কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা
০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম
প্রতিদিনের সূর্যোদয় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে বাংলাদেশের শস্য শ্যামলা উর্বরা মাটি। কৃষি নির্ভর দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষক একসময় ইরি-বোরো-আউশ ধান, পাট-গম আবাদেই সন্তুষ্ট ছিল। দিন গড়িয়ে মাস আর মাস গড়িয়ে বছর এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩টি বছর গড়িয়ে গেছে। বন্ধুর ছদ্মাবরণে লুটেরা পরাশক্তির ছত্রছায়ায় দেশের অর্থনীতি যতটা শক্তিশালী হয়েছে তার চেয়েও বেশি ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতারা কি করেছে জনগণ তার জবাব সময়মত দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে। কিন্তু দেশের খেটে খাওয়া কৃষক কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে শস্য-শ্যামলা উর্বর মাটিতেই নিজের ও দেশের উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে। কৃষকের এই প্রাণান্তর প্রচেষ্টায় আজ বাংলাদেশের সমতল মাটিতেই ফলাতে শুরু করেছে পাহাড়ী ফসল। বাজারে কমলা বা মাল্টা দেখে দিনাজপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে ডার্জিলিং যাওয়ার জন্য মন উতালা হয়ে যেত। টাকা যোগাড় হলে কমলার বাগানের বাতাস খেতে কাশ্মির যাওয়ার ইচ্ছেটার কথাও অনস্বীকার্য। একইভাবে সীমান্তঘেঁষা বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের পঞ্চগড় জেলার গা ঘেঁষা ভারতের চায়ের বাগান দেখার জন্য থমকে দাঁড়ানোর দৃশ্য নিত্যদিনের ছিল।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি প্রতিদিনের সূর্যোদয়ের সাথেই নতুন করে একটি সম্ভাবনা উঁকি মেরেছে বাংলাদেশের অদম্য কৃষকের মধ্যে। তাদের আগ্রহ আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে এখন কমলা, মাল্টা ড্রাগনসহ অনেক ধরনের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের মাল্টা ও বাগান দেখতে এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসছে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জে, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও বিরলে। উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকাতেও রয়েছে কমলা ও মাল্টার বাগান। দিন গড়ানোর সাথে কৃষক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সাইজ, স্বাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার মালঞ্চ গ্রামে গড়ে উঠা মাল্টা ও কমলার বাগান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ-শিশু আসছে। এই বাগানের কমলা ও মাল্টার সাইজ এতটাই বড় যে ৩ থেকে ৪টি এক কেজি পরিমাণ। স্বাদও ভাল। বাগানটি এখন পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ব্যাপক জনসমাগমনের কারণে বাগান কর্তৃপক্ষ টিকিট কেটে বাগানে প্রবেশের ব্যবস্থা করেছে। বাগানে ঢুকতে জনপ্রতি গুনতে হচ্ছে ৩০ টাকা। বাগানের কমলা ৩৫০ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ফড়েয়া বা ব্যবসায়ী এখানকার কমলা বা মাল্টা কেনার সুযোগই পাচ্ছে না। দিনাজপুর কাহারোল উপজেলার পল্লীতে কমলা চাষে সফলতা অর্জন করেছেন প্রভাষক সেলিম রেজা। তার নিজস্ব এক একর জমিতে গত ২০২০ সালের জুন মাসে চায়না ও পাকিস্তানি জাতের ২০০ কমলা ও ২০০ মাল্টার চারা রোপণ করেন। গত ২০২২ এপ্রিলে তার বাগানে প্রথম ফলন আসতে শুরু করা মাল্টা গাছ এ বছর ১২০ মণ ফল পেয়েছেন। এখনো ফল রয়েছে। কমলাও ১০০ মণ পাওয়ার আশা করছেন। এ ধরনের বাগান এখন গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠছে। দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবুজ রংয়ের যে মাল্টা ও কমলা বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশই বাংলাদেশের মাটিতে উৎপাদিত। এছাড়া অবিকল ডার্জিলিং, ভুটান ও চায়ন বেবী সাইজের হলুদ কমলা ও মাল্টাগুলোও দেশি। দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক কৃষিবিদ হাসান ফুয়াদ এলতাজ কমলার গুনাগুন বর্ণনা করে বলেন, প্রতিটি কমলাতে প্রস্তাবিত দৈনিক পরিমাণের ১০০%-এরও বেশি ভিটামিন-সি থাকে। এটি অন্য যে কোনো সাইট্রাস বা লেবু জাতীয় ফলের চেয়ে বেশি।এই মূল ভিটামিন পেতে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো কমলার খোসা ছাড়িয়ে খেতে হবে।
কমলালেবুর পুষ্টিগুণ একটি মাঝারি আকারের কমলাতে আছে : ৬০ ক্যালোরি শক্তি কোনো চর্বি বা সোডিয়াম নেই ফাইবার-৩ গ্রাম, চিনি ১২ গ্রাম, প্রোটিন ১ গ্রাম ভিটামিন-এ ১৪ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-সি ৭০ মিলিগ্রাম, দৈনিক প্রস্তাবিত পরিমাণের ৬% ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ২৩৭ মিলিগ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৫.৪ গ্রাম।
কমলালেবুর স্বাস্থ্য উপকারিতাÑ ১। কোষকে যে কোনো ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। ২। শরীর কেকোলাজেন তৈরি করতে সাহায্য করে, কোলাজেন একটি প্রোটিন যা ক্ষত নিরাময় করে এবং ত্বককে মসৃণ করে। ৩। রক্তাল্পতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আয়রন শোষণ করা সহজ করে। ৪। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করে। ৫। বয়স-সম্পর্কিত মলিকুলার ডিজেনারেশন (অগউ)-এর অগ্রগতিকে ধীর করে, যা দৃষ্টি শক্তি হ্রাসের একটি প্রধান কারণ। ৬। ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী ফ্রি ৎধফরপধষং সাথে লড়াই করতে সহায়তা করে।
দিনাজপুরের বেদেনা লিচুর কথা কারই অজানা নয়। হালে কৃষি বিজ্ঞানীদের চেষ্টা আর কৃষকদের আগ্রহে বেদেনার পাশাপাশি চায়না-থ্রি লিচু জায়গা করে নিয়েছে। লিচুর বাগান করে কেবলমাত্র ফল বিক্রি করেই এখন সাধারণ কৃষক লাখপতি বনে যাচ্ছেন প্রতিবছর। দিনাজপুর ও আশপাশের জেলাগুলোর এমন গ্রাম নেই যেখানে লিচুর গাছ বা বাগান নেই। লিচুর পাশাপাশি এখন বারোমাসি কাটিমন, ব্যানানাসহ বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু আম আবাদ হচ্ছে। এসব আম ও লিচু বিদেশেও রফতানি শুরু হয়েছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে কৃষক আম ও লিচু রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বপ্ন দেখছে।
এখানেই শেষ নয় এই অঞ্চলের কৃষক যেন অসাধ্যকে সাধন করেছে সমতল ভূমিতে চা উৎপাদন করে। পঞ্চগড় এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় চা উৎপাদনের জেলায় নাম লিখিয়েছে। আমাদের পঞ্চগড় সহকর্মী মোঃ সম্রাট হোসাইন পঞ্চগড়ে চা বিপ্লবের তথ্য তুলে এই লেখাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন- লিল্পে পিছিয়ে থাকা পঞ্চগড়ের কৃষি ছাড়া কোনো আয়ের উৎস ছিল না। কিন্তু মাটির নিচের নূড়ী পাথরের কারণে আবাদের মতো জমিও থাকতো না। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল হোসেনের ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে টবে চা চাষে সফলতা অর্জন করলে, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে পরীক্ষা করে পঞ্চগড় এলাকার মাটিতে চা চাষ সম্ভব। পরে ২০০০ সালে তেঁতুলিয়া চা কাজী এন্ড কাজী বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে উত্তরের সীমান্ত এলাকা তেঁতুলিয়ায়।
এখন চা চাষে নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। জেলায় চা চাষ হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের যেমন আয়ের পথ তৈরি হয়েছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান। চা চাষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার নারী-পুরুষ লাভবান হচ্ছেন। এই চা দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। চা বাগান দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত আসছে পর্যটক। মুগ্ধ হচ্ছে তেঁতুলিয়ার সমতল ভূমির চা বাগান দেখে। মাত্র কয়েক বছরে ভরে গেছে সবুজের সমারোহে।
বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামের পর উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারীর এলাকা চা অঞ্চল হিসেবে তৃতীয় হলেও সিলেটের পর ২০২৩ সালে দ্বিতীয় উৎপাদন হয়েছে এ অঞ্চলে। এক কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত এক কোটি ৩২ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের চা চাষের পরিধি ও উৎপাদন বিবেচনায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে চায়ের তৃতীয় নিলামকেন্দ্র চালু হয়েছে।
জেলায় ১২ হাজার ১৩২ একর জমিতে চা আবাদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন- বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন।
এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলার কৃষক। বিপ্লব ঘটছে কৃষিতে। আমদানী নির্ভরতা কমতে হয়তো আর বেশি দূরে নেই। আজকের এই নতুন বছরের সূর্যোদয় আগামী আরো ভালো কিছু দিবে এই প্রত্যাশা রইলো।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিশ্বনাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুইট গ্রেফতার
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলাম-ই কার্যকর পন্থা শীর্ষক জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত
নতুন কমিটির উদ্দেশ্যে সাবেক সভাপতি তিন টাকার কমিটি রুখে দেয়া কঠিন কিছু হবে না
মির্জাপুরে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার
উদ্বোধনের ৪দিন পরও সেচ পানি মিলেনি মেঘনা - ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কৃষকের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার
বিশ্বনাথে সাংবাদিককে খুন-গুমের হুমকি
সুবর্ণচরে অনুমোদনহীন কীটনাশক ও ভেজাল সার খালে ফেলে নষ্ট করলো প্রশাসন
ফেসবুকে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে মেটাকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের
ঈশ্বরদীর ৩ অবৈধ ইটভাটায় অভিযান ২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়
‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তারুণ্যের উৎসব অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে’
সিংগাইরে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশের পরিচয় মিলেছে
শাহরাস্তিতে ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বেনাপোলে বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক
শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের সহ ১৬৬ জনের বিরুদ্ধে ফের হত্যা মামলা বগুড়ায়
ছাগলনাইয়ায় ছাত্র শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় উৎসব
ছাগলনাইয়ায় 'মুফতি মাহমুদুর রহমান আল্ খিদমা ফাউন্ডেশন' এর আত্মপ্রকাশ
কচুয়ায় ফুলকপির ভালো ফলনেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অর্ধযুগপূর্তি উৎযাপন
পটুয়াখালীতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ