ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩ কার্তিক ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জেড ফোর্স

Daily Inqilab ড. মো. আবুল কালাম আজাদ

০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

স্বৈরাচারের কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের জন্য দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রকৃত ইতিহাস হারিয়ে যেতে বসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান এবং তার স্মৃতি বিজড়িত সব নিদর্শন মুছে ফেলাই যেন ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের সকল অবদান পাঠ্যপুস্তক এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। তাই বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের অবদানের কথা যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল।

১৯৮১ সালের ৩০ মে, জিয়াউর রহমান চলে গেছেন, সকল বাঙালির হৃদয় মরুভূমি করে। কিন্তু তার গঠিত জেড ফোর্সের অবদানের কথা মনে পড়লে যেন আজও হৃদয় কাঁপে। জেনারেল এম এ জি ওসমানী প্রবাসী সরকারের সম্মতিতে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই মেঘালয় রাজ্যের ছোট্ট শহর তুরা থেকে মাইল দশেক দূরে তেলঢালা নামক বনভূমিতে ১ম, ৩য় এবং ৮ম ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধানদের উপস্থিত হতে বলেন। ঐ বৈঠকে উল্লেখিত তিনটি পদাতিক সামরিক বাহিনীকে ইন্টেগ্রেট করে জেড ফোর্স নামক প্রথম দুর্ধর্ষ সামরিক ব্রিগেড গঠিত হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর জেড দিয়ে এই ফোর্সের নামকরণ করা হয়।

জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ১৭ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধে আলফা কোম্পানি’র হয়ে যে বিরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তার স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘হেলালে জুরুত’ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান ছিলেন পাকিস্তানী অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়া এবং তার সহকারী কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর জিয়া। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা ‘সোয়াত’ জাহাজের অস্ত্র খালাস তদারক করার জন্য মেজর জিয়াকে নির্দেশ দেন জানজুয়া। নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে ২ জন পাকিস্তানী অফিসার ও পাঞ্জাবী ট্রাক চালকসহ রওয়ানা দিলেন তিনি। আগ্রাবাদে এসে ট্রাকটি ব্যারিকেডে থেমে গেলো এবং ঐ সময়ে অন্য প্রান্ত থেকে মেজর খালিকুজ্জামান জানালেন, পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্টে হামলা শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়া বলে উঠলেন ‘উই রিভোল্ট’। জিয়া তাঁর এসকর্ট অফিসারদের নিরস্ত্র করলেন এবং নিজের জান বাজি রেখে কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াকে আটক করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং দায়িত্ব নিলেন।

তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’ এরপর থেকে সামরিক বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সকলের কাছে মেজর জিয়া পরিচিত হয়ে উঠেন। জেড ফোর্স গঠনের পরদিন থেকে একটানা ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রশিক্ষিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ যুদ্ধকে জোরদার করার জন্য ডাইহার্ড স্ট্যামিনা আর ডু অর ডাই আত্মপ্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রায় সারাদিন সৈনিকদের ট্রেনিং চলত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রৌমারী মুক্তাঞ্চল থেকে প্রায় ১৮০০০ মুক্তিযোদ্ধা জেড ফোর্সের তত্ত্বাবধানে সরাসরি প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। জেড ফোর্স গঠিত হওয়ার পর এই ফোর্সের যুদ্ধের দায়িত্ব পড়ে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। জেড ফোর্স জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও রৌমারী এলাকায় যুদ্ধ করে এবং অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলকে মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে সাহসী ভূমিকা রাখে। জেড ফোর্সের অধিনায়ক প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সাথে দু’বার সরাসরি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রথমবার ৩১ জুলাই ১৯৭১ ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীনের সাথে রণাঙ্গনে থেকে শেরপুর জেলায় সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার কামালপুর গ্রামের নকশী বিওপিতে (বর্ডার আউট পোস্ট) ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে অপারেশন চালান। ঐদিন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুজ্জামান সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্য জেড ফোর্সের ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক পদক পেয়েছেন, যা অন্য দুটি ব্রিগেড কমান্ড তো দূরের কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর একটিও নেই। দ্বিতীয়বার ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ সিলেটের গৌরিপুরে ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সেই সময় মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন হাফিজ (বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য) ৩-৪ ঘণ্টা একই ব্যাংকারে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন। ঐ ব্যাংকার থেকে মাত্র ১০০ গজ পূর্বদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হন। ঐ গোলাটি যদি ১০০ গজ পশ্চিম দিকে পড়ত, তাহলে মেজর জিয়া ঐদিন শহীদ হতেন। পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল কামালপুরে এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের কামালপুর অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুবসহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়। এছাড়াও ঘাসিপুরে ৮০ জন, কোটালকাঠির যুদ্ধে ৭০ জনসহ অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তাজউদ্দিন আহমেদ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে জিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধকে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী শহরে যে প্রতিরোধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। তাজউদ্দিন আহমেদ তার ভাষণে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রথম বাঙালি আর্মি অফিসার যিনি ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জেড ফোর্সের মাধ্যমে রণাঙ্গনে নিজে যুদ্ধ করেন এবং প্রকৃত যোদ্ধা তৈরি করেন। এমন সাহসী ফোর্স কমান্ডার যে কোনো জাতির ইতিহাসে বিরল। জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বটবৃক্ষ এবং মহানায়ক। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে স্মরণীয় করার দায়িত্ব এখন এই প্রজন্মের কাধে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে তার গঠিত জেড ফোর্সের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রামাণ্য চিত্র, শর্ট ফিল্ম তৈরি করতে হবে এবং তা পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আবাসিক হলে ছাত্রদলের পোস্টারিং, মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি

আবাসিক হলে ছাত্রদলের পোস্টারিং, মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি

আগামীর বাংলা হবে ইসলামের বাংলা ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কিছু মানবো না

আগামীর বাংলা হবে ইসলামের বাংলা ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কিছু মানবো না

যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমান

যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমান

মার্কিন নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ে ট্রাম্পকে ড. ইউনূসের অভিনন্দন

মার্কিন নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ে ট্রাম্পকে ড. ইউনূসের অভিনন্দন

সৈনিক-জনতার একতার অঙ্গীকার

সৈনিক-জনতার একতার অঙ্গীকার

তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

৭ নভেম্বর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক

৭ নভেম্বর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক

কেশবপুরের ত্রাস টিটু যৌথ বাহিনীর হাতে আটক

কেশবপুরের ত্রাস টিটু যৌথ বাহিনীর হাতে আটক

সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন

সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন

যশোরে বিদেশি পিস্তল-বুলেট ও মাদকসহ আটক ২

যশোরে বিদেশি পিস্তল-বুলেট ও মাদকসহ আটক ২

জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ

জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ

৭ নভেম্বরের তাৎপর্য

৭ নভেম্বরের তাৎপর্য

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস

ইসরাইলি অর্থনীতির ভবিষ্যত অন্ধকার, বেকারত্ব বেড়েছে

ইসরাইলি অর্থনীতির ভবিষ্যত অন্ধকার, বেকারত্ব বেড়েছে

মেলানিয়াকে ফার্স্ট লেডি উল্লেখ করে বউয়ের প্রশংসায় ট্রাম্প

মেলানিয়াকে ফার্স্ট লেডি উল্লেখ করে বউয়ের প্রশংসায় ট্রাম্প

হিমালয় অববাহিকায় দুর্গম অঞ্চলে নতুন গ্রাম গড়ে তুলছে চীন

হিমালয় অববাহিকায় দুর্গম অঞ্চলে নতুন গ্রাম গড়ে তুলছে চীন

৭৩% ভোটার মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হুমকির মুখে

৭৩% ভোটার মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হুমকির মুখে

অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে ইংলিশ

অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে ইংলিশ

যুক্তরাষ্ট্র আরো বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে উঠতে পারে : জয়শঙ্কর

যুক্তরাষ্ট্র আরো বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে উঠতে পারে : জয়শঙ্কর

মার্কিন সিনেটে ইতিহাস গড়লেন দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী

মার্কিন সিনেটে ইতিহাস গড়লেন দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী