বন্ধু থেকে যেভাবে শত্রুতে পরিণত হল ইরান ও মিশর

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৩ পিএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৩ পিএম

 

ইরান ও মিশর যে মধ্যপ্রাচ্যের সবথেকে জনবহুল দুটি দেশ তা শুধু নয়। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় এই দুটি দেশের একটা আলাদা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ও আছে। মিশর ও ইরানের বন্ধুত্বের ইতিহাসে বিবাদ যেমন আছে, তেমনই সমঝোতাও হয়েছে।

 

মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলি বিংশ শতাব্দীতে গঠিত হয়েছে, যেখানে ইরান ও মিশর প্রাচীন সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসাবে সবসময়েই উচ্চাসনে থেকেছে। বিগত ১৫০ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে দুটি দেশ যেমন একে অপরের খুব কাছাকাছি এসেছে নানা বিষয়ে, তেমনই আবার সংঘাত ও শত্রুতার পথও বেছে নিয়েছে দেশ দুটি।

 

এখন মিশর ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক চেষ্টার পরেও এখনও একে অপরের দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে নি। কিন্তু গাজার যুদ্ধ এবং লেবাননের ওপরে ইসরাইলি হামলা তেহরান ও কায়রো সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে কাছাকাছি আসার, সম্পর্ক ভালো করার।

 

ইরানের কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক গতিবিধি নজর করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ইরানের তরফ থেকে সমঝোতার একটা প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। আরব বিশ্ব ও মধ্য প্রাচ্যে মিশর সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্লেষণ করতে হবে যে কেন ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিগত কয়েক বছর ধরেই মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর প্রচেষ্টা করছে।

 

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে আলাপ করার উদ্দেশ্যেই ইরানের বিদেশ মন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির মিশর সহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে সফর করেছেন। লেবানন, ইরাক ও সউদী আরব সফরের পরে আরাঘচি কায়রো গিয়েছিলেন।

 

এই কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোতে মিশরের একটা ভূমিকা আছে। তাদের সঙ্গে শুধু যে ইসরাইলের সীমান্ত রয়েছে তা নয়, ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কও আছে মিশরের। এছাড়াও হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে আলোচনাতেও মিশর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 

ইরান আর মিশরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে ভৌগলিক দূরত্ব এবং নানা গুরুতর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বজায় থাকার অনেকগুলি কারণ আছে। তবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরের কিছু ঘটনা এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার করছে।

 

পারিবারিক সম্পর্ক

অতীতে এই অঞ্চলটি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, পরে ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মতো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির উপস্থিতির কারণে ইরান ও মিশর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা মজবুত হয় নি।

 

ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ হয়ে যায় মিশর কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তা দখল করে নেয় যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্য ১৯২২ সালে মিশরের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয় কিন্তু দেশটির পররাষ্ট্রনীতি, সেনাবাহিনী, সুয়েজ খালের মতো বিষয়গুলি স্বাধীন দেশের কাছে হস্তান্তর করতে রাজী হয় নি তারা।

 

ইরানের ব্যাপারে কিন্তু যুক্তরাজ্যের ভিন্ন নীতি ছিল। তারা ইরানে রেজা শাহ নামে এক সামরিক কমান্ডারকে সমর্থন দেয়, যিনি ১৯২১ সালে এক সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে অনেকটাই ক্ষমতা দখল করে নেন। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই আহমদ শাহ কাজারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেজা শাহ নিজেই পাহলভি রাজা নাম নিয়ে ক্ষমতায় বসেন।

 

এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ইরান ও মিশরে এমন দুই শাসক এলেন যাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণে নিজের দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও হিতের বদলে যুক্তরাজ্যের নির্দেশ বেশি গুরুত্ব পেত।

 

অন্যদিকে মিশরের সঙ্গে ইরানের রেজা শাহের সম্পর্ক পুরোপুরি ঠিক হতে প্রায় দুই দশক সময় লেগেছিল। ইরানের শাহ যখন নিজের বড় ছেলে ও যুবরাজ মুহম্মদ রেজার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন, তখন তার পছন্দ হয়ে গেল মিশরের বাদশাহ ফারুকের বোন ফৌজিয়াকে।

 

এই বিবাহসূত্রই রেজা শাহ ও মিশরের বাদশাহ ফারুক – দুজনের জন্যই রাজনৈতিক লাভ বয়ে এনেছিল। পাহলভি পরিবারের সদ্যপ্রাপ্ত বাদশাহিকে একটা আইনি মান্যতা দেওয়ার জন্য এই বিবাহ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

 

আবার মিশরের বাদশাহ ফারুকের যে দেশ পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণেই চলত, যাকে আরব দেশগুলো ‘কাঠপুতুল সরকার’ বলেই মনে করত, এই বিবাহবন্ধন বাদশাহকেও শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিল। তিনি জেনে বুঝেই এই বিয়েতে মত দিয়েছিলেন নিজের লাভের কথা ভেবে।

 

ইরানের যুবরাজ মুহম্মদ রেজা পাহলভি ও মিশরের শাহজাদী ফৌজিয়ার বিয়ের পরেই আধুনিক ইতিহাসে প্রথমবার এক দেশ অন্য দেশে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল।

 

এভাবেই তেহরান ও কায়রোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়। সেই সময় দুই দেশের পারিবারিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।

 

শাহ ফারুকের পতন

সময় যত এগিয়েছে, ফৌজিয়ার সঙ্গে যুবরাজ মুহম্মদ রেজার বিয়ে ইরানের রাজপরিবারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন যদিও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল, কিন্তু মিশরের রাজা ইরানের শাহের বৈদেশিক নীতি তৈরিতে কোনও ভূমিকা পালন করতে পারছিলেন না।

 

শাহ ফারুক এবং তার প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সীমিত স্বাধীনতা পেতেন। ইরান ও মিশর আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, দুটি দেশই ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণাধীন মধ্যপ্রাচ্য শাসনের অঙ্গ হয়ে ওঠে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ সেরকম ছিল না।

 

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক অস্বাভাবিক না হলেও তাদের মধ্যে কোনও সংঘাত বা শত্রুতার কথাও সামনে আসে নি। এর মূল কারণ ছিল ইরান ও মিশর উভয়ই দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের দেশে সংস্কারের চেষ্টা করছিল।

 

এ ছাড়া উভয় দেশই ইউরোপ থেকে তাদের সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ নীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল।

 

ইরান ও মিশরের মধ্যে সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ১৯৫২ সালে, যখন মিশরের সামরিক অফিসারদের একটি গোষ্ঠী ব্রিটিশ-সমর্থিত রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে এবং দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

 

এই ঘটনার নামকরণ করা হয় '১৯৫২ সালের বিপ্লব', যার পরে শাহ ফারুককে সিংহাসন থেকে সরে যেতে হয়েছিল এবং এভাবে প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো বাদশাহি শাসনের অবসান ঘটে মিশরে।

 

বাদশাহি রাজত্ব শেষ হওয়ার তিন বছরের মধ্যে জামাল আব্দেল নাসের সদ্য প্রতিষ্ঠিত মিশর প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

 

তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকাবাহক হিসেবে এগিয়ে আসে মিশর।

 

এর পরেই সউদী আরব ও ইরাকের মতো অন্যান্য বাদশাহদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরান মিশর-বিরোধী শিবিরে নাম লেখায়।

 

আরব জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আব্দেল নাসেরের কাছে ইরানের শাহ শুধু যে একটি অঞ্চলের বাদশাহ ছিলেন তা না, তাকে পশ্চিমা দেশগুলির সমর্থনপ্রাপ্ত একজন অ-আরব বাদশাহ হিসাবেই দেখতেন মি. নাসের।

 

জামাল আব্দেল নাসের তার আরব জাতীয়তাবাদী প্রচারণায় বিশেষভাবে ইরানকে নিশানা করেছিলেন।

 

তিনি এই অভিযোগও তুলেছিলেন যে ইসরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আর মার্কিনি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে তুলেছে দেশের সেনাবাহিনীকে, এ কথাও তুলতেন মি. নাসের।

 

আনোয়ার সাদাত ও ইরানের শাহের বন্ধুত্ব

জামাল আব্দেল নাসের এই অঞ্চলে তার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অনেক বাধার মুখোমুখি হন এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ধারাবাহিক পরাজয় হতে থাকে তার। হঠাৎই ১৯৭০ সালে জামাল আব্দেল নাসের মারা যান।

 

তার উত্তরসূরি আনোয়ার সাদাত (যিনি ১৯৫২ সালের বিপ্লবে জামাল আব্দেল নাসেরের সহযোদ্ধা ছিলেন) দেশটির গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলি প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছিলেন।

 

আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, আবার ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’ বা ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেন এবং ইরানের শাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

 

প্রাথমিকভাবে ইরানের আর্থিক সহায়তার ওপরে ভিত্তি করে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে চলছিল। সেই সময়ে আনোয়ার সাদাত তেহরান সফরে গিয়ে মুহম্মদ রেজা পাহলভির উপস্থিতিতে ফার্সি ভাষায় লেখা কিছু শব্দ পড়ে শোনান, যাতে দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করা হয়।

 

তিনি শ্রোতাদের ইরানি ও মিশরীয়দের মধ্যে প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকেই যে সম্পর্ক চলে আসছে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

 

তিনি জোর দিয়ে বলেন যে দুটি দেশ একই রকম কারণ তাদের এক অভিন্ন ইতিহাস রয়েছে।

 

আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ইরানের শাহ এবং আনোয়ার সাদাত একে অপরের খুব প্রশংসা করেন।

 

সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি তাদের বলে ১৯৭৩ সালে যখন ইসরাইল দাবি তুলল, তারপরেই অন্যান্য অন্যান্য আরব দেশের সহায়তায় ইসরায়েল আক্রমণ করে মিশর, কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিকে তারা হেরে যায়।

 

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, তা নির্ধারণে কূটনীতির পথ নেন। এই কৌশলে তিনি ইরানের শাহের পূর্ণ সমর্থনও লাভ করেন।

 

যখন মুহম্মদ রেজা শাহ পাহলভি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং স্থায়ীভাবে তার দেশ ত্যাগ করেন, তখন আনোয়ার সাদাত ইরানের প্রাক্তন শাহের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন।

 

মুহম্মদ রেজা শাহের মৃত্যুর পরে, আনোয়ার সাদাত তার জন্য একটি বিশাল রাষ্ট্রীয় জানাজার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি পুরো বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ব্যক্তিগতভাবে শাহকে কতটা ভালবাসেন তিনি।

 

ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি

ইরানি ইসলামি বিপ্লব যখন তুঙ্গে, সেই সময়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নেতৃত্বে আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

 

ইরানি বিপ্লবের পরপরই ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে মিশর প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

 

আনোয়ার সাদাতের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে মিশরের অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলা হয়।

 

ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পর খালেদ আল-ইসলামবুলি নামে একজন মিশরীয় সামরিক কর্মকর্তার হাতে নিহত হন আনোয়ার সাদাত।

 

মিশর জুড়ে তখন ব্যাপক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সশস্ত্র ইসলামপন্থী বিপ্লব এমনকি গৃহযুদ্ধের হুমকি দেখা দেয়।

 

মিশরের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের জন্য সাদাতের উপ-প্রধান হোসনি মোবারককে সমর্থন দেয়।

 

কায়রোতে ইরানের সাবেক শাহের উপস্থিতি এবং ইসরাইলের সঙ্গে আনোয়ার সাদাতের শান্তি চুক্তির কারণে ইরান ও মিশরের মধ্যে সম্পর্ক আগে থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। সেই সম্পর্ক পরিণত হল এক ধর্মান্ধ শত্রুতায়।

 

আনোয়ার সাদাতকে হত্যাকারী খালেদ আল-ইসলামবুলিকে একজন সাহসী যোদ্ধা হিসাবে তুলে ধরার জন্য ইরান যে রাজনৈতিক প্রচারণা করত, তারই অংশ হিসাবে তেহরানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় "শহীদ খালিদ আল-ইসলামবুলি স্ট্রিট"।

 

সেই সময়েই মিশর ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা চরমে পৌঁছেছিল।

 

হোসনি মোবারক

ইরান-ইরাক যুদ্ধের শুরুতে মিশর সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন করেছিল এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যখন আরও বাড়তে থাকল, তখন মিশর সাদ্দাম হোসেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে।

 

এমনকি সেই যুদ্ধের জন্য ইরাককে অস্ত্রও দিয়েছিল মিশর।

 

কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত আক্রমণ করে ইরাকের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন মিশর ইরাকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

 

তাতে তেহরান ও কায়রোর মধ্যে সম্পর্কের অবশ্য কোনও উন্নতি হয় নি, ইরান মিশরকে ইসরায়েল ও আমেরিকার পুতুল বলে অভিযুক্ত করতেই থাকে।

 

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাত সমাধানের যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হয় ৯০এর দশকের মাঝামাঝি, মিশর সেটিকে জোরালো ভাবে সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা ওই শান্তি আলোচনার তীব্র বিরোধিতা করেছিল ইরান।

 

একবিংশ শতাব্দী তখন ইসরায়েল এবং এই অঞ্চলের জন্য খুব বেশি শান্তি দিয়ে শুরু হয়নি, বরং বড় আকারের ফিলিস্তিনি প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল।

 

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তেহরান ও কায়রোর মধ্যে মতভেদ আরও গভীর হয়।

 

লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সুন্নি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করেছিল মিশর। কারণ হিজবুল্লার মতো একটি শক্তিশালী শিয়া ইসলামপন্থী সংগঠনের উত্থানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না মিশর।

 

অন্যদিকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে যেভাবে ইরাকে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে, সেটা মিশরের পছন্দ হয় নি।

 

ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি মিশরের সঙ্গে আবারও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করলে দীর্ঘদিন পর দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা হলেও পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

তবে ২০০৯ সালে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে লাখ লাখ ইরানি বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন এবং সেই ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন মিশরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বারবার সেই ভিডিওগুলো দেখাতে থাকত এবং নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপরে সহিংস দমন পীড়নের অভিযোগ তুলে ধরা হত।

 

ইরান সরকার সে বছর ব্যাপক বিক্ষোভের পরেও টিঁকে গিয়েছিল, কিন্তু দুই বছরেরও কম সময় পরে, আরব বিশ্বের বড় অংশে একই ধরণের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

 

হোসনি মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের মুহম্মদ মুরসি নির্বাচনে বিজয়ী হন।

 

মি. মুরসি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তেহরান সফর করেন ২০১১ সালে।

 

আবার দুই বছর পর, মোহাম্মদ আহমাদি নিসজাদ ওআইসি-র একটি সম্মেলনে যোগ দিতে কায়রো সফর করেন।

 

কিন্তু এর পরপরই ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে মিশরীয় সেনাবাহিনী মুরসি সরকারকে উৎখাত করে এবং আবদুল ফাতাহ আল সিসি ক্ষমতা দখল করেন।

 

এর পরের বছরগুলোতে মি. সিসি পুরোপুরি সউদী আরবের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন।

 

এখন যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে ইরান মিশরকে অনুরোধ করেছে যে কায়রো যদি তেহরানের পক্ষে নাও দাঁড়ায়, অন্তত ইরানের শত্রু শিবিরকে যেন মিশর সমর্থন না করে।

 

আবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আর্থিক সহায়তায় চলতে থাকা মিশরের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করাটাও কঠিন।

 

তাই ইরান ও মিশরের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দুটি দেশের সম্পর্কের উন্নতি এবং চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা বৈরিতার অবসানের সম্ভাবনা অনিশ্চিত। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বায়ুদূষণের শীর্ষে কলকাতা, ঢাকা দ্বিতীয়

বায়ুদূষণের শীর্ষে কলকাতা, ঢাকা দ্বিতীয়

তথ্য গোপন মামলায় ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলেও নেই কোনও শাস্তি

তথ্য গোপন মামলায় ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলেও নেই কোনও শাস্তি

সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী কারেন বিদ্রোহীরা, প্রশাসন গঠনে চ্যালেঞ্জ

সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী কারেন বিদ্রোহীরা, প্রশাসন গঠনে চ্যালেঞ্জ

ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাবে জাতীয় নাগরিক কমিটি

ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাবে জাতীয় নাগরিক কমিটি

লস অ্যাঞ্জেলেসে ভয়াবহ দাবানলে নিহতের সংখ্যা ১১, সংকট আরও বাড়ছে

লস অ্যাঞ্জেলেসে ভয়াবহ দাবানলে নিহতের সংখ্যা ১১, সংকট আরও বাড়ছে

মেঘনায় বাল্কহেড-স্পিডবোট সংঘর্ষে নিহত অন্তত ২, একাধিক নিখোঁজ

মেঘনায় বাল্কহেড-স্পিডবোট সংঘর্ষে নিহত অন্তত ২, একাধিক নিখোঁজ

গাজায় টেলিকম সেবা বন্ধের আশঙ্কা , জ্বালানি সংকটে জরুরি সেবা বিপর্যস্ত

গাজায় টেলিকম সেবা বন্ধের আশঙ্কা , জ্বালানি সংকটে জরুরি সেবা বিপর্যস্ত

সিরিয়ায় আসাদ অনুগত কর্মকর্তার জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

সিরিয়ায় আসাদ অনুগত কর্মকর্তার জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি সার্ভিস বন্ধ

ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি সার্ভিস বন্ধ

ইয়েমেনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র-বন্দরে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের হামলা

ইয়েমেনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র-বন্দরে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের হামলা

ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় নিহত আরও ২১,মানবিক বিপর্যয় চরমে

ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় নিহত আরও ২১,মানবিক বিপর্যয় চরমে

ফেনীর মহিপালে এক শিশুসহ ৭ রোহিঙ্গাকে আটক

ফেনীর মহিপালে এক শিশুসহ ৭ রোহিঙ্গাকে আটক

টানা তৃতীয় মেয়াদে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হলেন মাদুরো, নতুন নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের

টানা তৃতীয় মেয়াদে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হলেন মাদুরো, নতুন নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন তামিম ইকবাল

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন তামিম ইকবাল

আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের ১৮ বছর আজ

আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের ১৮ বছর আজ

মেসির সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিলেন সেই সাংবাদিক

মেসির সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিলেন সেই সাংবাদিক

দেশের মানুষ হাসিনার ফাঁসি চায় :ভোলায় সারজিস আলম

দেশের মানুষ হাসিনার ফাঁসি চায় :ভোলায় সারজিস আলম

জীবনযাত্রা ব্যয় আরো বাড়তে পারে

জীবনযাত্রা ব্যয় আরো বাড়তে পারে

সাবেক ওসি শাহ আলমকে ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

সাবেক ওসি শাহ আলমকে ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

মনে হচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসে

মনে হচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসে