মহাকবি কায়কোবাদ জীবন ও সাহিত্য
২০ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪০ পিএম | আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৩, ১১:৫০ পিএম
যতদূর মনে পড়ে সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন মহাকবি কায়কোবাদের আযান কবিতাটি তোতাপাখির মতন মুখস্ত করেছিলাম। তখন কবিতাটির সারগর্ভ পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কবিতাটির সুর ও ছন্দ কোমল হৃদয়ে দোলা দিয়েছিল--- একথা হলফনামা করেই বলে দিতে পারব। আজও কবিতাটির কিছু
অংশ হৃদয়ের সমস্ততন্ত্রীতে আলোড়ন তুলে। এই যেমন-
কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!.......কী অপূর্ব সুরের মূর্ছনা! চিরায়ত ভালো লাগা এবং ভালোবাসার আবেশ যেন স্বর্গ থেকে এসে হৃদয় আন্দোলিত করে যায়।
সেই বিখ্যাত “আযান” কবিতার সার্থক কবি মহাকবি কায়কোবাদ। কেউ কেউ বলে থাকেন মুন্সী কায়কোবাদ। অবশ্য কবির প্রকৃত নাম মুহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী।তিনি ১৮৫৭ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীনে আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ছিলেন ঢাকা জেলা জজ কোর্টের একজন আইনজীবী। তার নাম শাহামাতুল্লাহ আল কোরেশী। কায়কোবাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পিতার অকালমৃত্যুর পর তিনি ঢাকা মাদ্রাসাতে (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) ভর্তি হন যেখানে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। কিন্তু তিনি পরীক্ষা না দিয়ে পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়ে স্থানীয় গ্রামে ফিরে আসেন। যেখানে তিনি অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতাতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলন-এর প্রধান অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই মহাকবি কায়কোবাদ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
তাঁর সমকালীন লেখক “মীর মশাররফ হোসেন এবং মোজাম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছেন সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তাঁর মধ্যেই লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য একথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায় যে কবি কায়কোবাদই হচ্ছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি”।
তাছাড়া তিনি বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতাও বটে।
মহাকবি কায়কোবাদ অনেক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম –
বিরহ বিলাপ (১৮৭০)। এরপর তিনি একে একে আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। যেমন: কুসুম কানন (১৮৭৩), অশ্রুমালা (১৮৯৬); মহাশ্মশান (১৯০৪), শিব-মন্দির বা জীবন্ত সমাধি (১৯২১), অমিয় ধারা (১৯২৩), শ্মশানভষ্ম (১৯২৪), মহররম শরীফ (১৯৩৩), ‘মহররম শরীফ’ কবির মহাকাব্যোচিত বিপুল আয়তনের একটি কাহিনী কাব্য। শ্মশান ভসন (১৯৩৮),
প্রেমের বাণী (১৯৭০) প্রেম পারিজাত (১৯৭০) ইত্যাদি।
মহাকবি কায়কোবাদের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জননন্দিত গ্রন্থের নাম নি:সন্দেহে
মহাশ্মশান। মুসলিম কবিদের লেখা এটাই বাংলা ভাষায় রচিত সর্বপ্রথম মহাকাব্য।।
ইহা জাতীয় আখ্যান কাব্যগুলোর মধ্যে সবচাইতে সুপরিচিত একটি মহাকাব্য। যেটা বাংলা ১৩১১ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে মহাশ্মশান প্রথম প্রকাশিত হয়।যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ হতে আরো ক’বছর দেরি হয়েছিল। কবি কায়কোবাদের মহাকবি নামের খ্যাতি এই ‘মহাশ্মশান’ নামের এই কাব্যের জন্যই। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে লেখা সম্পূর্ণ অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত কবির মর্মভেদী এই কাব্যগ্রন্থটির পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় নয়শত।
বাংলা মহাকাব্যের অস্তোন্মুখ এবং গীতি কবিতার স্বর্ণযুগে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন তা-ই তাকে বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। সেই গৌরবের প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি। বাংলা কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্যরতœ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
মহাকবি কায়কোবাদের কবিতার বিষয়বস্তু নানামুখী এবং বৈচিত্রময়। সহজ-সরল এবং মেদহীন ভাষায় তিনি লিখেছেন স্বদেশপ্রেমের অসংখ্য কবিতা। এসব কবিতাগুলো পাঠ করা মাত্রই পাঠকের হৃদয় দেশের প্রতি ভাবাবেগে পূর্ণ হয়। “দেশের বাণী” কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?
এ দেশের লোক যারা/সকলইতো গেছে মারা/আছে শুধু কতগুলি শৃগাল শকুনি!
সে কথা ভাবিতে হায়/এ প্রাণ ফেটে যায়,
হৃদয় ছাপিয়ে উঠে – চোখ ভরা পানি।
কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!”.... কবি হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক অসাধারণ নিবেদন। প্রিয় স্বদেশ এবং স্বজাতির প্রতি কতটা ভালোবাস থাকলে এভাবে বলা যায়! শুধু মাতৃভূমি নয়, মাতৃভাষার প্রতিও ছিল কবির অনাবিল ভালোবাসা। তাইতো তিনি “বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা” কবিতায় লিখেছেন,
বাংলা আমার মাতৃভাষা/বাংলা আমার জন্মভূমি।/গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,/যাহার চরণ চুমি।/ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,/
যাহার পূণ্য-গাথা!/সেই-সে আমার জন্মভূমি,/সেই-সে আমার মাতা!-------- স্বদেশমাতৃকা এবং বাংলা ভাষার প্রতি কবির অপরিসীম মমত্ববোধ আমাদের জন্য, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য চিরশিক্ষণীয়।
আগেই বলেছি মহাকবি কায়কোবাদের কবিতা বিচিত্রমুখী। তিনি যেমন তাঁর কবিতায় দেশের কথা বলেছেন, ভাষার কথা বলেছেন তেমনি বলেছেন জীবন ঘনিষ্ঠতার কথা। মানব জীবনের পরতে পরতে লুকায়িত আছে হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-অসুখ। তাইতো তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুখ” কবিতায় লিখেছেন,
সুখ সুখ’ বলে তুমি কেন কর হা-হুতাশ,
সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ!
পথিক মরুভূ মাঝে খুঁজিয়া বেড়ায় জল,
জল ত মিলে না সেথা, মরীচিকা করে ছল!
তেমতি এ বিশ্ব মাঝে, সুখ ত পাবে না তুমি,
মরীচিকা প্রায় সুখ, – এ বিশ্ব যে মরুভূমি!
ধন রতœ সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,
সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই!
‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া স্বার্থ ত্যাগ কর যদি,
পরের হিতের জন্য ভাব যদি নিরবধি!
নিজ সুখ ভুলে গিয়ে ভাবিলে পরের কথা,
মুছালে পরের অশ্রু – ঘুচালে পরের ব্যথা!
আপনাকে বিলাইয়া দীনদুঃখীদের মাঝে,
বিদূরিলে পর দূঃখ সকালে বিকালে সাঁঝে!
তবেই পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে তুমি,
যা রুপিবে – তাই পাবে, সংসার যে কর্মভূমি!---------- কী অসাধারণ আহবান! অন্যের চোখের জল মুছিয়ে দিলে, অন্যের ব্যথা বেদনা দূর করে দিলে তবেই প্রকৃত আত্মসুখ লাভ করা যাবে। আফসোস করে বলতে হয়, এই উপলব্ধি থেকে আজ আমরা অনেকখানি দূরে। এখন আমরা কেবলই স্বার্থের রশি ধরে টানাটানি করি। অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের উদর পুর্তি করতে চাই।
আরও একটি কবিতার উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। দশম শ্রেণিতে পড়েছিলাম প্রিয়কবি কায়কোবাদের “ভুল ভেঙে দাও”
কবিতাটি। যা আজও আমাকে নিরবে-নিভৃতে মহান স্রষ্টার দরবারে নিজেকে নিবেদিত করতে, আত্মসমর্পণ করতে অনুপ্রাণিত করে। কবি বলেছেন,
“প্রভু, ভুল ভেঙ্গে দাও/যে ভুলে তোমারে ভুলে/হীরা ফেলে কাঁচ তুলে।/ভিখারী সেজেছি আমি/আমার সে ভুল প্রভু/তুমি ভেঙ্গে দাও।/ প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও।/তুমি বিভু অন্তর্যামী/আমার প্রাণের স্বামী ।
তুমি ভিন্ন এ জগতে/ নাহি মোর কেউ/
প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও...... কবির এই গভীর আত্মোপলব্ধি এবং স্রষ্টার কাছে করজোড়ে মিনতি যেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের সতত উচ্চারণ। পৃথিবীর মুলত একটি পান্থশালা। একটি মোহ-মায়া। এই পৃথিবীর প্রভাব, প্রতিপত্তি, খ্যাতি, সম্পদ এবং অন্যান্য লোভ-লালসায় পড়ে আমরা আমাদের মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা কে ভুলে থাকি। ভুলে যাই। আমরা চেতনে অথবা অবচেতনে হীরা ফেলে কাঁচ নিয়ে মত্ত থাকি। তাই “ভুল ভেঙে দাও” কবিতা যেন সেই মোহমুক্তির কবিতা। স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সবশেষে বলতে চাই, মহাকবি কায়কোবাদের লেখা কবিতা আমরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। কবির চিন্তা, চেতনা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। হৃদয়ে লালন করছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এখন নবম-দশম শ্রেণির বাংলা প্রথম পত্র বইয়ে মহাকবি কায়কোবাদের কোনো কবিতা পাঠ্য নেই। অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন মহাকবি। একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমরা পাঠ্যবইয়ে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাই। আগামী ২১ শে জুলাই মহাকবি কায়কোবাদের ওফাত দিবস। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। সেই সাথে মহাকবি কায়কোবাদের জীবনাচরণ এবং কবিতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনা এবং চর্চা হওয়া উচিত বলে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন
আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী
গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক
বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন
পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের
কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা
পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ
পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়
জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭
রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ
ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা
উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন
ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা
উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল