জন্ম শতবার্ষিকী

ফররুখের জীবন ও সাহিত্য

Daily Inqilab ড. মুসাফির নজরুল

০৮ জুন ২০২৩, ০৯:৫৫ পিএম | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯১৮ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। পিতা পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী। ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে মেট্রিক এবং কলিকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ পাশ করেন। এরপরে প্রথমে স্কটিশ কলেজে দর্শনে অনার্স এবং পরে সেন্টপল কলেজে ইংরেজিতে অনার্সে অধ্যয়ন করেন। কলেজ জীবন থেকে বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এ সময় তিনি র‌্যাডিকেল হিউম্যানিজম আন্দোলনের নেতা এম.এন রায়ের অনুসারী ছিলেন। ১৯৪৩ সালে আই.জি (প্রিজন) অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাই অফিসে, ১৯৪৫-১৯৪৭ সালে পর্যন্ত জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে ও মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে এবং ১৯৪৭-১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারে স্টাফ রাইটার পদে কর্মরত ছিলেন। 
কবি ফররুখ আহমদ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সমর্থন দান করেন। দেশবিভাগের পরপরই তিনি মাসিক সংগাত পত্রিকার  (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৭) সংখ্যায় ‘পাকিস্তান ঃ রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নিবন্ধে তিনি লেখেন “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিৎ সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষ কে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”        তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনীরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৯) ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০) ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০) ‘হে বন্য স্বপ্নরা’ প্রভৃতি।  
         ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) মুসলিম রেনেসাঁসের কবি। চল্লিশের দশকের শক্তিশালী কবি প্রতিভা ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা কাব্য ধারার পথ বিনির্মাণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি মুসলিম ঐতিহ্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে আরব্য উপন্যাস, ইরান ও আরবীয় সংস্কৃতিতে উল্লেখিত কাহিনীর ঐতিহ্য একদিকে যেমন ধারণ করেছেন অন্যদিকে মুসলিম অভ্যুত্থান যুগের ঐতিহ্য ও ভাবধারাও তাঁর কাব্যে ধারণ করেছেন। তিনি জীবনের শূণ্যতাবোধকে যেমন কবিতার প্রধান উপজীব্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন, তেমনি মানুষের কুটিলতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থান্ধতাকে কাব্যে স্থান দিয়েছেন। ‘মানুষের সততায় হারায়েছি আমি যে বিশ্বাস’-এ উক্তি শুধু ‘হাতেমতায়ী’র নায়িকা হুসনা বানুরই নয়, আধুনিক বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর যে কোন মানুষের। তাই তাঁর কবিতা এক বিশেষ ধর্মীয় কাল পরিক্রমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর কবিতা লাভ করেছে বিশ্বজনীনতা। 
ফররুখ আহমদ মুসলিম আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর কাব্যে ঐতিহ্য ও আদর্শের পারস্পর্য কি তা সহজেই বোধগম্য এবং কোন প্রেক্ষিতে এই সমন্বিত উদ্বোধন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তাতে ঐতিহ্যের স্বপ্ন যতখানি লাবণ্যে উদ্ভাসিত, জীবনের দ্বান্দ্বিক অবশ্যম্ভাবিতা উজ্জ্বল। জীবনধারণের সাথে আদর্শের যোগ স্থাপিত করা হয়েছে প্রতীক ও রূপক দ্যোতনার মাধ্যমে। তাই ফররুখ আহমদের প্রতীক ব্যবহার জীবন রসে নয় প্রতীকী রসে সিঞ্চিত। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিলে কথাটি পরিস্কার হবে ঃ                            “নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দাবাদ পাকে পাকে ঘুরে-তীর বেগে ছুটে আবর্তে দিশেহারা, ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশ জাগায়ে সাড়া, জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুড়ায়ে পাপের মাথা, দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন রয়েছে পাতা।”  (সিন্দাবাদ)অথবা “জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি জাগো, অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি কত দেরি।” পাঞ্জেরী)
উদ্ধৃতগুলো এতই প্রাঞ্জল যে, কি আদর্শে উজ্জীবিত এবং ব্যবহৃত প্রতীকের আড়ালে মূল বক্তক্যটাই বা কি তা সহজেই অনুমেয়। মূলত প্রতীকের আড়ালে যে ঐতিহ্য ও আদর্শ অবিমিশ্র হয়েছে তা একটি বিশেষ কালের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি তা হয়ে উঠেছে গতিময়। 
         ইসলামি ভাবধারা ও উপজীব্য বিষয় নিয়ে কবিতা লেখায় যে দৃষ্টান্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপস্থাপন করেন কবি ফররুখ আহমদ সে ধারারই যোগ্য উত্তরসাধক। কবিতার আঙ্গিক  রচনাশৈলী এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে উভয়ের মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য থাকলেও কতকগুলো ক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদ সার্থক স্রষ্টা। বিদেশী শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহারে তিনি অধিকাংশ  ক্ষেত্রে সাবলীল ও সার্থক। 
আরবের মরু প্রান্তরে খেজুর গাছের আড়ালে মায়াবী চাঁদের হাতছানি, ইরান ও আরবের সংস্কৃতি ও পুরাকথা কুরআনের সত্য কাহিনী এবং আরব্য উপন্যাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীকে তিনি শৈল্পিক কুশলতায় কাব্যিক দক্ষতায় যথার্থ রূপদান করেছেন। আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার  সর্বপরি উপমা উৎপ্রেক্ষার সার্থক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কবির প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা এবং আবেগ উল্লেখিত পরিম-লের আবির্ভূত নয় বরং এ সবের মধ্যে একাকার হয়ে মিশে আছে। তাঁর কাব্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে আবু জাফর সামসুদ্দীন পূর্বদেশ পত্রিকায় ১৩৮১ সালের ৪ঠা কার্তিক প্রকাশিত অপরাজেয় কবি ফররুখ আহমদকে ‘জীবন শিল্পী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে ‘অন্ধকার অমানিশার মধ্যেও আলোর গান শোনার নামই যদি জীবন বন্দনা হয়, তাহলে ফররুখ আহমদ অবশ্যই ছিলেন জীবন শিল্পী। 
ফররুখ আহমদ ছিলেন মানব দরদী কবি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিলো সকল মানুষই সমান। তিনি নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের দুঃখ সমব্যথী। এবং এদের গভীর মমতায় অনুভব করতেন। তাঁর এই জীবনাদর্শের প্র্রকাশের ভঙ্গিও ছিলো ভিন্নতর। তিনি নির্যাতিত মানুষের দুঃখ বেদনায় মুসলিম ঐতিহ্যকে স্মরণ করেছেন এবং সেই আদর্শকে বুকে বাধার পরামর্শ দিয়েছেন : 
“নিশান আমার কি স্বপন তুমি দেখছো আজ। নিশান আমার শীর্ণ মুঠিতে  পেতে চাও তুমি মহা নিখিল? ক্ষুধিত মাটিতে সে নয় তাজমহল মানুষের মাঠে বিরাণ মাটিতে  এবার ফলবে তাজা ফসল।”  (নিশান)
ফররুখ আহমদের কাব্য সাধনার প্রথম পর্বে ছিলো রোমান্টিকতা, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধের প্রাধান্য, যদিও কবিতায় স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব একবারেই অপ্রতক্ষ ছিলো না। কবিতার ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প ও রূপরীতিতে অনেকটা এই কবির রচনাতে ছিলো আবেগ অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এবং স্বতন্ত্র কণ্ঠের উচ্চারণ। স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধের পাশাপাশি মানবিকতাবোধের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায়। কিন্তু সীমিত সাফল্যে সন্তুষ্ট না থেকে সৃজনী প্রতিভাধর ফররুখ আহমদ কাব্যের নতুন রূপ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হন। এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ও মহাকবি ইকবালের কবিতাই তাঁর প্রেরণার মূল উৎস হয়। ইসলামী আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী এবং মুসলিম রেনেসাঁয় প্রত্যয়ী হওয়ার পর ফররুখ কাব্যের উপজীব্য আহরণ ও রূপরীতি নির্মাণের ক্ষেত্রে ভিন্নরীতির অন্নেষী হন। পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিতে রেনেসাঁ আন্দোলনের সময়েই তিনি সচেতন প্রয়াসে কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ব্যবহার, বিশেষ করে চলতি ভাষার পুঁথি কাব্যের নবরূপায়ণের দিকে দৃষ্টি দেন। আরব্য উপন্যাসের কাহিনীকে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমে ফররুখ আহমদ নতুন ব্যঞ্জনায় ও গভীর তাৎপর্য মহিমায় মূর্ত করে তোলেন। 
ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’র বিভিন্ন কবিতায় মুসলিম জাগরণ, বিজয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতীক দুঃসাহসিক নাবিক সিন্দাবাদের বিভিন্ন সফর অভিযানের আলেখ্য চিত্র রূপময় ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ কাব্যের ‘সিন্দাবাদ’ ‘দরিয়ায়’ ‘দরিয়ার শেষ রাত্রি’, ‘শাহরিয়া’, ‘আকাশ নাবিক’ ‘বন্দরে সন্ধ্যা’, ‘ডাহুক’, ‘এই রাত্রি’, ‘পাঞ্জেরী’, ‘স্বর্ণমঙ্গল’ ‘লাশ’, ‘তুফান’, ‘হে নিশান বাহী’, ‘নিশান’, ‘আউলাদ’ ও ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রভৃতি কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্যকে লালন করা হয়েছে। ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যেমন আছে স্বপ্ন, সৌন্দর্যবোধ ও উজ্জীবনের প্রেরণা, তেমনি আছে আত্মধিক্কার এবং নির্যাতিত ও দুঃখ পীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষের চিত্র। এ কাব্যের ‘ডাহুক’ কাবিতায় অনুপম প্রাকৃতিক ও রোমান্টিক আর্তির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্ত সত্ত্বার প্রতীক ডাহুক-এর অশ্রান্ত ডাকের আলেখ্য। এ গ্রন্থের ‘আউলাদ’ ‘লাশ’ ইত্যাদি কবিতায় মানবতার বিপর্যয়ের জন্য হাহাকার ও ব্যথাতুর মানুষের জন্য বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। বলিষ্ঠ ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে মানবতা বিরোধী শোষক ও সভ্যতার প্রতি অভিষাপ। ইসলামের মানবতাবাদী আদর্শের প্রত্যয়ী কবি মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায় ইঙ্গিত করেছেন, ‘হেরারার রাজতোরণে’র দিকে ‘সাত সাগরের মাঝি’কে আহবান জানিয়েছেন সেই রশ্মি ধরে সফরের পর সফরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এই কাব্য গ্রন্থে সব আশা-আকাঙ্খা স্বপ্ন এবং উজ্জীবনের প্রেরণাই ভাষারূপ পেয়েছে রূপ ও সৌন্দর্যের পথ ধরে। ফররুখ আহমদের এ সব কবিতায় সেই রূপ ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন কবির গভীর এবং আন্তরিক অনুভূতি সংস্কৃতানুগ শব্দের পাশাপাশি আরবী-ফরসী শব্দের শিল্পসম্মত অনুপম ব্যবহার এবং উপমা উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প সৃষ্টির সৃজনী কৌশল। 
কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন ‘সুস্থ-সবল জীবন ধর্মের কবি’। যদিও তাঁর কবি জীবনে তিনি অখ- শান্ত পরিবেশ পাননি। দুর্ভিক্ষ জরা-মৃত্যু-মহামারিসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিলো অশান্ত ও ঘোলাটে, জাতি-ধর্মের দুঃখজনক অবমাননার জ্বালা ইত্যাদি প্রতিকূল অবস্থাকে দৃষ্টির সামনে রেখে তিনি কাব্য সৃষ্টিতে নিয়োজিত ছিলেন। তবুও কোন নৈরাশ্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। জীবনের কান্না-গ্লানি যাত্রাপথের ভয়ঙ্কর ঝড়-ঝঞ্জা, বিপদ আপদকে তুচ্ছ করে সুনির্দিষ্ট মঞ্জিলে পৌঁছাতে কবি বদ্ধ পরিকর। চরম দুর্যোগের দিনেও সাহসে বুক বেধে জীবনের সার্বিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর রূপকের মোড়কে মোড়কে তিনি মূলত মুসলিম জাগরণের গান গেয়েছেন। মুসলিম পূর্ণজাগরণের কবি দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও আশা পোষণ করতেন। ‘মোরা মুসলিম দরিয়ার মাঝি, মওতের নাহি ভয়। এ কথার মত এ পর্যায়ের কবিতায় আস্থার কথা আশার বাণী অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও জোড়ালো ঃ  ‘‘পাল তুলে দাও ঝা-া উড়াও ; সিন্দাবাদ,  এল দুস্তর তরঙ্গ বাধা তিমিরময়ী। দ্বিধা সংশয় কত জমা হয় কে মানে আজ ?  কে ছোটে হারানো গীতিকার পিছে মিথ্যাময়ী ?  এ ঝড় তুফানে জাগো দুর্বার দুঃসাহসী নতুন সফরে হবে এ কিশতী দিগি¦জয়ী।”  (নতুন সফল)
সমাজ সচেতনতা ফররুখ আহমদের কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ধনতন্ত্রের কবর খোঁড়ার ইচ্ছে’ তার ছিলো। ধনতন্ত্রের নির্মম শোষণ মানুষকে মনুষ্যহীনতার অতল গহবরে তলিয়ে দিয়েছে। এ ক্ষোভ ফররুখ আহমদের অনেক কবিতায় ধ্বনিত। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, শোষণ, রুগ্নতা, মানুষের হিংস্রতা, শ্রমের অমর্যাদা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় সার্থক হয়ে উঠেছে। তিনি প্রতীকের মাধ্যমে হাতেমতায়ীর সাহায্যে ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর শোষকদের মুখোশ উম্মোচন করেছেন। বিশিষ্ট ফররুখ গবেষক মোহাম্মাদ মাহফুজ উল্লাহ তাঁর বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য গ্রন্থে বলেছেন। “বস্তুতঃপক্ষে রেনেসাঁ আন্দোলনের সময়ে তরুণ মুসলিম কবিদের প্রায় সবাই ইসলামী আদর্শ, মুসলিম ঐতিহ্য ও জাতীয় চেতনামূলক কবিতা রচনায় ফররুখ আহমদের কাব্যরীতিরই অনুসরণ করেছেন।” (বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য, মোহাম্মাদ মাহফুজ উল্লাহ, পৃষ্ঠা-২১১)
‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যে কবি ফররুখ আহমদ আদর্শ জীবন ভাবনার শিকার। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যে কবি যেখানে ইসলামী ঐতিহ্য এবং কুরআন হাদিসের সত্য কাহিনী প্রচারে উন্মুখ ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যে কবি সেখানে মুলত হজরত মুহাম্মদ (সঃ) থেকে শুরু করে তাঁর সাহাবী ও খলিফাদের উজ্জ্বল জীবনের কথা এবং তৎপরবর্তী মুসলমান মনীষীদের জীবনকথা অনুপ্রেণার উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কবি এখানে অনেকখানি বাস্তবমুখি ও সমাজ সচেতন। এ কাব্যের কবিমানস  কাব্যরীতি ও ইতিহাস চেতনার দিক থেকে তিনি স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। 
‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্য কবির আদর্শ ও বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। কবি এখানে শুধুমাত্র মহাপুরুষদের জীবনকথা বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি, জীবনের সত্য, সুন্দর ও সংগ্রামের দিকগুলো তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। এ কাব্যের অধঃপতিত মুসলমানদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের আদর্শ বাস্তবায়নের উপকারিতা এবং সর্বোপরি সে আদর্শের রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রয়েজনীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাধনা-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বিধৃত হয়েছে।  তিনি এ কাব্যের মাধ্যমে মানব জীবনের যে চরম দুর্দিনে এ দুনিয়ায় মহানবীর আবির্ভাব হয়েছিলো তার এক সুস্পষ্ট ছবি এঁকে তারই পাশে দাঁড় করিয়েছেন নবীজীর কল্যাণধর্মী জীবনের নানাবিধ দিক। পেয়ারা নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই ধরাবক্ষে আবির্ভাব আল্লাহতায়ালার অপরিসীম দয়া ও রহমতের ফল ঃ “হে অচেনা পাখি কোন আকাশের গভীরতা থেকে এসেছ উঠি   তোমার পক্ষ সঞ্চারে ভাষা ভাবের কুসুম উঠিছে ফুটি।’’  ‘সিরাজাম মুনীরা গ্রন্থের ‘গাওসুল আজম’, ‘সুলতানুল হিন্দ’, ‘খাজা নকশবন্দ’, ‘মুজাদ্দিদ ই আলফেসানী’ প্রভৃতি আলাদা আলাদা কবিতায় তার ‘এলমে তাসাউফে’র প্রতি গভীর আগ্রহের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ সুফিদের ‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’-বাণীর মতো কবিও এ কাব্যে  আত্মাকে জানার-চেনার সাধনায় যেন মগ্ন। আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে কবি বিশাল জনতার দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করেছেন। ক্ষুধাতুর মানব সন্তানের রুগ্ন নিঃসাঢ় ছবি কবিকে ব্যথাতুর করে তুলেছে। এ কাব্য কবির আদর্শ ও বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। 
কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’, ১৯৬৬ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ ও ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ এবং ১৯৭৭ সালে মরোণোত্তর ‘একুশে পদক’ ও ১৯৮০ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। 
১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় কবি ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন। 
         ফররুখ আহমদ যুগ সচেতন আধুনিক কবি। কাব্যের কাহিনী ও ভাষার নিজস্ব ধারণা বিনির্মাণে তিনি মধ্যযুগের শক্তিশালী পুঁথি সাহিত্যের আদর্শকে গ্রহণ করলেও সেখানের নতুন প্রাণ ও নতুন আদর্শ রূপ দিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি যুগধর্ম ও যুগচেতনাকে সমানভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বাংলা কাব্যের ক্লাসিক রীতির ভাষার সাথে আরবী-ফারসী শব্দের শিল্পসম্মত সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক ঘনিষ্ঠ সুন্দর ঐশ্বর্যময় কবিভাষা সৃষ্টি করেছেন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সব জিনিসের দাম বাড়লেও কমেছে শ্রমিকের দাম : সাইফুল হক

সব জিনিসের দাম বাড়লেও কমেছে শ্রমিকের দাম : সাইফুল হক

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ

নাটোরে আইনজীবীসহ জামায়াতের ২০ নেতাকর্মী আটক

নাটোরে আইনজীবীসহ জামায়াতের ২০ নেতাকর্মী আটক

এবছর ৫ থেকে ৭টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা ইরানের

এবছর ৫ থেকে ৭টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা ইরানের

ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না: প্রধানমন্ত্রী

ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না: প্রধানমন্ত্রী

ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

শ্রমিক স্বার্থ নিশ্চিতে ইসলামী শ্রমনীতি প্রণয়নের বিকল্প নেই

শ্রমিক স্বার্থ নিশ্চিতে ইসলামী শ্রমনীতি প্রণয়নের বিকল্প নেই

তীব্র তাপদাহে মরে ভেসে উঠল ২০০ মেট্রিক মাছ

তীব্র তাপদাহে মরে ভেসে উঠল ২০০ মেট্রিক মাছ

কুমিল্লায় শিশু ঝুমুরের ধর্ষক ও হত্যাকারী গ্রেফতার, প্রেসব্রিফিংয়ে আবেগতাড়িত র‌্যাব অধিনায়ক

কুমিল্লায় শিশু ঝুমুরের ধর্ষক ও হত্যাকারী গ্রেফতার, প্রেসব্রিফিংয়ে আবেগতাড়িত র‌্যাব অধিনায়ক

বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ : খাদ্যমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ : খাদ্যমন্ত্রী

বাংলাদেশ বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে : প্রধান বিচারপতি

বাংলাদেশ বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে : প্রধান বিচারপতি

ফেনীতে চলন্ত সিএনজি উল্টে চালক নিহত

ফেনীতে চলন্ত সিএনজি উল্টে চালক নিহত

ভুল চিকিৎসার নাম করে চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ মেনে নেয়া যায় না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ভুল চিকিৎসার নাম করে চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ মেনে নেয়া যায় না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

পূর্ণিমা গণধর্ষণ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ২৩ বছর পর গ্রেপ্তার

পূর্ণিমা গণধর্ষণ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ২৩ বছর পর গ্রেপ্তার

মে দিবসে শ্রমমূল্য বৈষম্য দূর করার দাবি নতুনধারা বাংলাদেশের

মে দিবসে শ্রমমূল্য বৈষম্য দূর করার দাবি নতুনধারা বাংলাদেশের

দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে ৪২.৮ ডিগ্রি

দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে ৪২.৮ ডিগ্রি

জিম্বাবুয়ে সিরিজের ম্যাচ অফিসিয়ালদের তালিকা প্রকাশ

জিম্বাবুয়ে সিরিজের ম্যাচ অফিসিয়ালদের তালিকা প্রকাশ

মে দিবস উপলক্ষে বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

মে দিবস উপলক্ষে বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

মধুখালি চোপেরঘাট নিহত দুই সহোদরের বাড়ীতে কেন্দ্রীয় বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল,

মধুখালি চোপেরঘাট নিহত দুই সহোদরের বাড়ীতে কেন্দ্রীয় বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল,

কুড়িগ্রামে সড়কে প্রাণ গেল মাদরাসা ছাত্রের

কুড়িগ্রামে সড়কে প্রাণ গেল মাদরাসা ছাত্রের