পিতার কর্তব্য সন্তানকে সময় ও সঙ্গদান-৩

Daily Inqilab মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

সন্তানের হাত ধরা উচিত। যতটা তার বিদ্যাচর্চার জন্য তারচেয়ে অনেক বেশি তার ব্যক্তি গঠনÑ আখলাক-চরিত্র নির্মাণ ও মানবিকতা বিকাশের জন্য। এই জিনিসের আজ বড় আকাল অথচ এটাই মানুষের আসল সম্পদ। এ সম্পদে নিজ সন্তানকে বলিষ্ঠ করতে হলে বালক বয়সেই তার হাত ধরতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা যেই বিশুদ্ধ স্বভাব দিয়ে তাকে সৃষ্টি করেছেন তার যাতে অক্ষুণœ বিকাশ ঘটতে পারে। নিজ আচরণ তো বটেই, সেইসঙ্গে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যকিছুর প্রভাবে তা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে না পারে। সব শিশুই জন্মায় নিষ্কলুষ চরিত্র নিয়ে। হাদিসের ভাষ্য মতে সর্বপ্রথম নষ্ট তাকে বাবাই করে। বেশির ভাগ তো নিজ চরিত্র দোষেই সন্তানকে দুষ্ট করে। আর অনেকেই তাকে নষ্ট হতে সাহায্য করে তার হাল ছেড়ে দিয়ে। অর্থাৎ তাকে সময় ও সঙ্গ দেয় না। ফলে সে অসৎ সঙ্গ বা বদ পরিবেশের শিকার হয়ে যায়।

তাছাড়া কিছু জিনিস আছে, যা হাতে ধরেই শিক্ষা দিতে হয়। যেমন আদব-কায়দার বিষয়টা। বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করা ছাড়াও জীবনাচারের প্রতিটি বিষয়েই আদব আছে। আদবেই জীবনের সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠতম মানদÑ নবী কারীম (সা.)-এর সুন্নত। সুন্নতসম্মত জীবনাচারের চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নেই। আপন সন্তানের সেই সৌন্দর্যের রূপকার তো পিতা-মাতাকেই হতে হবে। অন্য কেউ এসে এখানে তুলি চালাবে না। যথাযথ চালাতে পারবেও না।

পিতা-মাতার পক্ষেই সম্ভব নিজ সন্তানের হাঁটা, বসা, হাসি, কান্না, শয়ন, জাগরণ, সম্পর্কের স্তর অনুযায়ী মানুষের সাথে আচরণ, মজলিসে অবস্থান, নৈসঙ্গ যাপন, পানাহার সামগ্রী গ্রহণ, প্রাকৃতিক ভার নিঃসারণ, হাদিয়া প্রদান, হাদিয়া গ্রহণ, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান, পরিবর্তন প্রভৃতি যত আচার ও অনুষঙ্গ আছে সব কিছুর আদব ও সুন্নতসম্মত পদ্ধতি শিক্ষাদান করা। শিশুকে সঙ্গদান ছাড়া এটা কি করে সম্ভব। এটা বিদ্যাচর্চার বিষয় নয় যে, একদিনে সবক পড়িয়ে দেয়া হলো আর ছাত্র তা মুখস্থ করে নিল। এর জন্য দরকার নিয়মিত অনুশীলন। যার জন্য সন্তানকে সময় ও সঙ্গদানের কোনো বিকল্প নেই।

মোটকথা, মানবিক উৎকর্ষ ও বিকাশের লক্ষ্যে সন্তানের পথ চলায় পিতাকে তার হাত ধরে রাখতে হবে শক্ত করে এবং ধরতে হবে চলার সূচনাতেই। ওহে ‘হাকীম কিশোর’Ñ আল্লাহ তাআলা হিকমতের ভরপুর ঐশ্বর্য তোমাকে দান করুন। তুমি বাবাদের চোখ খুলে দিলে। তোমার মূল্যবান বার্তাটি বাবাদের হৃদয়-কানে পৌঁছানোর লক্ষ্যেই আমার এ কলম ধরা।

তবে তুমি আশ্বস্ত হতে পার যে, তোমার মহান পিতা হাতে না হোক গলাতে হলেও তোমাকে ধরেছেন। আকছার সন্তানই তো পিতাদের এমন ধরা হতে বঞ্চিত থাকে, যার ভেতর থাকে কোনো আশ্বাসবাণী। তদুপরি আশার কথা হলো, তুমি যাকে গলায় ধরা বলেছ, প্রকৃত বিচারে তা প্রায় হাতে ধরাই। কারণ শারীরিক চলার যে বয়স তদপেক্ষা মানসিক ও মানবিক চলার সূচনা একটু পরেই হয়। বলা যায় সেই সময়টাই তোমার যাচ্ছে। কাজেই ধরার আসল সময় এখনই। সেটা যে তুমি পেয়ে গেছ তোমার অভিযোগেই তা প্রকাশ। আল্লাহ তাআলা একে তোমার জন্য বরকতময় করুন এবং তোমার পথ সুগম করে দিন।

প্রিয় পাঠক! যে কথা বলা হলো, তা হাতে ধরার তাফরীত বা শিথিলতার দিক। এর বিপরীত একটা দিকও আছে। সন্তানকে ধরে ধরে যারা চালাতে চায় তাদের অনেকে ইফরাত ও বাড়াবাড়িও করে থাকে। সেটাও কম ক্ষতিকর নয়।

অনেক পিতা সন্তানের পক্ষে সাক্ষাৎ আতঙ্ক। তারা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নয়; বরং নিজের বর্তমান অবস্থান থেকে সন্তানকে দেখে। সন্তানের বয়স ও রুচি-প্রকৃতি এবং তার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য চিন্তায় রাখে না। শাসন করে সব কিছুতেই। বয়সের স্বাভাবিক প্রবণতাকেও চোখ-রাঙানি দেয়। এরূপ মানসিকতা পরিত্যাজ্য। সময় ও সঙ্গদান হতে হবে সৌহার্দপূর্ণ। হতে হবে স্বস্তিকর ও ভরসাব্যঞ্জক।

অন্যথায় সন্তানের পক্ষে পিতার সাহচর্যের সময়টাই হবে সর্বাপেক্ষা দুর্বিষহ। সেক্ষেত্রে সন্তান পিতার থেকে দূরে থাকতে চাইবে। সে পালাবে। পালানোর সুযোগ না পেলেও মনের দিক থেকে পিতার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হবে। আর সেই দূরত্বই সন্তানকে বিপথে নেবে। অভিজ্ঞতা বলে, পিতার সঙ্গে যেই সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায় সেই সন্তানের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সুতরাং ই‘তিদাল বা ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।

সন্তানকে সময় ও সঙ্গও দিতে হবে আবার তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকেও মর্যাদা দিতে হবে। তার স্বাধীন সত্তার বিলোপ ঘটালে ব্যক্তিগঠনের প্রয়াস বৃথা যাবে। সন্তান তো আমি স্বয়ং নয়। সে এক পৃথক অস্তিত্বের ধারক। সেই অস্তিত্ব নিয়েই তাকে চলতে দিতে হবে। হাত ধরা ও সতর্ক দৃষ্টি রাখা কেবল এই লক্ষ্যে, যাতে সে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী স্বকীয়তার সাথে চলতে পারে। চলার ভরসা পেতে পারে, যাতে সে পারিপার্শ্বিকতার গ্রাস না হয়ে পড়ে।

পথের কাঁটা দেখে ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং যাতে পথের মোড়-বাঁকে নির্দেশনা পায়। শত্রুর হাতছানিতে প্রলুব্ধ না হয় এবং এমনিভাবে অনাকাক্সিক্ষত আপতনে বিপন্নবোধ না করে; বরং পিতৃসাহায্যে তা থেকে উদ্ধারের উপায় খুঁজে পায়। এভাবে না শিথিলতা এবং না কঠোরতা; বরং উভয় প্রান্তিকতার ঠিক মাঝখানে থেকে সন্তানের হাত ধরলে আশা করা যায় সম্ভাবনা ও সাফল্যের উচ্চতায় একদিন সে পৌঁছেই যাবে- ইনশাআল্লাহ।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সন্তান লালন-পালন : মা-বাবার কিছু করণীয়-১
আখেরাতে মানুষের তিনটি শ্রেণি-৩
আখেরাতে মানুষের তিনটি শ্রেণি-২
আখেরাতে মানুষের তিনটি শ্রেণি-১
মসজিদের আদব রক্ষা তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ-২
আরও
X

আরও পড়ুন

মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও যুক্তরাষ্ট্রে 'বরবাদ' ঝড়

মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও যুক্তরাষ্ট্রে 'বরবাদ' ঝড়

সৌদির পবিত্র নগরীতে কনসার্ট আয়োজন,মুসল্লিদের ক্ষোভ প্রকাশ

সৌদির পবিত্র নগরীতে কনসার্ট আয়োজন,মুসল্লিদের ক্ষোভ প্রকাশ

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে