আল কুরআনে মানব হত্যার শাস্তি-২

Daily Inqilab মাওলানা মুহাম্মাদ আনোয়ার হুসাইন

১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো, নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কোনো রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থা যদি নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সে আইনের সার্থকতা কোথায়? ইসলাম মানবজীবন রক্ষায় ও তার নিরাপত্তা বিধানে প্রণয়ন করেছে কিসাসের মতো ইনসাফপূর্ণ কঠিন বিধান। পাশাপাশি হত্যাকারীর জন্য রয়েছে পরকালে ভয়াবহ আযাবের ঘোষণা। কুরআনের বাণী শাশ্বত ও চিরন্তন। কুরআনের কিসাসের বিধান কোনো রাষ্ট্রে যথাযথভাবে কার্যকর হলে অন্যায় রক্তপাত, হানাহানি, খুন-খারাবী ও হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ সমাজে বিস্তার লাভ করবে না।

রাজনৈতিক প্রভাবে, ক্ষমতার দাপটে চাইলেই কেউ এ অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না। সমাজ থেকে অবিচার ও জুলুম বহু গুণে হ্রাস পাবে। শত-সহস্র বছরের ইতিহাস এর জলজ্যান্ত সাক্ষ্য। ইতিহাসে যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ দমন করতে কিসাসের বিধান যতটা কার্যকরী হয়েছে, মানব রচিত কোনো আইন দ্বারা এমন সফলতা আসেনি। তাই কিসাসের বিধান হলো মানবজীবন রক্ষার হাতিয়ার ও রক্ষাকবচ। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ ‘এবং হে বুদ্ধিমানেরা! তোমাদের জন্য কিসাসের ভেতর রয়েছে জীবন (রক্ষার ব্যবস্থা)। আশা করা যায় তোমরা (এর বিরুদ্ধাচরণ) পরিহার করবে।’ (সূরা বাকারা-১৭৯)

ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআন-সুন্নাহর আইনের বিকল্প নেই। এখানে একজন সাধারণ নাগরিক থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির হক ও অধিকার সমান। হক ও অধিকারের ক্ষেত্রে সিআইপি বা ভিআইপি বলে আলাদা কোনো স্থান ইসলামে নেই। ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার সোনালি ইতিহাস দেখলে বিষয়টি কারো অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।

পূর্বে আলোচিত হয়েছে, অন্যায় হত্যার বদলে নিহতের ওয়ারিসগণ হত্যাকারী থেকে কিসাস গ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কুরআন নিহতের ওয়ারিসকে এ অধিকারও দিয়েছে, তারা চাইলে হত্যাকারী থেকে কিসাস না নিয়ে তাকে মাফ করে দেবে, আবার দিয়ত তথা আর্থিক সুবিধা নিয়েও মাফ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ ‘অতঃপর হত্যাকারীকে যদি তার ভাই (নিহতের ওলি)-এর পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করা হয়, তবে ন্যায়ানুগভাবে (রক্তপণ) দাবি করার অধিকার (ওলির) আছে। আর উত্তমরূপে তা আদায় করা (হত্যাকারীর) কর্তব্য। এটা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক লঘুকরণ এবং একটি রহমত। এরপর কেউ সীমালঙ্ঘন করলে সে যন্ত্রণাময় শাস্তির উপযুক্ত।’ (সূরা বাকারা- ১৭৮)

ইসলামে মার্সি অর্থাৎ কিসাস মাফ করার অধিকার রয়েছে কেবল নিহতের ওয়ারিসগণের। অন্য কারো নিজের পক্ষ থেকে হত্যাকারীকে ক্ষমা করার বা শাস্তি পরিবর্তন করার কোনো অধিকার নেই। কোনো রাষ্ট্রের আইনে যদি খুনিকে ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানকে দেয়া থাকে আর সে ক্ষমতাবলে খুনিকে তিনি ক্ষমা করে দেন, তবে দেশীয় আইনে সে ক্ষমা পেয়ে গেলেও আল্লাহর আইনে সে ক্ষমা পাবে না। আল কুরআন এ অধিকার তো কোনো রাষ্ট্রপতিকে দেয়নি। ইতিহাসে যে সব সমাজে মানব রচিত আইনে বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার কুফল ও অশুভ পরিণামও সে সমাজ দেখতে পেরেছে।

তবে মনে রাখতে হবে, কুরআনের অন্যান্য বিধানের মতো কিসাসও কার্যকর করার অধিকার কেবল সরকারের। নিহতের আত্মীয়বর্গ বা অন্য কোনো ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে এসব বিধান কার্যকর করার অধিকার রাখে না। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণিত হলে রাষ্ট্র সে রায় কার্যকর করবে।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার আদালতে সব অন্যায়-অবিচারের বিচার হবে। সেখানে আল্লাহর হকের যেমন বিচার হবে, তেমনি বান্দার হকেরও বিচার হবে। বান্দার হক সম্পর্কিত যতো মোকাদ্দমা রয়েছে, কিয়ামতের দিন তার মধ্যে সর্বপ্রথম বিচার হবে রক্তপাত ও হত্যার। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকাদ্দমার ফয়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত। (সহিহ মুসলিম-১৬৭৮)

মানব রচিত আইনে মিথ্যা, জালিয়াতি, ঘুষ, দুর্নীতি বা প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে কেউ পার পেয়ে গেলেও আল্লাহর আদালতে সেদিন কেউই বাঁচতে পারবে না।

হত্যার শাস্তি আখেরাতের বিচারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ ‘আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তার মধ্যে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন ও তাকে অভিশাপ দেবেন। তেমনিভাবে তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি।’ (সূরা নিসা-৯৩)

উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্ট, ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যা করা হলে এর পরিণামেÑ এক. জাহান্নামের দীর্ঘস্থায়ী আযাব ভোগ করতে হবে। দুই. হত্যাকারীর প্রতি আল্লাহর গযব নাযিল হবে। তিন. সে আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত হবে। চার. জাহান্নামে তার আযাব দ্বিগুণ হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফীক দান করুন। খুন-খারাবির মতো ঘৃণ্য অপরাধ নির্মূল করতে সর্বত্র কুরআন-সুন্নাহর বিধান বাস্তবায়নের তাওফীক দান করুন।(আমীন)


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আজ ছোট পর্দায় মুক্তি পাবে নাটক 'হোয়াট এ বৌ'

আজ ছোট পর্দায় মুক্তি পাবে নাটক 'হোয়াট এ বৌ'

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ছবি সরিয়ে ফেললেন ভারতের সেনাপ্রধান

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ছবি সরিয়ে ফেললেন ভারতের সেনাপ্রধান

বরিশাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যলায়েড সায়েন্সেস চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক অবদান রাখছে

বরিশাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যলায়েড সায়েন্সেস চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক অবদান রাখছে

হাসিনাকে নিয়ে ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি’তে সচেতন ছিলেন না টিউলিপ এটি ‘দুঃখজনক’ : লরি ম্যাগনাস

হাসিনাকে নিয়ে ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি’তে সচেতন ছিলেন না টিউলিপ এটি ‘দুঃখজনক’ : লরি ম্যাগনাস

শেখ পরিবার একটি চোরের কারখানা’

শেখ পরিবার একটি চোরের কারখানা’

অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতা মামুন

অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতা মামুন

জিমি কার্টারের প্রতি ৩০ দিনের শোকাবস্থা উপেক্ষা করে ট্রাম্পের পতাকা উত্তোলন

জিমি কার্টারের প্রতি ৩০ দিনের শোকাবস্থা উপেক্ষা করে ট্রাম্পের পতাকা উত্তোলন

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা: খালেদা-তারেকসহ সব আসামি খালাস

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা: খালেদা-তারেকসহ সব আসামি খালাস

টিউলিপের জায়গায় নিয়োগ পেলেন এমা রেনল্ডস

টিউলিপের জায়গায় নিয়োগ পেলেন এমা রেনল্ডস

পদত্যাগপত্রে টিউলিপ সিদ্দিক যা লিখেছেন

পদত্যাগপত্রে টিউলিপ সিদ্দিক যা লিখেছেন

টিউলিপের পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেস উইংয়ের বিবৃতি

টিউলিপের পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেস উইংয়ের বিবৃতি

আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে কায়রো, ঢাকার অবস্থান ৬ নম্বরে

আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে কায়রো, ঢাকার অবস্থান ৬ নম্বরে

মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!

মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!

মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার

মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার

দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার

দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার

আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ

আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে

ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার

ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই

শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি

শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি