ইনকিলাব কখনও হতোদ্যম হয়নি
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম
সম্পাদকীয়- বিবিধ প্রসঙ্গ- উপসম্পাদকীয়- চিঠিপত্র সব প্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে সাহিত্য পাতার কিছু লেখা গুছিয়ে রাখছিলাম। আবদুল হক এসে বললেন, স্যার মহিউদ্দিন স্যারের রুমে চা দিয়েছি।
লেখার ফাইল রেখে গেলাম। চা শেষ করে মহিউদ্দিন ভাই সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, মনে আছে, ইত্তেফাকে এডিটোরিয়াল রুমে আপনার টেবিলে বসে দশ বছর আগে বলেছিলাম, ইত্তেফাক উঠছে আর আজাদ নামছে...।
বললাম, খুব মনে আছে।
মহিউদ্দিন ভাইয়ের কণ্ঠ গম্ভীর, এখন কী করবেন! আমরা কোনদিকে যাচ্ছি, আজাদ কোনদিকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন তো!
বললাম, পারছি, ভালই টের পাচ্ছি। মহিউদ্দিন ভাই ইত্তেফাক ছেড়ে আর্থিক কষ্ট অনেক করেছিÑ এটা ঠিকÑ আবার এটাও ঠিক মুজীবুর রহমান খাঁ সাহেব, আপনি, গাজী ভাই, সাইফুল্লাহ সাহেবÑ আপনাদের সাহচর্যসহ সবার আন্তরিক আচরণ, আজাদের সামগ্রিক পরিবেশ নিঃসন্দেহে উপভোগ্য। সাংবাদিকতার অতীত ঐতিহ্যের স্পর্শও পাচ্ছি। ইত্তেফাকের পারিবেশটা আমার কাছে একটু অন্য রকম মনে হয়েছে।
ইত্তেফাক ছেড়ে আমার আজাদ-এ আসার প্রথম কারণ ছিল মুজীবুর রহমান খাঁ’র কাছে থেকে কাজ শেখা। প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং আবুল মনসুর আহমদের সাথে তাঁর কথা আমার বাবার কাছে ছোটবেলায় শুনেছি। আমার আবেগের এই বিষয়টি মহিউদ্দিন ভাইকে তখন বলেছিলাম। আরও কিছু কথা আছেÑ সেসবের উল্লেখ আছে আমার ইত্তেফাক পর্বের শেষ আর আজাদ পর্বের শুরুতে।
আরেকবার চা-সিগ্রেট শেষে মহিউদ্দিন ভাই বললেন, শোনেন, একটা কাগজ বের হবে, এরকম কথা চলছে। শুনলে প্রথমদিকে একটু কেমন কেমন লাগতে পারে। তবে দশ বছর আগে যা বলেছিলাম,। হতে পারে, এবার হয়ত তা বলতে হবে না আমি মনে করি। চিন্তা করা দরকার, আপনার সামনে অবারিত সময় এবং সম্ভাবনাÑ দুটাই রয়েছে।
বললাম, মহিউদ্দিন ভাই, আজাদ তো শেষ ধাপে, আবার সোজা হয়ে দাঁড়াবে, তেমন তো মনে হচ্ছে না। যদি ভালো কাগজ হয় আর আপনি যান, আমি যাব আপনার সাথে। আপনার কর্মপ্রক্রিয়া সুবিন্যস্ত, আবেগ, যুক্তি ও সৌজন্যশাসিত। আরও একটা কথা, আপনি কথা কম বলেন, আমি কথা বেশি বলি, ভারসাম্য বজায় রাখায় এটা দরকার!
মহিউদ্দিন ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন, পাগল, বয়স কত হল!
বললাম, সাতাশ বছর তিন মাসের শুরুতে আজাদ-এ মুজীবুর রহমান খাঁ সাহেবের নেতৃত্বে আপনার সাথে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন আটত্রিশ, দু’বছর পর পরিবর্তনের সময়!
দু’বছর আগেও তো হতে পারে বলে মহিউদ্দিন ভাই ঘড়ি দেখে টেলিফোনের রিসিভার তুলে বললেন, রাখেন, তারপর কোথাও ডায়াল করলেন, কিছু স্পষ্ট কিছু অস্পষ্ট দুয়েকটা কথার পর রিসিভার রেখে আরেকটা সিগ্রেট ধরালেন। চেইনস স্মোকার মানুষ। আজাদ অফিসে সবাই মিলে যত সিগ্রেট টানতাম, অনুমান করি, মহিউদ্দিন ভাই একাই শেষ করতেন তার অর্ধেকের বেশি! খাঁ সাহেব সিগ্রেটের তিনভাগের একভাগ টেনেই অ্যাসট্রেতে ফেলতেনÑ মহিউদ্দিন ভাই ফেলতেন অর্ধেকে পৌঁছে। আর আমি তো অফিসে সম্পাদকীয় মিটিংয়েÑ যাক, এ নিয়ে মজার গল্প আছে আজাদ পর্বে।
মহিউদ্দিন ভাই বললেন, আপনাকে পরশুদিন এক জায়গায় নিয়ে যাব, লেখা সব প্রেসে পাঠিয়েছেন তো! চলেন উঠি।
বাইরে বেরিয়ে এতিমখানা রোডের মোড়ে মহিউদ্দিন ভাই প্রতিদিনের মত আগা সাদেক রোডের রিকশা নিলেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরে ধানমণ্ডি শংকরে নেমে বামদিকে শংকরের শেষ বাড়িতে।
আজাদ থেকে স্কুটারে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে মহাখালি আমতলী মসজিদের সামনে নামলাম। তখনও এই জায়গাটা একমত ফাঁকাই। মসজিদের পেছনে দুই ভবনের মাঝখান দিয়ে রেল লাইন দেখা যাচ্ছে। পাশের এক ভবনে গেলাম। পরে জানলাম, এটা জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অফিস। এখানে কেন, এই প্রশ্নের ঘোর কাটার আগেই অফিসে ঢুকে গেলাম। আমাদের বসতে বলে যিনি ভেতরে গেলেন তিনি দ্রুতই বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন।
মাওলানা মান্নান সাহেব হাত মিলিয়ে বললেন, মহিউদ্দিন সাব একটু বসেন, আমার দু-তিন মিনিট লাগবে।
মাওলানা মান্নান সাহেব জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতিÑ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ছবি দেখেছি। সামনাসামনি প্রথম দেখলাম। উনি পত্রিকা বের করবেন!
ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। উনার সামনে এখন শুধু আমরা দু’জন। মহিউদ্দিন ভাই আমার পরিচয় দিলেন। এর মধ্যে চা-নাশতা এল। সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল খাঁ সাহেবের কাছে শোনা প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র ডাল-ভাতের দাওয়াতের বিবরণ!
মাওলানা সাহেব আমার বাড়ি ময়মনসিংহ শুনে বললেন, ময়মনসিং তো সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের এলাকা, কী মহিউদ্দিন সাব, ঠিক না!
মহিউদ্দিন ভাই বললেন, জি¦ হুজুর। ইউসুফ সাবও গল্প-উপন্যাস লেখেন।
মাওলানা সাহেব বললেন, ইউসুফ সাবকে কী আমাদের গল্পটা বলেছেন!
মহিউদ্দিন ভাই বললেন, কিছুটা বলেছি হুজুর, আপনি বলুন।
মাওলানা সাহেব এক বাক্যে ইনকিলাব-এর পরিকল্পনার অনেকটাই বলে ফেললেন!
আমি হঠাৎ বললাম, ইনকিলাব কী জাতীয় দৈনিক হবে, নাকি আপনার অন্য কোনÑ।
উনি মুচকি হাসলেন, আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। শুধু জাতীয় দৈনিক না, প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক, মেশিনারি থেকে শুরু করে সবকিছু লেটেস্ট মডেলের। পুরো অফিস হবে সেন্ট্রাল এসি, একদম বিদেশি প্যার্টানে।
থেমে গিয়ে বললেন, আমার অনেকদিনের চিন্তা, হঠাৎ কোন বিষয় নয়। বিদেশে বসেও ভেবেছি, কী মহিউদ্দিন সাব!
আবার থামলেন। ধীর-স্থির কণ্ঠে বললেন, আমি জানি আপনারাও জানেন, সেরা মেশিনপত্র-বিদেশি প্যার্টানের বড় অফিস-সেন্ট্রাল এয়ারকণ্ডিশনÑ এ সবে বড় কাগজ হবে না, হয় না। মহিউদ্দিন সাব আছেন, আপনি আসবেন। কাজ করতে পারেন এমন বাছা বাছা লোক আনবেন আপনারা, ইনশাআল্লাহ ইনকিলাব হবে।
আবার থেমে বললেন, সানাউল্লাহ নূরী সাব, আখতার-উল আলম সাবকে পছন্দ করি, ঝুঁকি তো সবাই নিতে চান না, নেন না। আমি রেডি ঝুঁকি নিতে, কী মহিউদ্দিন সাব, আপনারা ঝুঁকি নিতে পারবেন না?
মহিউদ্দিন ভাই বললেন, আল্লাহ ভরসাÑ আমার তো সংবাদপত্র জগতে ভালো কিছু করতে চাই!
মাওলানা সাব অনেক কথাই বললেন, অনেক কিছু বললেন। তার কথা, কণ্ঠের দৃঢ়তা, স্বপ্নমগ্ন দৃষ্টি উদীপ্ত করার মতÑ উদীপ্ত না হয়ে পারা যায় না।
আমি কাগজে-কলমে ইনকিলাবে যোগ দিই ১৪ জুন ১৯৮৬। আজাদ সম্পাদক জয়নুল আনাম খাঁ সাহেবের অনুরোধে এই ক’দিন থাকতে হয়েছিল। অবশ্য আগের মতই আজাদে কাজ শেষ করে বনানী চার নং রোডে মাওলানা সাহেবের বাড়িতে চলে আসতাম। ওই বাড়ির একটা ড্রয়িং রুমে সম্পাদকীয় বিভাগ শুরু হয়েছিল। ওখান থেকে সন্ধ্যায় মহিউদ্দিন ভাই আর আমি যেতাম বনানী ১০ নম্বর রোডে, যেখানে ছিল নিউজ-রিপোর্টিং-ফটো কম্পোজ সেকশন। সেখানে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে তাঁর কক্ষেই বসতাম। বনানী এক নম্বর রোডে ছিল প্রশাসন, বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন সেকশন। সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন সাহেব বসতেন ওই ভবনে।
দৈনিক ইনকিলাব-এ সাংবাদিক জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে। শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় ২৯ বছর। এর আগে এগার বছর দৈনিক আজাদ-এ এবং ইত্তেফাক-এ তিন বছরÑ প্রায় ৪৩ বছরের সাংবাদিক জীবনে তিনটি প্রথমশ্রেণীর জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে, চল্লিশ বছরই শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালনের সমুদয় স্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা খুবই স্বাভাবিক।
গত দশ বছরের অবসর জীবনে আমার সাহিত্য-কর্মের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা, কিছু পূর্বপরিকল্পিত নতুন লেখাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি বলেই আমি ইনকিলাব ছেড়েছিলাম। গল্প-উপন্যাসগুলো মোটামুটি শেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৈনিক ‘আজাদ পর্বে’র স্মৃতিকথার খসড়া শেষে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর স্মৃতিকথা শুরু করেছি। স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ব্যক্তি এবং ঘটনাই অবলম্বন করতে হচ্ছে। কারণ, আমি গল্প-উপন্যাসের প্রচুর নোট করলেও সাংবাদিকতা-জীবনের ডায়েরি রাখা হয়নি। গত কয়েক বছর মূলত স্মৃতি থেকেই নোট করে ‘আজাদ পর্বে’র খসড়া দাঁড় করাচ্ছি। প্রতিদিন প্রথম আগের লেখাটুকু পাঠ করতে গিয়ে যোগ-বিয়োগ হয়, আবার পরদিন একই প্রক্রিয়ায় চলে লেখাÑ এভাবেই ‘আজাদ-পর্বে’র খসড়া এখন শেষ পর্যায়ে। শুরু করেছি ‘ইনকিলাব পর্বে’র কাজÑ টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো লিখছি।
ইনকিলাবে আমার প্রায় ২৯ বছরের স্মৃতিমগ্ন সময়ের কথকতা লিখতে গিয়ে সঙ্গতকারণেই স্মৃতি যতটা আসছেÑ তারচেয়ে বেশি আসছে জাতীয় জীবনে বাস্তব প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার কথা এবং তার প্রেক্ষিতে ইনকিলাবের ভূমিকা প্রসঙ্গ। আজাদ-এ ছিল প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক- সাহিত্য ও জাতির পথরেখা-বিশ্লেষক মুজীবুর রহমান খাঁ’র কাছ থেকে প্রায় এক দশককাল আমার গ্রহণ করার সময়। এই মহান মানুষটির কাছ থেকে তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাতির সাংবাদিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি যতটা জেনেছি, তারচেয়ে বেশি জানতে পেরেছি এসবের পেছনে ইতিহাস, উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রভাব-প্রবণতার কথা, যা ঘটনার অন্তরালের বিষয়াদি শনাক্তকরণ সহজতর করেছে। যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে, উপনিবেশ-উত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সর্বোপরি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জাতীয় অগ্রগতির চিন্তা-ভাবনা! আমার ধারণা, মহিউদ্দিন ভাইও চিন্তা-চেতনার এই বিশ্বাস-বিন্যাস দ্বারা তাড়িত ছিলেন বলেই ঘটনা বিশ্লেষণ, লাইনআপ নির্ধারণে দৃঢ়তা ছিল আমাদের সবার মধ্যে। ছিল স্বচ্ছচিন্তা-সংযোগ-সমন্বয়-সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সৃজন-মনন শক্তির প্রয়োগ।
সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন প্রথম দিন থেকেই প্রশাসন, বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন, হিসাব বিভাগের গুরুদায়িত্ব সামলেও সম্পাদকীয়-বার্তা-রিপোর্টিং-রিডিং, যৌথ সভায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। মাওলানা রূহুল আমীন খান একই মনোভাব লালন করতেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনে ঘনিষ্টভাবে জড়িত থেকেও তিনি যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। মহিউদ্দিন ভাই যে বিকেলে আমাকে মাওলানা এমএ মান্নান সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে যান, সেদিনই দেখা হয় মাওলানা রূহুল আমীন খানের সাথে।
উনি বোধহয় কোথাও যাচ্ছিলেন, প্রথমদিন কথা না হলেও পরবর্তীতে ‘কবিসাব হুজুর’ বলে সুপরিচিত এই কাব্যমগ্ন মানুষটির সঙ্গে ইনকিলাব অফিসে তাঁর কক্ষে, আমার কক্ষে কত কথা যে বলেছি! মাঝেমধ্যে মহিউদ্দিন ভাই এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বলতেন, কী ব্যাপার বাড়ি যাবেন না!
অবসর গ্রহণের পর ইনকিলাবের যাত্রা এবং অবিশ্বাস্যপ্রায় উত্থান প্রসঙ্গে কয়টি বিষয় মাঝেমধেই মনে পড়ে। কী কারণে ইনকিলাব দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সর্বশীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল? একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের অন্তর্গত চাহিদা ইনকিলাব কিভাবে নির্ণয় করে মিটিয়েছে? প্রচলিত সংবাদ-মাধ্যম থেকে দৃশ্য-অদৃশ্য অতিরিক্ত কি বা কি কি দিয়েছে ইনকিলাব তার পাঠকদের? অন্তর্গত এমন কোন্ বোধ-চৈতন্যকে ইনকিলাব ধারণ করেছে, যা পাঠকদের অশনাক্ত কিংবা অকথিত চাহিদা মিটাতে পেরেছে?
ইনকিলাবের চূড়ান্ত পরিকল্পনাকালীন সময় থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে জড়িত থাকায় স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে শুরুতেই এই বিষয়গুলো সামনে এসেছে। তবে সব প্রশ্নের জবাব আছে ইনকিলাব-এর পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায়। আমার ইনকিলাব পর্বে এসবের বিশদ আলোচনা থাকছে। এখানে এটুকুই বলা যায়Ñ সংবাদ-মাধ্যম হিসেবে দৈনিক ইনকিলাবের নিজস্ব অবস্থান আছে এবং সেই অবস্থানে থেকেই ইনকিলাব তার জীবনের আটত্রিশটি বছর পার করেছে। ইনকিলাবের দীর্ঘ এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না, নানা টানাপড়েন, চরাই-উৎরাই পার হয়ে চলতে হয়েছে। তবে এটা লক্ষ্য করা গেছে, ইনকিলাব কখনই হতোদ্যম হয়নি, হতাশ হয়নি, নীতি-আদর্শ-লক্ষ্য অক্ষুন্ন রেখে পথ চলেছে কখনও দ্রুতÑ কখনও ধীর গতিতে। জাতীয় দৈনিক হিসেবে দেশের জনগণের প্রতি অন্তর্গত আস্থা-শক্তি কখনও স্তিমিত হয়নি। জনগণও কখনও তাদের এই মুখপত্র, যা ‘শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে’, তার ওপর থেকে আস্থা হারায়নি। এটাই ইনকিলাবের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। দেশবাসীর প্রেরণা-সমর্থন অতীতের মত আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, এটা আশা করা যায়।
ইনকিলাব জাতীয় উন্নয়ন-উৎকর্ষের কথা, জাতীয় স্বার্থের কথা বলেছে এবং কখনই সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধির বিনিময়ে তা বলেনি। সত্য-ন্যায়-মানবিকতাকে ইনকিলাব সব সময় সামনে রাখতে চেয়েছে। কখনও ব্যক্তির নয়, প্রয়োজন ক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্ম-আচরণকে বিবেচনায় নিয়েছেÑ আলোচনা করেছে। কারও ভাল লেগেছে, কারও ভাল লাগেনি। আর এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সব সংবাদপত্রেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং তজ্জাত চিন্তা-ভাবনা থাকতে পারে, থাকেও। তবে সত্যিকার জাতীয় সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়Ñ সর্বোতভাবে জাতীয়স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তার নিরিখেই সকল চিন্তা-ভাবনা ও ভূমিকা গ্রহণ। জাতীয় দৈনিক হিসেবে ইনকিলাবও এই ভূমিকা পালন করে চলেছে। সংবাদপত্র সাধারণত পাঠকদের জন্য সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি ঘটনা-প্রবাহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সম্পাদকীয় মন্তব্যও করে থাকে। সাধারণত দেশের স্বার্থ ও জনগণের মতামতই সংবাদপত্রের কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনিত হয়। এই দায়িত্ব ইনকিলাব শুরু থেকে নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে। দৈনিক ইনকিলাবে ৩৮ বছরে প্রায় ২৫ হাজারের মত সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, যাতে উল্লেখিত কথাগুলোর সারবত্তা কমবেশি প্রতিফলিত হয়েছে।
দেশ ও জনগণের পক্ষে ভূমিকা রাখা, অব্যাহত ভূমিকা রাখা জাতীয় সংবাদপত্রের দায়িত্বÑ ইনকিলাবের দায়িত্বও এটাই। কথা ছোট, কিন্তু কাজটি জাতির আবেগ- চাহিদার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই ছোট নয় কিংবা কাজটি না করলে চলবে, এমনও নয়। ইনকিলাব তার পথচলার শুরু থেকে এব্যাপারে জাগ্রত বোধ-চেতনার সাক্ষর রেখেছে। এই আটত্রিশ বছর ধরে যাঁরা ইনকিলাবের সাথে পাঠক হিসেবে- বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে- এজেন্ট হিসেবে এবং সর্বোপরি শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আছেন, তাঁরা এটা জানেন বলেই আছেন।
জাতীয় দৈনিক নিজস্ব দায়িত্বশীলতার তাগিদেই অন্য কারও ভাল লাগুক বা না লাগুক সেই অপরিহার্য দায়িত্বগুলো পালন করে থাকে, যা ইনকিলাব শুরু থেকে করে আসছে। দেশ- জাতির আবেগ-ঐতিহ্যÑ মর্যাদা-স্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রশ্ন যেখানে, সেখানে অন্য কোন বিবেচনা ইনকিলাবের কোন বিচলন ঘটাতে পারেনি। তিন যুগেরও বেশি সময় পার করে ইনকিলাব আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সময়ানুগ পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটেছে, আরও ঘটবে। এসবের মধ্য দিয়ে উপর-কাঠামোগত পরিবর্তন অবশ্যই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবং আরও হবে, তবে এর আত্মগত যে বোধ-চেতনাÑ নৈতিক নির্দেশনা বিশেষ করে দেশ-জাতি-জনগণের আবেগ-আকাক্সক্ষাজাত যে চাহিদা, এই সব আত্মিক বিষয়ে গণমুখিনতা থেকে ইনকিলাব বিযুক্ত হতে পারবে না। দৈনিক ইনকিলাবের সম্মানিত সম্পাদক প্রিয়জন এএমএম বাহাউদ্দীনকে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সম্পাদকীয় কর্মকাণ্ডে যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি তাতে এই কথা বলা যায়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভদিনে ইনকিলাবকে অশেষ অভিনন্দন। ইনকিলাব-এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এম মান্নানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আন্তরিক অভিনন্দনÑ মেধাবী সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীনকে, যিনি সহজাত মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ইনকিলাবকে ৩৯ বছরের দ্বার গোড়ায় নিয়ে এসেছেন। কোন সম্পাদক এত দীর্ঘ সময় একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক সম্পাদনা করেছেনÑ দায়িত্বে অবিচল থেকেছেন, এটা বিরল নজিরই বলতে হয়।
ইনকিলাবের পরিকল্পনাকালীন সময় থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষদিন পর্যন্ত সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে আনন্দময় সুন্দর সময় আমি কাটিয়েছি দৈনিক ইনকিলাবে। সম্মানিত সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের অশেষ সহযোগিতা এই দীর্ঘ কর্মকালে আমাকে বরাবর উদ্দীপ্ত রেখেছে, অপরিমেয় আনন্দের সাথে এই কথাটি উল্লেখ করছি।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী সরকার শুধু ফ্যাসিস্ট নয় তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট : অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন
নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান
‘ফিফা ছিল খুবই দুর্বল, আমিই একে বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছি’
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কাউকে রেহাই দেয়নি, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে পালিয়ে গেছেন: রিজভী
স্বৈরাচার সরকারের দোষররা এখনো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে: রফিকুল ইসলাম খান