রবীন্দ্রনাথ ও পত্রসাহিত্য

Daily Inqilab রেশম লতা

১১ মে ২০২৩, ০৮:০৯ পিএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম

রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে পত্রসাহিত্য সাহিত্যকর্মের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়। কিন্তু তিনি এই স্তুতিতে বেশি দিন অটল থাকতে পারেননি কেননা ততদিনে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন চিঠিপত্র বাংলা সাহিত্যের একটা বিশাল মাত্রার সংযোজন। চিঠি হল সময়ের দলিল, একজন মানুষের আত্মপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এবং সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির বিশ্বস্ত দর্পণ।
নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ চিঠি লিখেছেন তা অন্য কোনো সাহিত্যিক লেখেননি। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় ১. প্রয়োজন নির্ভর চিঠি এবং ২. আত্ম উদঘাটন মূলক চিঠি। তার রচিত চিঠি সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি। পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে লেখা চিঠি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে চার হাজার চিঠি ছাপা হয়েছে সাময়িক পত্র পত্রিকাগুলোতে।

৩২০ জনকে লেখা চিঠিগুলো সংকলিত হয়েছে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’-এর ১৮টি খ-ে।

এক জীবনে রবীন্দ্রনাথকে চেনা অসম্ভব। কবিরে পাবে না তাহার জীবন চরিতেগ্ধথথচতুর্জ্ঞানী এই বিশ্বকবির স্বয়ং স্বীকারোক্তি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলে। রবীন্দ্রজীবনের অবগুণ্ঠিত অন্তরালবর্তী দিকগুলির অনেকখানিই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পত্রাবলির মধ্যে। রবীন্দ্র-পত্রাবলিতেই লুকিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ পরিচয়। নিজের সম্বন্ধে ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,,

“সফল কাব্যই কবির প্রকৃত জীবনী। সেই জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তিটিকে কাব্যরচয়িতার জীবনের সাধারণ ঘটনাবলীর মধ্যে ধরিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা।”

রবীন্দ্র চিঠির প্রসঙ্গগুলোর বিষয়বস্তু ব্যক্তিজীবন হতে শুরু করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের ইতিবৃত্তের সমস্ত কিছুই প্রতিফলিত। পারিবারিক, সামাজিক এমনকি সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা, সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা, সমকালীন কবিসাহিত্যিকসহ ইংরেজ কবিদের কথাও লিখেছেন। নারী স্বাধীনতা, জমিদারিত্ব, নিজের আঁকা ছবি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রসঙ্গ। এমনকি কবি কালিদাস হতে মৈত্রী দেবী। অতপর নববর্ষ, ধর্মচিন্তা, আধ্যাত্মিক ভাবনা, ঈশ্বর ভাবনা প্রসঙ্গ টেনে পল্লী গাঁয়ের ডাকঘরে গিয়ে থেমেছেন। আর এই চিঠি কাঙ্খিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাক। রবীন্দ্র সাহিত্যে চিঠি, ডাকঘর এবং কর্মচারী নিয়ে লেখা উল্লেখযোগ্য এক অধ্যায়ের নাম। ডাকহরকরা, ডাকপিয়ন, ডাকঘর, ডাকবাবু, চিঠি, ডাকবাক্স ইত্যাদি ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের এক দীর্ঘ জীবনপর্বের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অনুভব, গভীর দর্শন, কবিজীবনের দীপ্তি, ব্যক্তিজীবনের ছায়া এবং পৃথিবী প্রেমের যে বিপুল ও বিচিত্র ধারায় অনর্গল প্রবাহিত হয়েছে, অন্য কোনো রচনায় বা চিঠিপত্রে তা দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের লেখা সর্বাধিক চিঠি নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। নির্মলকুমারীকে লেখা ৬৪ টি চিঠি নিয়েই সংকলিত হয়েছে পথে ও পথের প্রান্তেগ্ধ (১৯৩৮)।
এখানে প্রায় তিন হপ্তার পথ বাকী আছে। তারপরে শান্তিনিকেতন। আমার কেবলি মনে হচ্ছে সূর্যাস্তের দিক থেকে সূর্যোদয়ের দিকে যাত্রা করছি। যে পর্যন্ত না পৌঁছাই সে পর্যন্ত বেদনা। দিনের পর দিন ঘটনার পর ঘটনা যখন বাইরে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আসে তখন বুঝতে পারি আপনার সত্যকে পাইনি। তখনই এই বাইরের আঘাতগুলো ক্রোধ লোভ মোহের তুফান তোলে। অন্তরের মধ্যে এই সমস্ত বর্হিব্যাপারের একটা কেন্দ্র খুঁজে পেলে তখন নিখিলের মহান ঐক্য নিজের ভিতর একান্তভাবে বুঝতে পারিথথ তাকেই বলে মুক্তি প্রতিদিনের প্রতিজিনিসের প্রতি ঘটনার খাপছাড়া বিচ্ছিন্নতার থেকে মুক্তি। এই মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে আছিগ্ধ।

[পত্রধারা ২, ১৯২৬, পথে ও পথের প্রান্তে। ]

(১৮৯০-১৯০২) সালের মধ্যে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ ৩৬টি চিঠি লিখেছিলেন। বয়সে প্রায় ১৩ বছরের ছোটো স্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখবার সময় নানা আদরের নামে সম্বোধন করতেন, যেমন ‘ভাই ছোটো বৌ’, ‘ভাই ছোট গিন্নী’, ‘ভাই ছুটি’ ইত্যাদি। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সম্বোধনটি ছিল ‘ভাই ছুটি’। দেখা গেছে ৩৬টির মধ্যে ৩০টি চিঠিতেই তিনি এটি ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি চিঠির নীচে সাক্ষরে লিখতেন ‹রবি’, ‘তোমার রবি’ কিংবা শুধুই ‘তোমার’।

আশ্চর্যের কথা হল, পতিগুরু তাকে যতগুলো চিঠি লিখেছিল তার প্রত্যেটিই তিনি যতœ করে রেখে দিয়েছিল। স্ত্রী মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ এগুলো খুঁজে পান এবং প্রিয় পতœীর আত্মাকে উৎসর্গে লিখে ফেলেন অসামান্য এক কবিতা। যেখানে কবির দেয়া চিঠিরই অভিব্যক্তি,,,

দেখিলাম খানকায় পুরাতন চিঠি/স্নেহমুগ্ধ জীবনের দুচারিটি,/স্মৃতির খেলেনা কটি বহু যতেœভরে /গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলি ঘরে/ যে প্রবল কালস্রোতে প্রলয়ের ধারা /ভাসাইনা যায় কত রবিচন্দ্রতারা /তারি কাছ হতে তুমি বহু ভয়ে ভয়ে /এই কটি তুচ্ছ বস্তু চুরি করে লয়ে /লুকায়ে রাখিয়াছিলে বলেছিলে অধিকার নাই কারো আমার এ ধনেগ্ধ/আশ্রয় আজিকে তারা পাবে কার কাছে?/জগতের কারো নয় তবু তারা আছে/তাদের যেমন তব রেখেছিলে স্নেহ/তোমারপ তেমনি আজ রাখেনি কেহ!
[বোলপুর : ২ পৌষ, ১৩০৯]
রানুকে লেখা বেশ কিছু চিঠির মধ্যে ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে চিঠিতে যা লিখলেন,,,

খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল এবং সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেলে-- আমি প্রসন্ন চিত্তে আমার ঠাকুরের সেবায় লেগে গেলুম। কিন্তু তোমার প্রতি এই স্নেহে যদি আমাকে বল না দিয়ে দুর্বল করত, আমাকে মুক্ত না করে বদ্ধ করত তাহলে আমার প্রভুর কাছে আমি তার কী জবাব দিতুম?... তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরও বেশি বল দিয়েছেন। তুমিও তেমনি বল পাও আমি কেবল এই কামনা করছি। তোমার ভালবাসা তোমার চারদিকে সন্দর হয়ে বাধামুক্ত হয়ে ছড়িয়ে যাক--তোমার মন ফুলের মতো মাধুর্যে পবিত্রতায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে তোমার চতুর্দিকে আনন্দিত করে তুলুক।...আমি তোমাকে যখন পারব চিঠি লিখব--কিন্তু চিঠি যদি লিখতে দেরি হয়, লিখতে যদি নাও পারি তাতেই বা এমন কী দুঃখ। তোমাকে যখন স্নেহ করি তখন চিঠির চেয়েও আমার মন তোমার ঢের বেশি কাছে আছে।

চিঠি কখনো কখনো ইঙ্গিতধর্মী, মোটিফ কিংবা সখ অথবা চিঠি কখনো রহস্য ঘেরাও হয়ে থাকে। চিঠি নিছক যোগাযোগের মাধ্যম নয়। চিঠি সুখ দুঃখ অনুভব করায় আর কবিগুরুর কাছে চিঠি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ এখানে মেলে,,,

পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নূতন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। চিঠিপত্রে যে আমরা কেবল প্রত্যক্ষ আলাপের অভাব দূর করি তা নয়, ওর মধ্যে আরো একটু রস আছে যা প্রত্যক্ষ দেখা-শোনায় নেই। মানুষ মুখের কথায় আপনাকে যতখানি ও যে রকম করে প্রকাশ করে লেখার কথায় ঠিক ততখানি করে না। আবার লেখায় যতখানি করে মুখের কথায় ততখানি করতে পারে না। এই কারণে, চিঠিতে মানুষকে দেখবার এবং পাবার জন্য আরো একটা যেন নতুন ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল অবিচ্ছেদে চব্বিশ ঘণ্টা কাছাকাছি আছে, যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি, তারা পরস্পরকে অসম্পূর্ণ করেই জানে। যেমন বাছুর কাছে গেলে গরুর বাঁটে আপনি দুধ জুগিয়ে আসে তেমনি মনের বিশেষ বিশেষ রস কেবল বিশেষ বিশেষ উত্তেজনায় আপনি সঞ্চারিত হয়, অন্য উপায়ে হবার জো নেই। এই চার পৃষ্ঠা চিঠি মনের যে রস দোহন করতে পারে, কথা কিম্বা প্রবন্ধ কখনোই তা পারে না। আমার বোধ হয় ঐ লেফাফার মধ্যে একটি সুন্দর মোহ আছে- লেফাফাটি চিঠি প্রধান অঙ্গ, ওটা একটা মস্ত আবিষ্কার।

কিন্তু মনের বিশেষ রস নিঃসরণের জন্যে বিশেষ পাত্র-পাত্রী চাই, যাকে উপলক্ষ করে রসটি স্বতঃনিসৃত হয়। [ছিন্নপত্র: ১৪১]

রবি ঠাকুরের কাছে চিঠি লেখা ছিল শিল্প। আর তিনি পত্রসাহিত্য ডিঙিয়ে ছোটগল্পেও এর প্রতিচ্ছায়া বিম্বিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিকেন্দ্রিক কবিকল্পনা ছোটগল্পের জগৎ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তার সাক্ষ্যও ছড়িয়ে আছে ‘ছিন্নপত্র’র চিঠিগুলির মধ্যে। তারই নির্যাসে দেখা যায় তিনি ছুটি, মাপ্তি, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কঙ্কাল, পোস্টমাস্টার› ইত্যাদি গল্পে চিঠিপত্রের বীজমন্ত্র নিহিত। প্রকৃতি ও মানুষের অপার রহস্য চোখ ভরে দেখতে দেখতেই রবীন্দ্রনাথতি ছিন্নপত্রের নির্যাসে চিত্রা ও সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থে প্রতিফলন ঘটান।

বর্তমান স্মার্টফোনের যুগে যেখানে চোখের পলকেই মেইল পৌঁছে যায় গ্রাহকের কাছে সেখানে সেকেলের সেই দোয়াত-কালির লেখা চিঠি যেন এক বিস্ময়কর নাম। রবীন্দ্রনাথ যে দোয়াত কালির উপর কতটা আন্তরিকতা ছিল তার প্রমাণে ছেলে রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতেও এই ভালোবাসার পরিচয় ফুটে উঠে।

১৯৩০-এর অক্টোবরে এমনই এক চিঠিতে প্রচুর রঙিন কালি আর কাগজ আনতে বলেছিলেন। জার্মানির কাগজ আর ফ্রান্সের কালির প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁর।

তিনি খাতা গল্পে তুলে ধরলেন কালি,কলম ও কাগজের প্রতি নিবিড় আকর্ষণ,,,

লিখিতে শিখিয়া অবধি উমা বিষম উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছে। বাড়ির প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে কয়লা দিয়া বাঁকা লাইন কাটিয়া বড়ো বড়ো কাঁচা অক্ষরে কেবলই লিখিতেছে জল পড়ে, পাতা নড়ে।

আপদ গল্পে লিখলেন,,, কলিকাতা হইতে সতীশ একটি শৌখিন দোয়াতদান কিনিয়া আনিয়াছিল, তাহাতে দুই পাশে দুই ঝিনুকের নৌকার উপর দোয়াত বসানো এবং মাঝে একটা জর্মন রৌপ্যের হাঁস উন্মুক্ত চঞ্চুপটে কলম লইয়া পাখা মেলিয়া বসিয়া আছে; সেটির প্রতি সতীশের অত্যন্ত যতœ ছিল, প্রায় সে মাঝে মাঝে সিল্কের রুমাল দিয়া অতি সযতেœ সেটি ঝাড়পোঁচ করিত।

রবীন্দ্র পত্রাবলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিন্নপত্রগ্ধ (১৩১৯)। (১৮৮৭-১৮৯৫) পর্যন্ত ভাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত পত্র লিখেছেন আর যেসব চিঠি ইন্দিরা যতœসহকারে সংগ্রহে রেখেছিলেন তা থেকে ১৫৩ টি এবং শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা ৮টি চিঠিসহ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধায়িত হয়েছে। ভাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠির প্রত্যেকটি শব্দ এবং বাক্য রচনার দক্ষতা অনন্য।

রবীন্দ্রনাথ তার শৈশবের স্মৃতি কবিত্বরসে আলম্বন বিভাব হয়ে বিশেষ মেজাজে চিঠি লিখেছেন ইন্দিরা দেবীকে। প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে, স্পর্শ করে গন্ধ রূপে আর বুদ্ধির উন্মেষ ঘটে। নিজেকে পত্রে ছড়িয়ে দেন। আর স্নেহাশিষ ইন্দিরা দেবী প্রকাশের মাধ্যম। কবি তার ভাবনার পানসিকে,,,,

এই অনও ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ-যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।” [ছিন্নপত্র – ১০]

কাদম্বিনী দত্ত তার ঈশ্বর জিজ্ঞাসা এবং অসামান্য ধীশক্তির বলেই রবীন্দ্রনাথকে তিনি এতটা আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বিনী দত্তের পত্রব্যবহারের মূল বিষয় ছিল- এ পৃথিবীর মানুষের সুখদুঃখের স্বরূপ। অত্যন্ত প্রাঞ্জলতায়, স্পষ্ট ভাষায় কবির চিঠিগুলো নিবেদিত ছিল,,

ঈশ্বর তাঁর পরম দানগুলিকে দুঃখের ভিতর দিয়াই সম্পূর্ণ করেন- তিনি বেদনার মধ্য দিয়া জননীকে সন্তান দেন- সেই বেদনার মূল্যেই সন্তান জননীর এত অত্যন্তই আপন। সেই কথা মনে রাখিয়া, যখন ঈশ্বরের কাছে সত্য চাই, আলোক চাই, অমৃত চাই তখন অনেক বেদনা অনেক ত্যাগের জন্য নিজেকে সবলে প্রস্তুত করিতে হইবে। মা, ঈশ্বর যদি তোমাকে বেদনা দেন তবে নিজরে দোষে সেই বেদনাকে ব্যর্থ করিয়ো না- তাহাকে সফল করিবার জন্য সমস্ত হৃদয় মনকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করিয়া জাগ্রত হওগ্ধ [পত্র - ৪]।

বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণকারিণী হেমন্তবালার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের মুখ্য বিষয় মানুষের ধর্মমত, এবং ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে কবির আত্মপরিচয়। কবিগুরু ভাবুক হয়েও বৈষ্ণবধর্মকে কেন সমর্থন করেন নি, এবং কেনই বা সাকার-উপাসনার বিরুদ্ধে ?
জবাবে,,,
আমি র্নিগুণ নিরঞ্জন নির্ব্বিশেষের সাধক এমন একটা আভাস তোমার চিঠিতে পাওয়া গেল। কোনো একদিক থেকে সেটা হয়তো সত্য হতেও পারে- যেখানে সমস্তই শূন্য সেখানেও সমস্তই পূর্ণ-যিনি তিনি আছেন এটাও উপলব্ধি না করব কেন? আবার এর উল্টো কথাটাও আমারি মনের কথা। যেখানে সব-কিছু আছে সেখানেই সবার অতীত সব হয়ে বিরাজ করেন এটাও যদি না জানি তাহলে সেও বিষম ফাঁকি। আজ এই প্রৌঢ় বসন্তের হাওয়ায় বেলফুলের গন্ধ সিঞ্চিত প্রভাতের আকাশে একটা রামকেলী রাগিণীর গান থাকে ব্যাপ্ত হয়ে- স্তব্ধ হয়ে একা একা বেড়াই যখন, তখন সেই অনাহত বীণার আলাপে মন ওঠে ভরে। [পত্র - ২]

ভানুসিংহের পত্রাবলী, ছিন্নপত্র, পথে ও পথের প্রান্তে এই তিনটি গ্রন্থ ১৩৪৫ সালে পত্রধারা শিরোনামে গ্রন্থভুক্ত হয়। তার ভূমিকাতে ছিন্নপত্র প্রসঙ্গে কবি যা লিখেছেন তা তাঁর সমগ্র পত্রসাহিত্য সম্পর্কেই প্রযোজ্য তাই সমগ্র রবীন্দ্র-পত্রসাহিত্যের মধ্যে ‘ছিন্নপত্র’ অবিতর্কিতভাবেই এগিয়ে,,,,

পত্রধারায় ছিন্নপত্র পর্যায়ে যে-চিঠির টুকরোগুলি ছড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশই আমার ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা চিঠির থেকে নেওয়া। তখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম বাংলার পল্লীতে পল্লীতে, আমার পথ-চলা মনে সেই-সকল গ্রামদৃশ্যের নানা নতুন পরিচয় ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগাচ্ছিল; তখনি তখনি তাই প্রতিফলিত হচ্ছিল চিঠিতে। কথা কওয়ার অভ্যাস যাদের মজ্জাগত, কোথাও কৌতুক-কৌতূহলের একটু ধাক্কা পেলেই তাদের মুখ খুলে যায়। যে বকুনি জেগে উঠতে চায় তাকে টেকসই পণ্যের প্যাকেটে সাহিত্যের বড়ো হাটে চালান করবার উদ্যোগ করলে তার স্বাদের বদল হয়। চার দিকের বিশ্বের সঙ্গে নানা-কিছু নিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় আমাদের মোকাবিলা চলছেই, লাউড-স্পীকারে চড়িয়ে তাকে ব্রডকাস্ট করা সয় না।

বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ তখন গ্রন্থভুক্ত করেননি; অনেক পত্রের কোনো কোনো অংশ সাধারণের সমাদরযোগ্য নয় মনে করেও বর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ চিঠি পুত্রবধু প্রতিমা দেবীকে নিয়ে লেখা। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলা পত্রসাহিত্য তার নিজস্বতার স্বর্ণচূড়ায় আসীন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ভারতে থেকে সাংবাদিকতা করা কঠিন কাজ, দাবি অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকের

ভারতে থেকে সাংবাদিকতা করা কঠিন কাজ, দাবি অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকের

যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় নয়: চীন

যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় নয়: চীন

সূর্যঘড়ি নির্মাণকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আশ শাতির

সূর্যঘড়ি নির্মাণকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আশ শাতির

সাংবাদিকদের ওপর হামলা: মিশা-ডিপজলের দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কমিটি গঠন

সাংবাদিকদের ওপর হামলা: মিশা-ডিপজলের দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কমিটি গঠন

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর শিল্পীদের হামলা, আহত ১০

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর শিল্পীদের হামলা, আহত ১০

মিশার নেতৃত্বে শিল্পী সমিতির নবনির্বাচিত কমিটির শপথ গ্রহণ

মিশার নেতৃত্বে শিল্পী সমিতির নবনির্বাচিত কমিটির শপথ গ্রহণ

উড়ন্ত চেলসিকে মাটিতে নামাল আর্সেনাল

উড়ন্ত চেলসিকে মাটিতে নামাল আর্সেনাল

১৭ রানও আটকাতে পারলেন না মুস্তাফিজ,ফের হারল চেন্নাই

১৭ রানও আটকাতে পারলেন না মুস্তাফিজ,ফের হারল চেন্নাই

সিলেটের মাটিতে ভারতীয় নারী ক্রিকেট টিম !

সিলেটের মাটিতে ভারতীয় নারী ক্রিকেট টিম !

বিশ্বনাথ পৌরমেয়র মুহিবকে গ্রেফতার ও অপসারণের দাবিতে ঝাড়– মিছিল

বিশ্বনাথ পৌরমেয়র মুহিবকে গ্রেফতার ও অপসারণের দাবিতে ঝাড়– মিছিল

থাইল্যান্ডে ইউএন এসকাপ-এর ৮০তম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রতিমন্ত্রী পলক

থাইল্যান্ডে ইউএন এসকাপ-এর ৮০তম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রতিমন্ত্রী পলক

মনিরামপুরে ভূমি কর্মকর্তাকে মারধর, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার - ২

মনিরামপুরে ভূমি কর্মকর্তাকে মারধর, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার - ২

পার্কটি সংস্কার ও উন্নত করা হোক

পার্কটি সংস্কার ও উন্নত করা হোক

যুব মহিলা লীগ নেত্রীর বাসা থেকে অপহৃত কিশোরী উদ্ধার

যুব মহিলা লীগ নেত্রীর বাসা থেকে অপহৃত কিশোরী উদ্ধার

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাঠের বিরোধীদলের করণীয়

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাঠের বিরোধীদলের করণীয়

ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়ছে?

ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়ছে?

ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা লজ্জার

ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা লজ্জার

ফজরের নামাজ কাযা হলে জুমার খুতবার পূর্বে আদায় না করতে পারলে করণীয় প্রসঙ্গে।

ফজরের নামাজ কাযা হলে জুমার খুতবার পূর্বে আদায় না করতে পারলে করণীয় প্রসঙ্গে।

ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে উত্তাল মার্কিন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে উত্তাল মার্কিন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

ফরিদপুরে গ্যারেজ মিস্ত্রি হত্যায় ২ জনের যাবজ্জীবন

ফরিদপুরে গ্যারেজ মিস্ত্রি হত্যায় ২ জনের যাবজ্জীবন