেকে বাংলাদেশকে ভারত ৫০ হাজার কিউসেকের সমানভাবে অর্ধেক (২৫ হাজার কিউসেক) পাবে এবং বাকি ২০ হাজার কিউসেক ৭ নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে। ১৯৭৭ সালের পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লোজ ছিল কিন্তু এ চুক্তিতে তা না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য ছিলনা। ফলে বাংলাদেশ পানি কম পেলেও তার প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। এছাড়া চুক্তিটিতে আন্তর্জাতিক সালিশীতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ নেপালের সাথে মহাকালী নদী চুক্তিতে ভারত আন্তর্জাতিক আর্বিট্রেশন মেনে নিয়েছে।
ফারাক্কা সমস্যার মত জাতীয় সংকটও যখন আমাদেরকে জাগাতে পারেনি, তখন আরও বড় বিপর্যয় আসবে এটাই তো স্বাভাবিক! এখন ভারত আন্ত:বেসিন নদী সংযোগ মহাপ্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। এখন ভারত শুধু ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানির সমস্যা সৃষ্টি করছে, তা নয়, আজ বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকের সীমান্তবর্তী এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজলডোবায় বাঁধ দেয়ার কারণে শুকনো মওসুমে গজল ডোবার নিম্নে শতকরা ১০ ভাগ পানিও থাকে না। তাই তিস্তা নদীতে বিরাট বিরাট চর পড়েছে। মানুষ নদীর এপার-ওপার পায়ে হেঁটে পার হচ্ছে শুকনো মওসুমে। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমির সেচ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তিস্তার পানি চুক্তির কথা ভারত ২০ বছর যাবৎ বলেও তা করছে না। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। মাত্র ৩টি নদীতে বাঁধ নেই, আর সবগুলোতে ব্যারাজ, ড্যাম, মাটির বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টিপাইমুখ ড্যাম দিয়ে ভারত বাংলাদেশের জন্য আরেক মরণ ফাঁদ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের কুশিয়ারা নদীর উজানে বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ১০০ কিলোমিটার দূরে বরাক নদীর উজানে ভারত টিপাইমুখ ড্যাম তৈরি করছে। এর উপর রয়েছে ভারতের আরেক ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি ছোট-বড় নদীর পানিপ্রবাহকে ৩০টি আন্ত:সংযোগ খালের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধের ভেতর দিয়ে যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে এবং এ ধরনের সংযোগ স্থাপন করে প্রায় ৭৫টি জলাধারে পানি সংরক্ষণ করে তা থেকে পরবর্তীতে পানিপ্রবাহ করে ভারতের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের খরাপ্রবণ রাজ্যগুলোতে পানিবণ্টন করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি প্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা হয়ে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও কর্ণাটক দিয়ে তামিলনাড়ু পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। গঙ্গার পানি নিয়ে যাওয়া হবে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটে। উভয় দিকের প্রবাহ প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ঘুরিয়ে আবার একত্রে আনা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে তা কল্পণাতীত ব্যাপার! অথচ এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অবাক ব্যাপার হলো এরূপ জীবন-মরণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েও আমরা চুপ করে আছি বছরের পর বছর জুড়ে। মানবসৃষ্ট এ চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে পারছিনা!
ভারত কর্তৃক এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট সমস্যা আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ পরোক্ষ ভাবে এর বিভীষিকায় ক্ষতিগ্রস্ত। একে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ আজ সময়ের দাবী। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান না হলে আমাদের আবার জাতিসংঘে যেতে হবে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। এ জন্য প্রকৌশলগত তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুত করতে হবে, পাশাপাশি ভারত সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ অনিবার্যভাবে প্রলয়ংকারী ধ্বংসের কবলে পড়বে। এদেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা একদা লিখেছিলেন: ‘ভারত ঠান্ডা মাথায় যে কাজটি করে যাচ্ছে তা হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর অমানবিক বোমা বর্ষণের চাইতে কম নিষ্ঠুর নয়। তার প্রলয়ংকরী প্রতিক্রিয়া সমূহ একসঙ্গে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিনা বলে আমাদের জাতির অধিকাংশ মানুষ চোখ বুঁজে এই জুলুম সহ্য করে যাচ্ছি।’
ফারাক্কা একটি রাজনৈতিক ইস্যু, রাজনৈতিক ভাবেই ইঁর সমাধান হতে হবে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বগুলো জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ মহাসংকটকালে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। আজ সময় এসেছে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশিদের এক কাতারে দাঁড়িয়ে দেশের স্বার্থের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হবার। নেতিবাচক রাজনীতি আমাদের জনগণের মন থেকে স্বাভাবিক অধিকারবোধটুকু যেন কেড়ে নিযেছে, যার ফলে লড়াকু এ জাাতি মুক্তিযুদ্ধের মত আরেকটি যুদ্ধ করে পানির উপর তাদের নায্য হিস্যার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা করতে পারছেনা।
যে জাতি লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে তারা ফারাক্কার মত একটি জীবন মরণ সমস্যাকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিবে এটা বিশ্বাস করিনা। প্রতিবেশী দেশ কর্তৃক অন্যায় পানি আগ্রাসনের মোকাবেলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে আমাদের দূর্ভাগ্যজনক ব্যর্থতা আমাদেরকে সমূহ সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। তাই জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বিশ্ব জনমতকে সুসংগঠিত করে জাতিসংঘের মাধ্যমে এ ভয়াবহ সংকটের উপযুক্ত সমাধানের প্রচেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে। জাতি একজন দেশপ্রেমিক, সাহসী, দূরদর্শী, নেতৃত্বের শূন্যতা প্রবলভাবে অনুভব করছে। জাতির এ ক্রান্তিকালে মাওলানা ভাসানীর মত একজন সিংহপুরুষের বড়ই দরকার। বাংলাদেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকটি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন এদেশের গণমানুষের নেতা, মজলুম জননেতা দূরদর্শী মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। অশীতিপর এ মানুষটি ভগ্ন শরীর নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে জাতিকে এক কাতারে সমবেত করতে ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর সে ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সাড়া দিয়ে আগ্রাসী শক্তির ভীতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
লেখক: প্রফেসর, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন, রাজশাহী শাখা।
[email protected]
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী শুধু ফ্যাসিস্ট নয়, তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট: মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন
নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান
‘ফিফা ছিল খুবই দুর্বল, আমিই একে বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছি’
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কাউকে রেহাই দেয়নি, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে পালিয়ে গেছেন: রিজভী