ঢাকা   শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

দলিত কিশোরী হত্যা-ধর্ষণে অভিযুক্ত চার ব্যক্তিকে খালাস, ভারতে ক্ষোভ

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৫ মার্চ ২০২৩, ০৪:১৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৬ পিএম

ভারতে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত চার ব্যক্তির কাউকেই নৃশংস অপরাধের প্রায় তিন বছর পরও আদালত দোষী সাব্যস্ত করেনি। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

হাথরস গণধর্ষণকাণ্ডে চার অভিযুক্তের মধ্যে তিন জনকেই মুক্তি দিযেছে আদালত। গণধর্ষণ নয়, হাথরস-কাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করলেন বিশেষ তফসিলি জাতি ও উপজাতি আদালতের বিচারক। আদালতের দাবি, সন্দেহপ্রকাশ করা ছাড়া ধর্ষণের পক্ষে কোনও প্রমাণই আদালতে দেখাতে পারেননি সরকারি কৌঁসুলি। মেয়েটিকে শেখানো-পড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহপ্রকাশ আদালতের। আদালতের এই রায়ে নির্যাতিতার পরিবার জানিয়েছে, একটুও অবাক হননি তারা। এ দেশে ন্যায় বিচারের নামে দলিতদের কপালে এমনই রায় জোটে। আদালতের দাবি, সন্দেহপ্রকাশ করা ছাড়া ধর্ষণের পক্ষে কোনও প্রমাণই নেই।

বৃহস্পতিবার উত্তরপ্রদেশের বিশেষ তফসিলি জাতি ও উপজাতি আদালতের বিচারক ত্রিলোকপাল সিংহ চার অভিযুক্তের মধ্যে রামু, লবকুশ এবং রবি-এই তিন জনকে বেকসুর খালাস করেন। চতুর্থ তথা মূল অভিযুক্ত সন্দীপকে শুধুমাত্র অনিচ্ছাকৃত হত্যার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগ গৃহীতই হয়নি আদালতে। সন্দীপকে যাবজ্জীবনের সাজা শুনিয়েছে আদালত। তফসিলি জাতি ও উপজাতি নের ৩(২) (৫ম) ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সন্দীপ, যার আওতায় আসলে তফসিলি জাতি বা উপজাতি সম্প্রদায়ের কারও প্রতি অপরাধমূলক আচরণে শাস্তি হয়।

সিবিআই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুনের চেষ্টা চার্জশিটে তুলে ধরেছিল আগেই। কিন্তু রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আদালত জানায়, নির্যাতিতা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে আদালতে কোনও প্রমাণই তুলে ধরতে পারেননি সরকারি কৌঁসুলি। তাই সন্দীপকে যৌন অপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়। মৃত্যুর আগে নির্যাতিতার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যাতে সন্দীপ তার ঘাড়ে আঘাত করেছেন বলতে শোনা গিয়েছিল তাকে। যৌন নির্যাতন অস্বীকারও করেছিলেন তিনি। তার ভিত্তিতেই এমন রায় শুনিয়েছে আদালত। ঘটনার আটদিন পর অভিযুক্তদের নাম সামনে এল কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে আদালত। আদালতের দাবি, নিশ্চয়ই মেয়েটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন তার আত্মীয়-স্বজনরা।

মেয়েটিকে আঘাত করার জন্য সন্দীপকে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করেছে আদালত। এর মধ্যে ৪০ হাজার রুপি মেয়েটির মাকে দিতে হবে। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আরও দু’বছর সাজার মেয়াদ বাড়বে সন্দীপের। ইতিমধ্যেই যেহেতু ৩০ মাস জেলে কেটে গিয়েছে সন্দীপের, তা তার সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। ধর্ষণের অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া না গেলেও, মেয়েটির মৃত্যু দুর্ঘটনা বলে দাবি আদালতের। নির্যাতিতার পরিবার এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। আবার সন্দীপের পরিবারও এ রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর চিন্তাভাবনা করছে। তাদের মতে, তাদের ছেলেকে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছে।

আদালতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করলে, নির্যাতিতার বড় ভাই জানান, এ দেশে দলিতরা ন্যায় বিচারের নামে যে রায় পান, তারাও সেই রায়ই পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ দেশে দলিতরা যেমন বিচার পান, তা-ই পেয়েছি আমরা। ঠাকুর এবং ব্রাহ্মণরা যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতে পারেন তারা। তবে ন্যায় বিচার না হওয়া পর্যন্ত বোনের অস্থি বিসর্জন দেব না আমরা। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টেও যাব।’ মেয়েটির বড় বোন বলেন, ‘আমার ন্যায় বিচার পেলাম না। আমাদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আসলে ন্যায় এবং সত্যের হত্যা।’

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের হাথরসে ১৯ বছরের এক দলিত তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। দাবি করা হয়, গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। সেই সময় উচ্চবর্ণের চার যুবক মিলে তাকে ধর্ষণ করে। তার পর পরনের ওড়না গলায় বেঁধে মেয়েটিকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেন অভিযুক্তরা। তাতে মেয়েটির মেরুদণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় যখন উদ্ধার করা হয় তাকে, জিভ কেটে ঝুলছিল।

মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমেই থানায় নিয়ে যায় পরিবার। কিন্তু অভিযোগ, পুলিশ অভিযোগ দায়ের করতে রাজি হয়নি। বরং মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিস্তর টানাপোড়েনের পর ২০ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দায়ের করে পুলিশ। ২২ সেপ্টেম্বর মেয়েটির বয়ান রেকর্ড করা হয়। প্রথম তিনটি বয়ানে মেয়েটি ধর্ষণের অভিযোগ করেন। শ্বাসরোধ করে তাকে খুনের চেষ্টা হয় বলে জানান।

এর পর আলিগড়ের জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় মেয়েটিকে। অবস্থার অবনতি হলে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর মেয়েটি মারা যান। আর সেই রাতেই আড়াইটা নাগাদ কেরোসিন ঢেলে মেয়েটির লাশ পুড়িয়ে দেয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। মেয়েটির পরিবারকে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে, তাদের অসম্মতিতে মেয়েটিকে পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের দাবি, মেয়েটির পরিবারের সম্মতি আদায় করেছিলেন তারা।

বিষয়টি সামনে আসতেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলাটি গ্রহণ করে। সেই সময় বিষয়টিকে ভুয়া খবর বলে চালানোর চেষ্টা হয় পুলিশের তরফে। ফরেন্সিক রিপোর্টে ধর্ষণের ইঙ্গিত মেলেনি বলে দাবি করা হয়। যদিও বিশেজ্ঞরা দাবি করেন, অপরাধের তিন থেকে চারদিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হয়। সেই নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় গোটা দেশে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করেন সমাজের সব স্তরের মানুষ।

যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মেয়েটির মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাতের পাশাপাশি চিকিৎসার রেকর্ড হিসেবে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধের উল্লেখও ছিল। মেয়েটির পরিবার জানায়, বেশ কয়েক মাস ধরে মেয়েটিকে এবং তার মাকে হেনস্থা করছিলেন অভিযুক্তরা। এমনকি মেয়ের লাশ পুড়িয়ে দেয়ার পর, পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফেও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল তাদের উপর। হাথরসের জেলাশাসকের একটি ভিডিও-ও সামেন আসে, যেখানে ওই পরিবারকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিতে দেখা যায় তাকে। সংবাদমাধ্যম চলে গেলে তাদের কী অবস্থা হবে, হুঁশিয়ারি দেন। সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বুলডোজার জাস্টিস নিষিদ্ধ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে
লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো মার্কিন সহায়তা ইউক্রেনকে
প্রতিনিধি পরিষদেও রিপাবলিকানদের জয়
নাইজেরিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আড়াই কোটি মানুষ
বিশ্বে ৩০ বছরে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ
আরও

আরও পড়ুন

জানা গেল ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ব্রাজিলের একাদশ

জানা গেল ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ব্রাজিলের একাদশ

বাংলাদেশে ন্যায্য রুপান্তরে অর্থায়নের জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান

বাংলাদেশে ন্যায্য রুপান্তরে অর্থায়নের জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান

গোপালগঞ্জে কারাগারে থাকা বাবার অবশেষে জামিন মঞ্জর

গোপালগঞ্জে কারাগারে থাকা বাবার অবশেষে জামিন মঞ্জর

ওসমানী বিমান বন্দরে বিদেশী বিমান উঠা-নামার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী- প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে সিলেটে স্মারকলিপি

ওসমানী বিমান বন্দরে বিদেশী বিমান উঠা-নামার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী- প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে সিলেটে স্মারকলিপি

ময়মনসিংহে ফিলিং স্টেশনে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৬

ময়মনসিংহে ফিলিং স্টেশনে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৬

জানুয়ারি পর্যন্ত ছিটকে গেলেন এনগিডি

জানুয়ারি পর্যন্ত ছিটকে গেলেন এনগিডি

দুবাইয়ে নবনিযুক্ত কনসাল জেনারেলের সাথে বাংলাদেশ রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডার্স আজমানের নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ

দুবাইয়ে নবনিযুক্ত কনসাল জেনারেলের সাথে বাংলাদেশ রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডার্স আজমানের নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সুবিধা নিশ্চিতে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড

গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সুবিধা নিশ্চিতে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড

যে কারণে হারপিকে মেতেছে নেটিজেনরা

যে কারণে হারপিকে মেতেছে নেটিজেনরা

আ.লীগের মতো পরিবারতন্ত্র করবে না বিএনপি: তারেক রহমান

আ.লীগের মতো পরিবারতন্ত্র করবে না বিএনপি: তারেক রহমান

প্যারাগুয়ে ম্যাচে কেমন হবে আর্জেন্টিনার একাদশ

প্যারাগুয়ে ম্যাচে কেমন হবে আর্জেন্টিনার একাদশ

অর্থাভাবে ব্যক্তিগত বিমান ভাড়া দিয়েছেন শন ডিডি, বিক্রি করবেন বাড়ি

অর্থাভাবে ব্যক্তিগত বিমান ভাড়া দিয়েছেন শন ডিডি, বিক্রি করবেন বাড়ি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্রেনী কক্ষে অসুস্থ ১০ শিক্ষার্থী

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্রেনী কক্ষে অসুস্থ ১০ শিক্ষার্থী

ভারতীয় গণমাধ্যম আমাদের সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ভারতীয় গণমাধ্যম আমাদের সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

নরসিংদীতে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

নরসিংদীতে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

পুলিশ সংস্কার ও একটি কৌশলপত্র

পুলিশ সংস্কার ও একটি কৌশলপত্র

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে কেন উপদেষ্টা করতে হবে?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে কেন উপদেষ্টা করতে হবে?

শ্যামনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

শ্যামনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি এই অবহেলা অমার্জনীয়

অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি এই অবহেলা অমার্জনীয়

নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ

নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ