দলিত কিশোরী হত্যা-ধর্ষণে অভিযুক্ত চার ব্যক্তিকে খালাস, ভারতে ক্ষোভ

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৫ মার্চ ২০২৩, ০৪:১৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৬ পিএম

ভারতে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত চার ব্যক্তির কাউকেই নৃশংস অপরাধের প্রায় তিন বছর পরও আদালত দোষী সাব্যস্ত করেনি। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

হাথরস গণধর্ষণকাণ্ডে চার অভিযুক্তের মধ্যে তিন জনকেই মুক্তি দিযেছে আদালত। গণধর্ষণ নয়, হাথরস-কাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করলেন বিশেষ তফসিলি জাতি ও উপজাতি আদালতের বিচারক। আদালতের দাবি, সন্দেহপ্রকাশ করা ছাড়া ধর্ষণের পক্ষে কোনও প্রমাণই আদালতে দেখাতে পারেননি সরকারি কৌঁসুলি। মেয়েটিকে শেখানো-পড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহপ্রকাশ আদালতের। আদালতের এই রায়ে নির্যাতিতার পরিবার জানিয়েছে, একটুও অবাক হননি তারা। এ দেশে ন্যায় বিচারের নামে দলিতদের কপালে এমনই রায় জোটে। আদালতের দাবি, সন্দেহপ্রকাশ করা ছাড়া ধর্ষণের পক্ষে কোনও প্রমাণই নেই।

বৃহস্পতিবার উত্তরপ্রদেশের বিশেষ তফসিলি জাতি ও উপজাতি আদালতের বিচারক ত্রিলোকপাল সিংহ চার অভিযুক্তের মধ্যে রামু, লবকুশ এবং রবি-এই তিন জনকে বেকসুর খালাস করেন। চতুর্থ তথা মূল অভিযুক্ত সন্দীপকে শুধুমাত্র অনিচ্ছাকৃত হত্যার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগ গৃহীতই হয়নি আদালতে। সন্দীপকে যাবজ্জীবনের সাজা শুনিয়েছে আদালত। তফসিলি জাতি ও উপজাতি নের ৩(২) (৫ম) ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সন্দীপ, যার আওতায় আসলে তফসিলি জাতি বা উপজাতি সম্প্রদায়ের কারও প্রতি অপরাধমূলক আচরণে শাস্তি হয়।

সিবিআই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুনের চেষ্টা চার্জশিটে তুলে ধরেছিল আগেই। কিন্তু রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আদালত জানায়, নির্যাতিতা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে আদালতে কোনও প্রমাণই তুলে ধরতে পারেননি সরকারি কৌঁসুলি। তাই সন্দীপকে যৌন অপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়। মৃত্যুর আগে নির্যাতিতার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যাতে সন্দীপ তার ঘাড়ে আঘাত করেছেন বলতে শোনা গিয়েছিল তাকে। যৌন নির্যাতন অস্বীকারও করেছিলেন তিনি। তার ভিত্তিতেই এমন রায় শুনিয়েছে আদালত। ঘটনার আটদিন পর অভিযুক্তদের নাম সামনে এল কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে আদালত। আদালতের দাবি, নিশ্চয়ই মেয়েটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন তার আত্মীয়-স্বজনরা।

মেয়েটিকে আঘাত করার জন্য সন্দীপকে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করেছে আদালত। এর মধ্যে ৪০ হাজার রুপি মেয়েটির মাকে দিতে হবে। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আরও দু’বছর সাজার মেয়াদ বাড়বে সন্দীপের। ইতিমধ্যেই যেহেতু ৩০ মাস জেলে কেটে গিয়েছে সন্দীপের, তা তার সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। ধর্ষণের অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া না গেলেও, মেয়েটির মৃত্যু দুর্ঘটনা বলে দাবি আদালতের। নির্যাতিতার পরিবার এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। আবার সন্দীপের পরিবারও এ রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর চিন্তাভাবনা করছে। তাদের মতে, তাদের ছেলেকে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছে।

আদালতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করলে, নির্যাতিতার বড় ভাই জানান, এ দেশে দলিতরা ন্যায় বিচারের নামে যে রায় পান, তারাও সেই রায়ই পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ দেশে দলিতরা যেমন বিচার পান, তা-ই পেয়েছি আমরা। ঠাকুর এবং ব্রাহ্মণরা যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতে পারেন তারা। তবে ন্যায় বিচার না হওয়া পর্যন্ত বোনের অস্থি বিসর্জন দেব না আমরা। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টেও যাব।’ মেয়েটির বড় বোন বলেন, ‘আমার ন্যায় বিচার পেলাম না। আমাদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আসলে ন্যায় এবং সত্যের হত্যা।’

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের হাথরসে ১৯ বছরের এক দলিত তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। দাবি করা হয়, গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। সেই সময় উচ্চবর্ণের চার যুবক মিলে তাকে ধর্ষণ করে। তার পর পরনের ওড়না গলায় বেঁধে মেয়েটিকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেন অভিযুক্তরা। তাতে মেয়েটির মেরুদণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় যখন উদ্ধার করা হয় তাকে, জিভ কেটে ঝুলছিল।

মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমেই থানায় নিয়ে যায় পরিবার। কিন্তু অভিযোগ, পুলিশ অভিযোগ দায়ের করতে রাজি হয়নি। বরং মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিস্তর টানাপোড়েনের পর ২০ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দায়ের করে পুলিশ। ২২ সেপ্টেম্বর মেয়েটির বয়ান রেকর্ড করা হয়। প্রথম তিনটি বয়ানে মেয়েটি ধর্ষণের অভিযোগ করেন। শ্বাসরোধ করে তাকে খুনের চেষ্টা হয় বলে জানান।

এর পর আলিগড়ের জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় মেয়েটিকে। অবস্থার অবনতি হলে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর মেয়েটি মারা যান। আর সেই রাতেই আড়াইটা নাগাদ কেরোসিন ঢেলে মেয়েটির লাশ পুড়িয়ে দেয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। মেয়েটির পরিবারকে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে, তাদের অসম্মতিতে মেয়েটিকে পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের দাবি, মেয়েটির পরিবারের সম্মতি আদায় করেছিলেন তারা।

বিষয়টি সামনে আসতেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলাটি গ্রহণ করে। সেই সময় বিষয়টিকে ভুয়া খবর বলে চালানোর চেষ্টা হয় পুলিশের তরফে। ফরেন্সিক রিপোর্টে ধর্ষণের ইঙ্গিত মেলেনি বলে দাবি করা হয়। যদিও বিশেজ্ঞরা দাবি করেন, অপরাধের তিন থেকে চারদিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হয়। সেই নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় গোটা দেশে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করেন সমাজের সব স্তরের মানুষ।

যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মেয়েটির মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাতের পাশাপাশি চিকিৎসার রেকর্ড হিসেবে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধের উল্লেখও ছিল। মেয়েটির পরিবার জানায়, বেশ কয়েক মাস ধরে মেয়েটিকে এবং তার মাকে হেনস্থা করছিলেন অভিযুক্তরা। এমনকি মেয়ের লাশ পুড়িয়ে দেয়ার পর, পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফেও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল তাদের উপর। হাথরসের জেলাশাসকের একটি ভিডিও-ও সামেন আসে, যেখানে ওই পরিবারকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিতে দেখা যায় তাকে। সংবাদমাধ্যম চলে গেলে তাদের কী অবস্থা হবে, হুঁশিয়ারি দেন। সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মানবতাবিরোধী অপরাধে আইসিসি-তে দুতার্তের বিচার, ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভুটানসহ ৪৩টি দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে ট্রাম্প
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত সাংবাদিক আলা হাশিমের মৃত্যু
যানজট নিরসনের আইডিয়া দেয়ার জন্য বৃত্তি দিচ্ছে দুবাই
ট্রাম্পের আহ্বানের পর পুতিনের সিদ্ধান্ত, ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পণের ডাক
আরও
X

আরও পড়ুন

ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে ভারতীয় অস্ত্রের চালান আটক ভারত থেকে বাংলাদেশ পাচারের চেষ্টা

ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে ভারতীয় অস্ত্রের চালান আটক ভারত থেকে বাংলাদেশ পাচারের চেষ্টা

হাসিনাকে ফেরাতে জাহাঙ্গীরের ষড়যন্ত্র, অডিও ভাইরাল

হাসিনাকে ফেরাতে জাহাঙ্গীরের ষড়যন্ত্র, অডিও ভাইরাল

মানবতাবিরোধী অপরাধে আইসিসি-তে দুতার্তের বিচার, ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি

মানবতাবিরোধী অপরাধে আইসিসি-তে দুতার্তের বিচার, ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি

ডাকাতের কবলে তরমুজের ট্রলার, আহত ৮

ডাকাতের কবলে তরমুজের ট্রলার, আহত ৮

বাউফলে উত্ত্যক্তের শিকার স্কুলছাত্রীর চিরকুট লিখে আত্মহত্যা

বাউফলে উত্ত্যক্তের শিকার স্কুলছাত্রীর চিরকুট লিখে আত্মহত্যা

সিরাজদিখানে অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় অটোরিকশা খাদে, প্রাণ গেল কৃষকের

সিরাজদিখানে অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় অটোরিকশা খাদে, প্রাণ গেল কৃষকের

খুলনায় জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন

খুলনায় জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন

মামলা দেয়ার কথা বলে টাকা চাইবার কারবার করবেন না : ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন

মামলা দেয়ার কথা বলে টাকা চাইবার কারবার করবেন না : ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভুটানসহ ৪৩টি দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে ট্রাম্প

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভুটানসহ ৪৩টি দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে ট্রাম্প

ঈদগাঁওতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত-১, আহত-৫

ঈদগাঁওতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত-১, আহত-৫

বিভিন্ন দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’

বিভিন্ন দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত সাংবাদিক আলা হাশিমের মৃত্যু

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত সাংবাদিক আলা হাশিমের মৃত্যু

ঝিকরগাছায় সংখ্যালঘু গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার ১

ঝিকরগাছায় সংখ্যালঘু গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার ১

গুলশানে ইউএন হাউজ উদ্বোধন করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব

গুলশানে ইউএন হাউজ উদ্বোধন করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব

বাবা খ্রিস্টান, মা হিন্দু তবু কেন মুসলিম পদবী ব্যবহার করেন দিয়া!

বাবা খ্রিস্টান, মা হিন্দু তবু কেন মুসলিম পদবী ব্যবহার করেন দিয়া!

নিকলীতে ২২ হাজার শিশুকে দেওয়া হয়েছে ভিটামিন এ

নিকলীতে ২২ হাজার শিশুকে দেওয়া হয়েছে ভিটামিন এ

আছিয়ার বাড়িতে জামায়াত আমির, আর্থিক সহায়তাসহ পাকা বাড়ি করে দেওয়ার আশ্বাস

আছিয়ার বাড়িতে জামায়াত আমির, আর্থিক সহায়তাসহ পাকা বাড়ি করে দেওয়ার আশ্বাস

চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় হেলপার নিহত

চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় হেলপার নিহত

মির্জাপুরে মহাসড়কে উল্টে যাওয়া ট্রাক সরাতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হাইওয়ে ওসি সার্জেন্টসহ চার পুলিশ আহত

মির্জাপুরে মহাসড়কে উল্টে যাওয়া ট্রাক সরাতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হাইওয়ে ওসি সার্জেন্টসহ চার পুলিশ আহত

যানজট নিরসনের আইডিয়া দেয়ার জন্য বৃত্তি দিচ্ছে দুবাই

যানজট নিরসনের আইডিয়া দেয়ার জন্য বৃত্তি দিচ্ছে দুবাই