জাকাত : আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ-১

Daily Inqilab মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ফাহাদ

০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম

জাকাত। ইসলামের এক শাশ্বত বিধান। নিছক ইবাদত ছাড়াও এতে রয়েছে আত্মিক ও সামাজিক উৎকর্ষ। জাকাত যেমনিভাবে মুসলিমদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিধান করে, তেমনি ধনী-গরিবের বৈষম্যেরও হ্রাস ঘটায়। জাকাত হল আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। কোনো সমাজের দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাওয়া ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার হাতিয়ার। জাকাত বিধানের যথাযথ প্রয়োগ হলে সমাজে সুবিধা বঞ্চিত ও অসহায়-দুস্থ মানুষ যেমন থাকবে না, তেমনি মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে একতরফা সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠারও সুযোগ থাকবে না।

জাকাত ইসলামের অন্যতম ফরয ইবাদত। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হল জাকাত। কুরআন মাজীদের অনেক আয়াতে নামাযের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা সালাত আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। (সূরা বাকারা : ১১০)। এছাড়া জাকাত প্রকৃত পুণ্যশীলের পরিচয়, মুমিনের বন্ধু, সৎকর্মপরায়ণদের বৈশিষ্ট্য, মসজিদ আবাদকারী, কুরআন মাজীদে যাদের জন্য রয়েছে শুভসংবাদ, যাদেরকে বলা হয়েছে হেদায়েতপ্রাপ্ত, ভূ-পৃষ্ঠে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভকারী মুমিনের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিসহ দ্বীনের মৌলিক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও সালাত-যাকাতের বিষয়টি অবধারিতভাবেই আসে।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে : ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি- এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা ও রমযানের রোযা রাখা। (সহীহ বুখারী : ০৮)। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, ‘জাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণ দিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। জাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ জাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। যাকাতের ফরযিয়তকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।’ (ফাতহুল বারী ৩/৩০৯)।
একজন ব্যক্তির মুসলমান হওয়া এবং তার ঈমান প্রকাশের একটি উপায় হল জাকাত। কুরআন মাজীদে সালাত আদায় করা ও জাকাত প্রদানকে মুসলিম হওয়ার আলামত সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : এরপর যদি তারা (কাফেররা) তওবা করে, নামায আদায় করতে শুরু করে এবং জাকাত দিতে শুরু করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। বাস্তবিকপক্ষেই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল এবং বড় অনুগ্রহকারী। (সূরা তাওবা : ০৫)।

আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন : আমাকে মানুষের সাথে লড়াই করার আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যতক্ষণ না তারা নামায কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে। তারা যদি এটা করে, তাহলে নিজেদের প্রাণ ও সম্পদকে হেফাযত করল। যদি না ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা রহিত হয়। আর তাদের (অন্তরের অবস্থার) হিসাব আল্লাহর উপর। (সহীহ বুখারী : ২৫)।

যাকাতের মাধ্যমে মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। কৃপণতা, স্বার্থপরতা, আমিত্ব ইত্যাদি আত্মিক ব্যাধি থেকে জাকাত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আর ফকীর-মিসকীনদের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন থেকেও মনকে পবিত্র করে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পাক-পবিত্র করবেন। (সূরা তাওবা : ১০৩)।

সম্পদের যথাযথ জাকাত আদায় করলে একদিকে যেমন মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি হয়, তেমনি অনাথ-অসহায়ের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পদে পবিত্রতা ও খায়ের-বরকত আসে। আর আল্লাহ তাআলা এর সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করতে থাকবেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর যা তোমরা এই উদ্দেশ্যে দেবে যে, তা মানুষের সম্পদে পৌঁছে বর্ধিত হয়ে আসবে, তা আল্লাহর কাছে বর্ধিত হয় না। আর যা জাকাত দেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়- তো এমন মানুষই আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি করতে থাকবে। (সূরা রূম : ৩৯)। আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন : সদকা দ্বারা সম্পদের হ্রাস ঘটে না। বান্দার ক্ষমার কারণে আল্লাহ তার সম্মানই বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বনকারীকে আল্লাহ মর্যাদাবান করে দেন। (সহীহ মুসলিম : ২৫৮৮)।
ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে সম্পদের জাকাত প্রদানের আদেশ দিয়েছে, তেমনি ইসলামী শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রকে জাকাত উসূল করা এবং এর সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনেরও বিধান দিয়েছে। যার দরুন জাকাত আর্থ-সামাজিক কল্যাণ ও মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি কল্যাণকর ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে, যা একটি সমাজের স্বনির্ভরতা অর্জন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক প্রয়োজনাদি পূরণ ও সমাজের সকল মানুষের সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টির এক কার্যকরী ব্যবস্থা।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুর্নীতির অভিযোগে রাশিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী গ্রেফতার

দুর্নীতির অভিযোগে রাশিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী গ্রেফতার

নাহিদসহ ৩ সমন্বয়ককে হাসপাতাল থেকে ডিবি হেফাজতে

নাহিদসহ ৩ সমন্বয়ককে হাসপাতাল থেকে ডিবি হেফাজতে

গাড়ির কসরৎ দেখিয়ে বিখ্যাত কুইন অফ স্মোক

গাড়ির কসরৎ দেখিয়ে বিখ্যাত কুইন অফ স্মোক

১০০ বছর পর প্যারিসে পর্দা উঠলো অলিম্পিকের

১০০ বছর পর প্যারিসে পর্দা উঠলো অলিম্পিকের

‘খান ইউনিসে’ ৪ দিনে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ লাখ

‘খান ইউনিসে’ ৪ দিনে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ লাখ

পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কা

পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কা

ইসরাইলকে বোমা সরবরাহের নীতি পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র

ইসরাইলকে বোমা সরবরাহের নীতি পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র

১ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে লোকসান ৬ কোটি

১ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে লোকসান ৬ কোটি

বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন

বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন

বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’

বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’

চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক

চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি