বান্দা জানে না, কিসে তার কল্যাণ-২

Daily Inqilab মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৪ এএম

আমরা প্রত্যেকেই জীবনে বহু পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে জাগতিক সাফল্য লাভে ব্যর্থ হই, তাহলে মন খারাপ করে হতাশ হয়ে বসে পড়ি। আবার অনেক সময় কোনো একটি বিষয় অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর মনে হয়, তা থেকে বাঁচার জন্য সবরকম চেষ্টা করি, তারপর যখন সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টির সম্মুখীন হতেই হয়। তখন সাধারণত মনে হয়, আমার তো বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে এবং মানসিকভাবে এমন ভেঙে পড়ি, যেন জীবন শেষ হয়ে গেছে।


অথচ হতেই পারে যে, বিষয়টির বাস্তব কল্যাণ আমার বাহ্যিক দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে বলে আমি তা বুঝতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে সূরা বাকারার ২১৬ নং আয়াতের বার্তাটি মনে রাখা দরকার, আয়াতটির বার্তা হলোÑ ‘তোমার প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণ কিসেÑ তা তুমি জানো না, আল্লাহ তাআলা জানেন। তুমি যা কামনা করছ, বাস্তবে তা তোমার জন্য দুঃখজনকও হতে পারে, আর যা অপছন্দ করছ, তা হতে পারে প্রভূত সুফলবাহী। কাজেই তোমার কর্তব্য-করণীয়র ফয়সালা আল্লাহ তাআলার ওপর ছেড়ে দাও এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলো। আর তাকদির অনুযায়ী যা ঘটে তাতেই খুশি ও সন্তুষ্ট থাকো।’


অন্ততপক্ষে ইসলামের এই শিক্ষা তো সবসময়ই মনে রাখা দরকার যে, মুমিন বান্দার জীবনে কষ্টকর যা কিছু ঘটে, তাতে যদি সে সবর করে, তাহলে আখিরাতে সে জন্য সে মহাপ্রতিদান পাবে। নবীগণের জীবনেও এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, বাহ্যিকভাবে যেটা খুব দুঃখজনক ছিল, কিন্তু পরিণতিতে সেটি তাদের জীবনের জন্য অভূতপূর্ব কল্যাণকর হয়ে দেখা দিয়েছিল।


যেমন, ফেরাউন যখন বনি ইসরাইলের নবজাতক পুত্রদেরকে হত্যা করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল, তখন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তার মাকে আল্লাহ তাআলা এই প্রত্যাদেশ পাঠালেন, মুসা আলাইহিস সালামকে যেন একটি বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের জন্য এটি কত কষ্টের বিষয় ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মেনে তিনি তাই করলেন। পরবর্তী ঘটনা আমাদের সবারই জানা রয়েছে, কীভাবে ফেরাউনেরই ঘরে থেকে মুসা আলাইহিস সালামের জীবন রক্ষা হলো।


রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা আছে। ষষ্ঠ হিজরিতে মক্কার কাফেরদের সঙ্গে যখন মুসলমানদের হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়েছিল, তখন সন্ধির শর্তনামা বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্য কিছুটা অবমাননাকরই ছিল বৈকি। একে তো এত বছর পরে মক্কার কাছাকাছি এসেও পবিত্র কাবাকে এক নজর না দেখেই ফিরে যেতে হচ্ছে। তার ওপর সন্ধির কিছু শর্ত এমন ছিল যে, ‘মুসলমানরা পরের বছর ওমরা পালন করতে এসে মাত্র তিন দিন থাকতে পারবে। আসতে হবে নিরস্ত্র হয়ে, সঙ্গে কোনো হাতিয়ার থাকতে পারবে না। আর সন্ধি বলবৎ থাকা অবস্থায় কুরাইশের কেউ যদি মুসলমানদের কাছে চলে যায়, তাহলে মুসলমানরা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু কোনো মুসলমান যদি কাফেরদের কাছে চলে যায়, তাহলে কাফেররা তাকে ফেরত দেবে না।’


রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের সব শর্তই মেনে নিলেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এমন শর্তে সন্ধি করতে অপছন্দ করছিলেন। কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আপত্তিও জানিয়েছিলেন। বাহ্যিক বিচারে সন্ধির এই শর্তগুলোকে অপছন্দ করা ও আপত্তিজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ সন্ধিকেই ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে কুরআনে আয়াত নাজিল করেছেন। কারণ এ সন্ধির ফলে ইসলাম প্রচার আরো সহজ হয়ে গেল।


মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে ব্যস্ত থাকায় অন্যান্য অঞ্চলে যথাযথভাবে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হচ্ছিল না। হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণে যেহেতু যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল, তাই আরবের বাইরে ইসলামের দাওয়াত প্রচারে পূর্ণ মনোনিবেশ করা গেল। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দিকে দিকে দূত পাঠালেন। এ সময়েই রোম সম্রাট কিসরাসহ ব্যাপকভাবে অন্যান্য রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের কাছে চিঠি পাঠানো হলো।


হুদায়বিয়া সন্ধির আগে মক্কা-মদিনার বাইরে সর্বত্র ইসলাম প্রচারের সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এ সন্ধির কারণে ব্যাপকভাবে তা করার সুযোগ মিলেছে। ফলে হুদায়বিয়া সন্ধির সময় যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশর মতো। এর মাত্র দুই বছর পরে মক্কা বিজয়ের সময় সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। ইসলামের প্রচারই তো হলো মূল লক্ষ্য।
এ লক্ষ্য সাধন হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এটিই তো হলো আসল বিজয়। তাছাড়া এ সন্ধি মক্কা বিজয়ের পথ আরো সুগম করে দিয়েছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়েছিল ষষ্ঠ হিজরিতে। আর এর মাত্র দুই বছর পরে অষ্টম হিজরিতে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করেন। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো কাছে যে সন্ধি অপছন্দনীয় মনে হয়েছিল, আল্লাহ তাআলা সেটিকেই মুসলমানদের বিজয়ের প্রথম পদক্ষেপ বানিয়েছিলেন।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

পিতার কর্তব্য : সন্তানকে সময় ও সঙ্গদান-১
ইসলামে সহমর্মিতা ও সমাজসেবা
রমজানের বিদায়েও জাগ্রত থাকুক সাওমের শিক্ষা
ঈদুল ফিতর : ‘আল্লাহু আকবারে’র চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার দিন
সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ
আরও
X

আরও পড়ুন

পাস করে চাকরির জন্য নেতাদের পেছনে ঘুরতে হবে না:  আমিন

পাস করে চাকরির জন্য নেতাদের পেছনে ঘুরতে হবে না: আমিন

সিরিয়ার তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত ঘাঁটিতে ইসরাইলের হামলা, আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা

সিরিয়ার তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত ঘাঁটিতে ইসরাইলের হামলা, আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা

ধামরাইয়ে প্রচন্ড  ঝড়ে আঞ্চলিক মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট

ধামরাইয়ে প্রচন্ড  ঝড়ে আঞ্চলিক মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট

জনগণকে সাথে নিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আদায় করে নিব: ইশরাক

জনগণকে সাথে নিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আদায় করে নিব: ইশরাক

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সংলাপ হচ্ছে এক যুগ পর

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সংলাপ হচ্ছে এক যুগ পর

বাংলাদেশ থেকে সবসময় নেয়ার চেষ্টা করেছে ভারত: জামায়াত

বাংলাদেশ থেকে সবসময় নেয়ার চেষ্টা করেছে ভারত: জামায়াত

বিএনপি এদেশের জনগণের আস্থার দল -আমান উল্লাহ আমান

বিএনপি এদেশের জনগণের আস্থার দল -আমান উল্লাহ আমান

বিভেদ না করে সম্প্রীতি বজায় রেখে সহাবস্থান করুন : সুপ্রদীপ চাকমা

বিভেদ না করে সম্প্রীতি বজায় রেখে সহাবস্থান করুন : সুপ্রদীপ চাকমা

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১

আমেরিকার পথে 'ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ'র দল

আমেরিকার পথে 'ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ'র দল

আনোয়ারায় ৭০জন বাচ্চাকে ফ্রি খতনা

আনোয়ারায় ৭০জন বাচ্চাকে ফ্রি খতনা

বাংলাদেশি লেনিন অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় নির্বাচনে লিবারেল পার্টির সংসদ সদস্য প্রার্থী

বাংলাদেশি লেনিন অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় নির্বাচনে লিবারেল পার্টির সংসদ সদস্য প্রার্থী

উইন্ডিজ ও দ. আফ্রিকাকে আতিথেয়তা দেবে ভারত

উইন্ডিজ ও দ. আফ্রিকাকে আতিথেয়তা দেবে ভারত

বিচার বিভাগ অভ্যন্তরীণ সংস্কারের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে-প্রধান বিচারপতি

বিচার বিভাগ অভ্যন্তরীণ সংস্কারের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে-প্রধান বিচারপতি

তামিমের চিন্তাভাবনাকে 'অশিক্ষিত' বললেন সালাউদ্দিন

তামিমের চিন্তাভাবনাকে 'অশিক্ষিত' বললেন সালাউদ্দিন

নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ স্নানোৎসব পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ স্নানোৎসব পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচি

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচি

বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন ফ্যাসিস্ট যেন জন্মাতে না পারে সেটাই আমাদের লক্ষ্য - খোকন তালুকদার

বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন ফ্যাসিস্ট যেন জন্মাতে না পারে সেটাই আমাদের লক্ষ্য - খোকন তালুকদার

প্রথমবারে মিয়ানমার ফেরত নিচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের উল্লাস

প্রথমবারে মিয়ানমার ফেরত নিচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের উল্লাস

পড়ালেখা শেষে শিক্ষার্থীদেরকে দেশ ও জাতির সেবক হিসাবে কাজ করতে হবে-সোলায়মান চৌধুরী

পড়ালেখা শেষে শিক্ষার্থীদেরকে দেশ ও জাতির সেবক হিসাবে কাজ করতে হবে-সোলায়মান চৌধুরী