ভারতে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ গেছে গুজরাটে মুসলিমদেরকে হত্যার ঘটনা
০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০২:৩৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২২ পিএম
ভারতের একাদশ শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে ২০০২ সালের গুজরাটে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনার দুটি অধ্যায় বাদ দেয়া হয়েছে। আবার দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বই থেকেও মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্বলিত অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি বদল ঘটানো হয়েছে পাঠ্যবইতে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ কাউন্সিল বা এনসিইআরটি সারা দেশের স্কুলগুলির জন্য পাঠ্যবই প্রকাশ করে। এবছরের জন্য তারা দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য যে বইটি প্রকাশ করেছে, সেই ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ তিনটি ভাগে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নবম অধ্যায়তেই ছিল রাজা এবং ইতিহাস, মুঘল দরবার অংশটি।
এনসিইআরটির ওয়েবসাইটে নতুন ইতিহাস বইটি ডাউনলোড করার জন্য যে লিঙ্ক আছে, সেখানে মুঘল শাসকদের নিয়ে ২৮ পাতার যে অধ্যায়টি ছিল, তা এখন আর নেই। মুসলমান শাসকদের ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেয়ার এ প্রচেষ্টাকে ভারতের ইতিহাস থেকে মুঘলদের মুছে ফেলার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এনসিইআরটি যুক্তি দিয়েছে যে ছাত্রছাত্রীদের ওপর থেকে ‘পাঠ্যক্রমের বোঝা কম’ করতেই এ অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
পাঠ্যবইতে পরিবর্তন শুধু যে ইতিহাসের বইতেই করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকেও বেশ কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব প্রসঙ্গে লেখা ছিল। গান্ধীর হত্যার পরে যে আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল, সেই অংশটাও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে বিজেপি এবং আরএসএস জওহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গান্ধী পরিবারের বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে তুলে ধরতে চায়। গুজরাটে বিশ্বের সবথেকে উঁচু যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাও বল্লভভাই প্যাটেলের।
পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক
বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলি এনসিইআরটির পাঠ্য বইতে এসব পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, আবার উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি বলছে তারা নতুন বই পড়াবে। এনসিইআরটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেএস রাজপুত বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তিনি বলছিলেন, “এনসিইআরটি একটা বড় প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আছেন। তারা যখন কোনও পরিবর্তন করেন, সেগুলো অ্যাকাডেমিকই হয়। ইতিহাসের বইতে যদি কোথাও কেউ নিজস্ব ভাবনা আর তত্ত্ব যোগ করে থাকেন, সেগুলো সরিয়ে দেওয়াই উচিত। কিন্তু মুঘল আমলের ইতিহাস পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া যায় না।" “কিন্তু আমারও এটা মনে হতো যে মুঘল আমলের ইতিহাস খুব বেশি করে পড়ানো হচ্ছে। যেন শুধু মুঘল আমলেই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ছিল! আবার ইতিহাসের কোনও একটা সময়ের কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়ানোটাও অনুচিত,” বলছিলেন রাজপুত।
'ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হল না'
একটা সময়ে এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণীর বই মুঘল আমলের ইতিহাসের জন্য স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীদেরও পড়তে পরামর্শ দিতেন অধ্যাপকরা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়া প্যারিমোহন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ বলছিলেন, “আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হই স্নাতক শ্রেণীতে, এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন মুঘল আমলের ইতিহাসের ভিত তৈরি করতে হলে এনসিইআরটির পাঠ্যবই পড়বে তোমরা। এতটাই সমৃদ্ধ ছিল বইটা।“
বিএ ক্লাসের ছাত্রী হয়েও দ্বাদশ শ্রেণীর এনসিইআরটির পাঠ্য বই পড়েই শর্মিষ্ঠা নাথের ‘মুঘল আমলের ইতিহাস নিয়ে ভিতটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল’। “এখন মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেওয়ায় ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হল না। মুঘল আমল না পড়লে ছাত্রছাত্রীরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কী করে বুঝবে?" "বরঞ্চ যেটা করা যেতে পারত, মুঘল আমল সম্বন্ধে নতুন তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, যেমন সম্রাট আকবরকে শুধুই ‘দ্যা গ্রেট’ বলে না দেখিয়ে তার নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরা, বা অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের সমালোচনামূলক দিকগুলো তুলে ধরা – এটা করাই যেত,” বলছিলেন অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, ইতিহাস তো ইতিহাসই, কেউ চাইলেই তো আর সেটা মুছে ফেলা যায় না। তবে নতুন করে কোনও গবেষণালব্ধ তথ্য পেলে নিশ্চই ইতিহাসকে নতুন ভাবে দেখার সুযোগ আছে, সেটা করাও হয়। “ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পরিবর্তন কোনও নতুন ঘটনা নয়, এটা হতেই থাকে। কিন্তু সেই সব পরিবর্তন হওয়া উচিত নতুন কোনও তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে। এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময়েও ইতিহাস বইতে বদল আনার চেষ্টা হয়েছিল। সেইসব পরিবর্তনগুলো তথ্য আর গবেষণার ভিত্তিতে করা হয়েছিল," বলছিলেন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সচিব অধ্যাপক সৈয়দ আলি নাদিম রিজভি। "কিন্তু এখন তো একটা কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে,” বলেন রিজভি।
এনসিইআরটির ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের বইতে পরিবর্তনগুলো নিয়ে অভিযোগ উঠছে যে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই এই বদলগুলো করা হয়েছে। সেই ভাবধারা হল হিন্দুত্ববাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং মুসলমান বিরোধিতা। ওই একই চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে রাস্তা, স্টেশন, জেলা বা শহরের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা সবথেকে বেশি দেখা গেছে উত্তরপ্রদেশে। ভারতীয় রেলপথের অতি গুরুত্বপূর্ণ মোগলসরাই স্টেশনের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, এলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ।
বেশ কয়েক বছর আগেই মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্য বই থেকে মুঘল আমলকে সরিয়ে ছত্রপতি শিবাজীর ইতিহাস নিয়ে আসা হয়েছে। বিজেপি শাসিত কর্ণাটক রাজ্যেও টিপু সুলতানের ইতিহাস মুছে ফেলার একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। বিতর্ক যে শুধু ইতিহাসের পাঠ্যবই নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আরএসএস ঘনিষ্ঠতার পরিচয় সরিয়ে দেওয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। মুসলমান আমল নিয়ে একাধিক ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখেছেন কলকাতার প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত।
তিনি বলছিলেন, “মুঘল আমল বা মুসলমান শাসকদের আমল তো ভারতের ইতিহাসেরই অঙ্গ। তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে ভারতের শিল্প, সংস্কৃতিতে। আর বর্তমানে আমরা যে জেলাওয়াড়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় চলি, সেটাও তো মুঘলদেরই অবদান। সেসব অস্বীকার করব কী করে? আবার গান্ধী হত্যাকারীর আরএসএস সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করব পাঠ্যবইতে, কিন্তু সবরমতী আশ্রমে গিয়ে চরকা কাটার ছবি তুলবেন প্রধানমন্ত্রী, এ তো দ্বিচারিতা।”
এনসিইআরটির ইতিহাস বইতে পরিবর্তনের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রায় ২৫০ জন নামকরা ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। শনিবার এক বিবৃতি জারি করে ইরফান হাবিব, আদিত্য মুখার্জী, অপূর্বানন্দ, জয়তী ঘোষের মতো শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসকারেরা বলছেন, পাঠ্যবইতে এইসব পরিবর্তন বিভেদকামী রাজনীতিকে উৎসাহ দেবে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ধর্ম যার যার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার: তারেক রহমান
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কাম্য নয় : ইউট্যাব
আগামী সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি চরমোনাই পীরের
কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও অনুপ্রবেশকারীর দলে জায়গা হবে না-কেন্দ্রীয় যুব দলের সাধারণ সম্পাদক নুরল ইসলাম নয়ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাবিতে সমাবেশ
বিগত ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি
তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের
রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে নিহত ১, থমথমে পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা জারি, ৭২ ঘন্টার অবরোধের ডাক
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান
নিরাপদ ও নির্ভয়ে উদযাপন হবে শারদীয় দূর্গোদসব এবং দূর্গাপূজা- এসএমপি কমিশনার রেজাউল করিম
মব কিলিং সরকার সমর্থন করে না: উপদেষ্টা নাহিদ
চট্টগ্রামে রাতের আঁধারে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর
বলিউডে কারিনা কাপুরের ২৫ বছর
মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ
রাজশাহীতে ট্রেনে বরযাত্রীদের ওপর হামলা
চিহ্নিত গোষ্ঠী আবার দখলদারি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে : সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই
গায়িকা রুকসানার রহস্যজনক মৃত্যু!
যে কোনো মূল্যে লাহোর কর্মসূচি সফল করুন: ইমরান খান
চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজি চালকসহ নিহত ২
যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ভবনে বিচারককে গুলি করে হত্যা