সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্যে চিত্ত এবং বিত্ত
১০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩১ পিএম | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম

বাংলা সাহিত্যের হাতে গোনা কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান একজন। তাঁর লেখার চিত্ত ও বিত্ত বৈভবে মুগ্ধ হবে না এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও পাঠ্যবইয়ের কবিতার মাধ্যমে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর লেখার প্রেমে পড়ে যাই। বিশেষ করে কবিতার কথা না বললেই নয়। সেই কবে পড়েছিলাম কবির লেখা আমার পূর্ব বাংলা কবিতাটি। এখনও যা মনের গহীনে মাঝে-মাঝেই উঁকি দেয়। বিড়বিড় করে আনমনে পাঠ করি-
আমার পূর্ব–বাংলা/ সৈয়দ আলী আহসান
আমার পূর্ব–বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল/অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো/ সরোবরে অতলের মতো/কালো–কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি/ আমার পূর্ব–বাংলা বর্ষার অন্ধকারে/অনুরাগ/ হৃদয়/ছুঁয়ে–যাওয়া/সিক্ত নীলাম্বরী...
আমাদের সবার প্রিয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক, অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা শহরের আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানেই বিয়ে করেন। অত:পর যথাক্রমে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রে এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে কর্মসূচি নিয়ামক হিসাবে চাকরি করেছেন। তিনি ১৯৪৯ খ্রি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক এবং ১৯৫৩ খ্রি: সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৫ খ্রি: পর্যন্ত তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ খ্রি: পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা এবং জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন।। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি শিক্ষিতমহলে সমধিক পরিচিত। এখানেই শেষ নয়, ১৯৭১ সালে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ্রচেনাকণ্ঠগ্ধ ছদ্মনামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। বর্ণিল কর্মজীবন শেষে কবি ২০০২ সালের ২৫ জুলাই তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
প্রিয়কবির বর্ণাঢ্য কর্মজীবন পর্যালোচনা করলে সহজেই তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। এসব কিছুর বাইরে তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব এবং নিজের লেখালেখির কাজও অত্যন্ত সফলভাবে পালন করেছেন। যা থেকে সহজেই অনুমেয় যে তিনি অসাধারণ চিত্ত এবং বিত্তের অধিকারী একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন। এতো বড় বড় পদের অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন একজন নিরহংকার এবং সাদা মনের মানুষ।
কবিতা সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসানের ধ্যান-ধারণা সমকালীন অন্যান্য কবিদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তেমন একটা মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়নি। যদিও তার রচনায় রয়েছে ঐতিহ্য-চেতনা, সৌন্দর্যবোধ এবং স্বদেশপ্রীতি, যা অন্য কবিদের লেখাতেও বর্তমান। কবির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’কে তাঁর সেরা সংকলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থে প্রধানত গদ্য-কবিতা স্থান পেয়েছে, সেই গদ্য-কবিতা রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদের গদ্য-কবিতা থেকে পৃথক, কেন না তার কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে রয়েছে নতুনত্ব ও আধুনিকতা।
উপমা ব্যবহারে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার পার্থক্য বেশ চোখে পড়ার মত। জীবনানন্দে আছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা কিন্তু সৈয়দ আলী আহসান প্রধানত ব্যবহার করেছেন বিমূর্ত উপমা। তার উপমার কারুকাজ, স্থাপনা কৌশল নি:সন্দেহে সচেতন পাঠককে মুগ্ধ করবে। তার ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্য সংকলনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘প্রার্থনা’ ও ‘আমার পূর্ববাংলা’ কবিতা দুটি। তার কবি প্রতিভার উদাহরণ পাওয়া যায় নি¤েœাক্ত চরণগুলোতে-
“ ‘এভাবেই আমার দিন রাত্রির অধীরতা
অনেক বনের মধ্য দিয়ে
অনেক নদী সমুদ্রের স্বচ্ছতায়
একদিন হয়তো পাহাড়ের দুর্গমতায়
পাথরের নিশ্চেতন সংকট পার হয়ে
ইউলিসিস ইথাকায় ফিরবে’। / (প্রার্থনা, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)
এবার সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্য কর্ম থেকে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা নিচে প্রদান করা হলো- কাব্যগ্রন্থ: অনেক আকাশ (১৯৬০), একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২),
সহসা সচকিত (১৯৬৮), উচ্চারণ (১৯৬৮),
আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৩) প্রেম যেখানে সর্বস্ব।
সম্পাদিত প্রবন্ধ গ্রন্থ: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে (১৯৫৬), কবিতার কথা (১৯৫৭), কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮), আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০), রবীন্দ্রনাথ : কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৩), মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ (১৯৭৬) আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬), যখন কলকাতায় ছিলাম, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ২০০৪ বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস মধ্যযুগ শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য, জীবনের শিলান্যাস সম্পাদিত গ্রন্থ: পদ্মাবতী (১৯৬৮), মধুমালতী (১৯৭১), অনূদিত গ্রন্থ:
ইকবালের কবিতা (১৯৫২), প্রেমের কবিতা (১৯৬০), ইতিহাস (১৯৬৮), রাজা ইডিপাস
ইসলামি গ্রন্থ: মহানবী, আল্লাহ আমার প্রভু
অন্যান্য গ্রন্থ: যখন সময় এলো, রক্তাক্ত বাংলা, পা-ুলিপি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, রজনীগন্ধা, চর্যাগীতিকা
আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ১৯৭৫ সাল, বাংলাদেশের সংস্কৃতি।
উল্লেখ করার মত একটি ঘটনা এই যে, সেনেগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফরাসি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লিউপোল্ড সেডর সেংঘর ছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা তার কবিতায় তিনি বলেছিলেন : “ ‘তুমি এলে/ তোমার চোখ আমার চোখের/ সামনে দিয়ে চলে গেল,
তোমার চোখ ঈষদুষ্ণ বাড়ির স্পর্শে/চুম্বকের স্বাদ পেল।’
সেংঘরের এই পঙক্তি যে যথার্থ, তার প্রমাণ আমরা পাই কবি অন্নদাশংকর রায়ের লেখায়। সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি একজন সত্যিকার কবি। যেমন হৃদয়বান, তেমনি রূপদর্শী। যে ভাষায় তিনি লেখেন, তা খাঁটি বাংলা। তাঁর কবি পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ পরিচয়।” আধুনিক উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি কলিম সাসারামী সৈয়দ আলী আহসানের ষাটতম জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘যখন বিধাতা সাহিত্যের জন্য একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবলেন, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্যের দিগন্তে আবির্ভূত হলেন কিরণসঞ্চারি সূর্যের মতো। এবং তখন কাব্যলোক আনন্দের সারৎসার এবং উচ্ছ্বলতা-উৎফুল্লে নৃত্যরত হলো। স্বর্গ থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত উপাদান সঙ্গীতে সমৃদ্ধ হলো।’
এমনি করে অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বরেণ্য ব্যক্তি সৈয়দ আলী আহসানের স্তুতি গেয়েছেন।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ, গঠন করবে উদ্যোক্তা তহবিল

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বরখাস্ত

৯ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ, অব্যাহত থাকতে পারে

ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চাঞ্চল্যকর কৌশল আ. লীগের পলাতক নেতাদের!

ভারতে সোনার দাম পতনের আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস

বাগেরহাটের চিতলমারীতে বহুতল ভবনে আগুন, ১ নারীর মৃত্যু

যশোরে পুকুর থেকে নবজাতকের মরদেহউদ্ধার

বিশ্বনাথে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে অপপ্রচার : তিন সংগঠনের প্রতিবাদ

গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রশিবিরের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী হামলা ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শরীয়তপুরে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ মিছিল

গাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে জয়পুরহাটে বিক্ষোভ মিছিল

দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরলেন নাসির

কটিয়াদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক প্রেষণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত!

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ও মানববন্ধন

সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য পর্যটন কেন্দ্রের নড়বড়ে সিঁড়ি যেন পর্যটকদের মরন ফাঁদ

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ইসরায়েলকে অবিলম্বে গণহত্যা-জবরদখল থামাতে হবে : সাদা দল

গোয়ালন্দে ইজিবাইক ও চাঁদার টাকাসহ আটক ৩

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মিছিল-স্লোগানে উত্তাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়