দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত

Daily Inqilab হাফেজ ডা:.মো. আনোয়ার হোসেন

১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম

ইসলামে যাকাত একটি আর্থিক ইবাদত যা পঞ্চস্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এর ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব। যাকাত ব্যবস্থা হল বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যেটাকে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সমাজের অসহায় দরিদ্র নিপীড়িত ও পিছিয়ে পড়া জনগণকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিয়ে সবল ও স্বাবলম্বী করার জন্য ইসলামে যাকাতের বিধান রাখা হয়েছে।

 

 

যাকাতের মূল উদ্দেশ্য: গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সাম্যবৃত্তিক সমাজ গঠন করা। যাকাত সমাজ থেকে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করে। সামাজিক নিরাপত্তা দানের পাশাপাশি দূর করে সম্পদের বৈষম্য। ইসলামী অর্থব্যবস্থা একটি পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি মালিকানা কে অস্বীকার করা হয়নি এবং কার্যহীনও রাখা হয়নি।

 

এই অর্থব্যবস্থায় সম্পদ অর্জনের যেকোনো পন্থাকে বৈধতা দেওয়া হয়নি। বরং সম্পদ ধনীদের থেকে গরিবদের মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের অর্থশীলদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়'। সূরা হাশর - ৫৯ সর্বোপরি কথা হল যাকাত দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি করুণা নয় বরং এটা তাদের অধিকার আল্লাহ তায়ালা যেমন ধনীদের সম্পদ দিয়েছেন তেমনি তার সম্পদে গরিবের হক ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে 'আর তাদের সম্পদে হক রয়েছে প্রার্থনাকারীদের ও বঞ্চিতদের জন্য'। সূরা মাআরিজ - ৭০

ইসলামী অর্থব্যবস্থার উৎস গুলোর মধ্যে যাকাত হলো অন্যতম। এর উপর ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও জনকল্যানমুখী প্রকল্পসমূহের সাফল্য নির্ভরশীল।

 

যাকাতের মাধ্যমে নগদ অর্থের হাত বদল হয় এতে সম্পদের গতিশীলতা আসে ফলে প্রচুর লোক ক্রয় ক্ষমতা অর্জন করে। তাতে চাহিদা ও ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়, কর্মসংস্থান তৈরী হয়। যার ফলে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয়। মজবুত ও শক্তিশালী হয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভীত, ফলে দিনে দিনে সম্পদশালী লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

যাকাত কোন রেওয়াজ নয় এটা হল একজন মুমিনের ঈমানের পরিচায়ক। এর মাধ্যমে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। বর্তমান সমাজে যাকাতের নামে চলছে প্রদর্শনের বিরাট মহড়া। আমাদের সমাজে যাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি দেওয়ার যে রেওয়াজ তৈরি হয়েছে তা ইসলামে মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। এগুলো ধনীদের জাহির করা, মিডিয়ায় প্রচার করা এবং গরিবদের ছোট করা ছাড়া আর কিছুই না। এতে করে যাকাতের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পরিবর্তন হয়না দরিদ্রের দারিদ্রতার চিত্রও।

 

 

কিভাবে যাকাত দিলে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব: দারিদ্র্যের কারণে প্রায়ই দেখা যায় জনগণের একটি বিরাট অংশকে আনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। যে শিশু নিজেকে আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তোলার কথা ছিল বাস্তবতা সেখানে ভিন্ন। বেকারত্ব বাড়ছে দ্রুতগতিতে। দারিদ্র বিমোচনের স্লোগানকে পুঁজি করে ঋণ দেওয়ার নামে সুদি ব্যবসা বর্তমানে জমজমাট। এর কারণে সুদ ভিত্তিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার দারস্থ হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে জনগণ। যার ফলে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি না পেয়ে দরিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সুদের কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে ভিটামাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে অনেককে। আবার কেউ কেউ ঈমানের কারণে দায়মুক্তি নিচ্ছে যেটি পত্রিকায় খবর প্রকাশ পেয়েছে।

সমাজের প্রতিটা বিত্তবান ব্যক্তি যদি যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের প্রতি যত্নশীল হয় তাহলে অতি অল্প সময়ের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।

 

ইতিহাস সাক্ষী তখন ছিল ইসলামের স্বর্ণালী যুগ, ক্ষমতায় ছিলেন হযরত ওমর (রা)। তিনি বিত্তবান ব্যক্তি থেকে যাকাত আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে সুষম বন্টন করেন এতে করে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক বিশাল পরিবর্তন ঘটে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে পুরো মুসলিম বিশ্বে যাকাত গ্রহণ করবে এমন দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পরেছিল।

কোরআনের আলোকে যাকাত প্রদানের খাত যেমন সুনির্দিষ্ট তেমনি সুনির্দিষ্ট এর বন্টন ব্যবস্থাও। তাই যাকাত এমনভাবে দিতে হবে যাতে গ্রহীতার অভাব দূর হয় এবং স্বাবলম্বী হয়।
এজন্য যাকাতের অর্থ শত শত মানুষের মধ্যে বিতরণ না করে সুনির্দিষ্ট মুষ্টিমেয় লোককে নির্ধারণ করে যাকাত দিলে সেখানে উদ্দেশ্য হাসিল হবে।
উদাহরণস্বরূপ - যাকাত গ্রহীতা যদি রিক্সা/ ভ্যান চালাতে পারে তাহলে একটি রিক্সা/ ভ্যান কিনে দেওয়া যায়। যদি সেলাই মেশিন চালাতে পারে তাহলে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে যেমন চায়ের দোকান, মুদির দোকান ইত্যাদি । গরু, ছাগল কিনে দেওয়া যেতে পারে যেটা দ্বারা সাবলম্বী হওয়া সম্ভব। হত দরিদ্র এতিম সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো যেতে পারে। অসহায় বাবার মেয়ের বিবাহের আনজাম দেওয়া, রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে যাকাত দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে যারা ইসলামের মহান সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছেন তাদেরকে স্বাবলম্বী করে দেওয়া যেতে পারে, যাতে তাদের অন্যের কাছে সাহায্যর জন্য হাত পাততে না হয়। যারা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয় গেছে সে তার পাওনা পরিশোধ করতে

একেবারেই অক্ষম, আমরা তাকে সাহায্য করতে পারি। অনেকে বাড়ি ভাঙ্গনের কারণে সর্বস্ব হারা হয়ে গেছে তাদের আবাসন ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
অর্থাৎ এভাবে যাকাতের টাকা দিয়ে যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় তবে দরিদ্র বিমোচন হবে এবং টেকসই উন্নয়ন প্রতিফলিত হবে।

 

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করে বেকার ও গরীবদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে দারিদ্র্যতা দূর হবে এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে দূর হবে ধনী-দরিদ্রের শ্রেণী ও সম্পদের বৈষম্য কাজেই ধনীদের শরীয়তের বিধান অনুসারে যাকাত আদায় করা একান্ত কর্তব্য।

 

**লেখক: শিক্ষার্থী ( জেনারেল সার্জারী বিভাগ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জোড়া গোলে মিউনিখে বায়ার্নকে রুখে দিলেন ভিনিসিয়ুস

জোড়া গোলে মিউনিখে বায়ার্নকে রুখে দিলেন ভিনিসিয়ুস

মার্কিন পতাকা নামিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ল ফিলিস্তিনের ঝান্ডা!

মার্কিন পতাকা নামিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ল ফিলিস্তিনের ঝান্ডা!

ক্যাডবারি চকোলেটের ওপর মিলল ফাঙ্গাস

ক্যাডবারি চকোলেটের ওপর মিলল ফাঙ্গাস

পেরুতে ৬৫০ ফুট গভীর খাদে পড়ল বাস, হতাহত ৪৫

পেরুতে ৬৫০ ফুট গভীর খাদে পড়ল বাস, হতাহত ৪৫

সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে জাপানের কড়াকড়ি : চীনের উদ্বেগ

সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে জাপানের কড়াকড়ি : চীনের উদ্বেগ

সিনচিয়াংয়ের মরুভূমিতে চলছে ধানচাষ

সিনচিয়াংয়ের মরুভূমিতে চলছে ধানচাষ

পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে ভয়ংকর হাতিয়ার বানাল ইরান

পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে ভয়ংকর হাতিয়ার বানাল ইরান

রুকু থেকে উঠার সময় ‘সামিআললাহু লীমান হামিদাহ’ বলা প্রসঙ্গে।

রুকু থেকে উঠার সময় ‘সামিআললাহু লীমান হামিদাহ’ বলা প্রসঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রে আসামি ধরতে গিয়ে গুলিতে ৩ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত

যুক্তরাষ্ট্রে আসামি ধরতে গিয়ে গুলিতে ৩ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত

ইন্দোনেশিয়ায় ফের আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত

ইন্দোনেশিয়ায় ফের আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত

অতি বাম আর অতি ডান মিলে সরকার উৎখাতে কাজ করছে : প্রধানমন্ত্রী

অতি বাম আর অতি ডান মিলে সরকার উৎখাতে কাজ করছে : প্রধানমন্ত্রী

জার্মানিতে ৬ বছরের নিখোঁজ শিশুর সন্ধানে ১,২০০ জন

জার্মানিতে ৬ বছরের নিখোঁজ শিশুর সন্ধানে ১,২০০ জন

বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ ‘প্রত্যাখ্যান’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের

বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ ‘প্রত্যাখ্যান’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ কি বৈধ?

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ কি বৈধ?

পান্নুনকে খুন করতে ‘হিটম্যান’ পাঠিয়েছিল ‘র’ অফিসার!

পান্নুনকে খুন করতে ‘হিটম্যান’ পাঠিয়েছিল ‘র’ অফিসার!

জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান প্রেসিডেন্টের

জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান প্রেসিডেন্টের

২০৩০ সাল নাগাদ চীনে বাণিজ্যিকভাবে আসবে ৬-জি

২০৩০ সাল নাগাদ চীনে বাণিজ্যিকভাবে আসবে ৬-জি

কলম্বিয়ায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ৯ সেনা নিহত

কলম্বিয়ায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ৯ সেনা নিহত

বহির্বিশ্বে মিলল প্রাণের সন্ধান!

বহির্বিশ্বে মিলল প্রাণের সন্ধান!

মোদির ভারতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মুসলিমদের

মোদির ভারতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মুসলিমদের