আবদুল মান্নান সৈয়দ কবি ও গবেষক

Daily Inqilab রেশম লতা

০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৩ পিএম | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম

একটা বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আমি চারিপাশে তাকাইনি। দ্বিতীয়বার হৃদরোগে পরে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকে আমি আমার আশপাশের মানুষেরে দেখলাম- আমার পাড়ার মানুষ, বাজারের লোকজন, খুব সাধারণ মানুষ। বুঝতে পারছি, যাদের নিয়ে আমার জীবন চলেছে, তাদের জন্য আমি কোনো কিছু করিনি।

এই আক্ষেপ কি কবির শুধুই আক্ষেপ নাকি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা? যাকে ৬০ দশকের আর্টস ফর আর্টের প্রবক্তা সৃষ্টিশীল কবি, লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক সর্বোপরি সাহিত্যিক পুরোধা হিসেবে গন্য করা হয় সে কি সত্যিই জীবনের প্রতি উদাসীন ছিলেন? যদি তাই হত তবে তিনি জীবনানন্দের সাথে নিজের পার্থক্য খুঁজতে যেয়ে বলতেন নাথ “আমি নির্জন কিন্তু উগ্র-উদ্ধত। এটা আমাদের খানদানি স্বভাব। কিন্তু হৃদয়হীন বোধ হয় না। আমি অসম্ভব ক্রোধী অসম্ভব প্রেমিক।” এই অসম্ভব ক্রোধী অসম্ভব প্রেমিক আব্দুল মান্নান সৈয়দ ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলায় ৩ আগস্ট ১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে তার কাব্য ও গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি এদেশের সেরা পরাবাস্তব কবিতার জনক। আলোচনা, সমালোচনা সাহিত্যের কর্ণধার, গল্প, উপন্যাসের একচ্ছত্র অধিপতি। নজরুল - জীবনানন্দের এই গবেষক নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’ ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, বেগম রোকেয়া, আব্দুল গণি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধ চন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা করেছেন।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্য জীবনের প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে বলেন, আমার জীবনে লেটো পিরিয়ড আছে। নজরুলের মতো। পিরিয়ডটা হলো আমার ক্লাস সেভেন এইট থেকে এম এ পাস পর্যন্ত। আমি বিরামহীন লেখালেখি করতাম আর ছবি আঁকতাম। কিন্তু আমার আব্বা, কলিকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন; চাচাও মেধাবী ছাত্র; আমাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন যেন আমি এম এ পাস করি। এই জন্য ১৯৬৫ সালকে আমি ধরি আমার আত্মপ্রকাশের বছর।

১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক সাহিত্য বিভাগে সোনার হরিণ’ কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার জগতে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। শক্তিধর এই লেখক অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় লেখা উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন। উপমাপ্রতীক কিংবা রূপকের বিন্যাস স্পষ্টতই চোখে পড়ে কবিতার শরীরের ভাঁজে-ভাঁজে। আবদুল মান্নান সৈয়দ ১৯৬০ সাল থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন এবং পাঁচ দশক ধরে লেখা অব্যহত রাখেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। তাঁর কবিতায় প্রতীকধর্মীতা বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে পাশাপাশি রোমান্টিকতা, মৃত্যুচেতনা আবার কখনো এ্যাবসার্ডধর্মী ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সুররিয়ালিজমের পুত্র যেন কবি মান্নান সৈয়দ। তিনি পরীক্ষামূলক-নিরীক্ষাধর্মী এবং বিচিত্রধর্মী নিবেদিত প্রাণা এক কবি ও গবেষক। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯), ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪) এই কাব্যগ্রন্থগুলোতে কবি বাংলা কাব্য সাহিত্যে নতুন সুর তুলে ধরেছিলেন। প্রথম কাব্যেই যেন বাজিমাত, পরাবাস্তবতার যা উদাহরণ তা তার কাব্যগ্রন্থে স্পষ্টত আর সেইজন্যই ‘পরাবাস্তবতার কবি বলে নিজেকে সনাক্ত করে চাঞ্চল্যকর আলোচনায় এসেছিলেন। তাঁর রচিত দেড় শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহথথ কবিতাথ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২), পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২), পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩), মাছ সিরিজ (১৯৮৪), নির্বাচিত কবিতা (২০০২)। প্রবন্ধমূলক গবেষণাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), নজরুল ইসলাম: কবি ও কবিতা, করতলে মহাদেশ (১৯৭৯), রবীন্দ্রনাথ (২০০১), আবদুল গনি হাজারী (১৯৮৯), সৈয়দ মুর্তজা আলী (১৯৯০), প্রবোধচন্দ্র সেন (১৯৯৪)। শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ: বেগম রোকেয়া (২০০২)। সমালোচনা সমগ্রথ জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৩), বাংলাদেশের কবিতা (যৌথ, ১৯৮৮), সমর সেনের নির্বাচিত কবিতা ((১৯৮৯), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচনাবলী (প্রথম খন্ড-১৯৯০, ২য় খন্ড-১৯৯২), মাইকেল মধুসূদন দত্ত: শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯২)।

 

আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন খোদাভীরু। তাইতো সকল প্রশংসা তার’ শিরোনামে কবিতায় কবি বলেছেনথ
“সকল প্রশংসা তাঁর যিনি ঊর্ধ্বাকাশের মালিক;
নক্ষত্রের চলাফেরা চলে যাঁর অঙ্গুলিহেলানে;
আমরা আশ্রিত তাঁর করুণায়: জীবনে, মরণে;
তাঁর আলো চন্দ্র-সূর্য, তারাদের আলোর অধিক
তাঁরই মুক্তা প্রজ্বলিত ঘন নীল রাত্রির ভেতরে;
তাঁরই হীরা দীপ্যমান দিবসের পূর্ণ ললাটে;
যুক্ত করেছেন তিনি তুচ্ছতাকে অসীম, বিরাটে,
সমস্ত সৌন্দর্য তাঁরই লোকাত্তর প্রতিভাস ধরে।
এমন সরল সাদামাটা ধর্মীয় বিষয়ক কবিতা থেকে সমৃদ্ধ গদ্যে লেখার যে বিচিত্রশৈলী ও বিষয়বস্তুর নানামাত্রিকতার নির্ণয়তা তা সত্যিই দুর্লভ। তার কবিতাগুলোয় মেঘকে চিত্রকল্পের প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। সাহিত্যের যেকোনো বিষয়ে তাঁর পাঠ ও পাঠোত্তর অর্জিত জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। সৃষ্টিশীলতার প্রতি” কবিতায় কবি নিজের অস্তিত্বকে তুলে ধরেছেন এভাবে

“শুধু তোমাকে সালাম-- আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস-- শুধু তুমি ঘাসে রতœফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে--
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে-- আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর-- সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে।
গভীর প্রজ্ঞাময় ও বিচিত্রধর্মী এই কবি ‘মালার স্মৃতি’ কবিতায় তাঁর প্রিয়াকে ভুলতে পারেননি। তিনি যতই পণ করুক এবার ভোলার পালা কিন্তু কবি কাজী যেখানে ভুলতে পারেনি সেখানে মালার দেয়া ফুলের মালা যতই শুকোক তবুও তাকে মনে রাখার। প্রকৃত ভালোবাসার এই যেন পরম সত্য, অধরা সুখের নিয়ন নির্যাস।
মনে রাখার দিন গিয়েছে, এখন ভোলার পালা!
থপ্রশ্ন আমার : ভুলতে কি পেরেছিলেন কাজী কবি স্বয়ং?
বর্ণহীন জীবনে কেউ ভুলতে পারে ভালোবাসার রঙ?
মালার স্মৃতি থেকেই যায়, যতো শুকোক মালা!

শওকত ওসমান মান্নান সৈয়দের কবিতার সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “মান্নান আঙ্গিকের দিক থেকে পুরোপুরি পরাবাস্তববাদী বা সুররিয়ালিস্ট। চিত্রকলার মাধ্যমেই তার ভাবজগত নির্মিত। মান্নানকে ভুল-বোঝাবুঝির তাই যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু ইউরোপীয় কাব্যধারার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, এমন হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রবন্ধে তিনি স্বচ্ছন্দ, বিশুদ্ধ ও সুগভীর শৈল্পিক মনোভাব, নির্মোহ ও স্পষ্টবাক, বিবেকীয় সমালোচনায় প্রত্যুজ্জ্বল।

নগ্নবাস্তবতার প্রসারতা, অস্পষ্টতার ধোঁয়াশা তথা ফ্রয়েডিয় শিল্পচৈতন্য আমরা দেখতে পাই মান্নান সৈয়দের কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড” কবিতায়
এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল--
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।

গ্রিনরোড” কবিতায় কবির হতাশা, দুরাশা আর আগামী প্রজন্মের অনিশ্চিত জীবনের প্রতি উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে লিখেছেন থ
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল--
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম।
তেস্রা জুলাই কবিতা কবি মান্নান সৈয়দের স্মৃতিচারণমূলক কবিতা। এই কবিতায় কবির গভীর অন্তর্দাহ ফুটে উঠেছে। বিরহ, যন্ত্রণা যেন তাকে ঘিরে ধরেছে কাঁথার মত।
তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে
তেস্রা জুলাইয়ে।
পরস্পরকে আমরা দেখলাম কি না জানি না।
আমরা বসে থাকলাম দুটি আলাদা সোফায়।
যে আমরা দেখা হলে হতাশ কলকণ্ঠথ
ফুটে উঠত তোমার মুখে জ্যোতিথ
আমি যেন টগবগ করে ফুটতাম
কেশর-তোলা একটা ঘোড়ার মতোথ
সেই আমাদের ভেতরে এখন স্তব্ধতা।
তোমাকে বলব বলে কত কিছু ভেবে এসেছিলামথ
কিনে পড়ছিল না।
কিছুই বলতে পারলাম না।
তুমিও না।
এক ঘণ্টা শুধু আমরা নিস্তব্ধ বসে থাকলাম মুখোমুখি।
আমার সামনে খাবার পড়ে থাকল।
রঙ-চা নিথর হয়ে গেল।
রাত্রি থেমে থাকল যেন বাইরে।
ঘণ্টা-মিনিটও নিশ্চল।
সময় হলে তুমি দরোজা খুলে দিলে।
আমি হাত তুললাম।
তুমি হাত তুললে।
আজ সকালবেলা একটা কথা জাগছে মনে।
একসময় আমরা শব্দ দিয়ে অনেক বাক্য তৈরি করেছি,
কবিতা লিখেছি আমি সেও শব্দ দিয়ে।
তেস্রা জুলাইয়ে নৈঃশব্দ্য কথা বলেছিল,
কবিতা লিখেছিল। আরেক কবিতার লাইনে তিনি বলেছেন: আনন্দ কাকে বলে আজ আর মনে নেই আমার।

আব্দুল মান্নান নিজের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে এমনটাই তুলে ধরছেন যেথ ‘শেষ পর্যন্ত শাদা কাগজের পৃষ্ঠায় অক্ষর বসিয়ে যাওয়ার চেয়ে আনন্দ পাইনি আর কোথাও। আজো পাই না। ছাপার অক্ষরে এক জিনিশ, সম্প্রচার এক জিনিশ;- কিন্তু যে-মহূর্তে একটি কবিতা লিখে উঠলাম, একটি গল্প লেখা শেষ হলো, একটি প্রবন্ধ দাঁড় করালাম, নির্মিত হল একটি নাটক- সেই মুহূর্তে পৃথিবীতে নক্ষত্র নেমে আসে আকাশ থেকে; মাটি অর উদ্ভিদ, মানুষ আর পাখি, আনন্দ ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এক সিরাপ উড়ো নদীর মতো প্রবাহিত হতে থাকে।’ তাইতো কবি বেলাল চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’।

সর্বসত্তা নিমগ্ন বিচিত্রতলস্পর্শী সর্বসত্তানিমগ্ন সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজে কবিতা লেখার চেয়ে অন্যের কবিতা নিয়ে বহুমাত্রিকতা ও বহুরৈখিকতা প্রকাশে যেন বেশ সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৭২ সালে জীবনানন্দ-বিষয়ক প্রথম গবেষণাগ্রন্থ শুদ্ধতম কবি” প্রকাশিত হলে আবদুল মান্নান সৈয়দ খুঁজে পান তাঁর পদচারণার জগৎ।

রবীন্দ্র-নজরুল- জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের নিঁখুত সুনিপুণ মূল্যায়ন কেবল তার দক্ষ সাহিত্য সমালোচনা দেখলেই বুঝা যায়। উৎকৃষ্ট সমালোচক হিসেবে তিনি সফলতার ছাপ রেখেছেন অভাবনীয়। জীবনানন্দ দাশকে তিনি বলেছিলেন শুদ্ধতম কবি তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে ‘জীবনানন্দ দাশ গল্প শীর্ষক এক প্রবন্ধে মান্নান সৈয়দ লিখেছেন।

বুদ্ধদেববসু জীবনানন্দের স্বভাব ও কবিতায় একটি সুদৃঢ়তা ও দীপবর্তীতা ছিলো। তার সাক্ষ্য দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, অরুণ কুমার সরকার ও নরেশ গুহ। কিন্তু একই সঙ্গে সংলগ্নতা ও যুক্ততাও ছিলো। তা দেখিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা লাবন্য দাস, সুচরিতা দাস ও অশোককানন্দ দাস এবং তার শেষ জীবনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সুবোধ রায়। প্রকাশ্যে তিনি একটি দূরত্বের আবরণ রচনা করেছিলেন; কিন্তু মর্মত, জীবনানন্দ সন্ন্যাসি ছিলেন না- ছিলেন সর্বতোভাবেই গৃহী, যুক্ত, সম্ভোগী। জীবনানন্দের কবিতাতেও ঐ আনন্দ ও যন্ত্রণার সফেন অংশীদার, জ্বলেপুড়ে যাবে যার মর্ম পৃথিবী বিশ্বাস অবিশ্বাসের অবিরল করাতের মতো দোটানায়, সে কী সন্ন্যাসি? সে তো লিপ্ত, যুক্ত, আসক্ত। আব্দুল মান্নান সৈয়দের গদ্য ভাষা প্রকাশ রীতি কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। যা অভিনবত্বের ধারক ও বাহক। তাঁর লেখা জটিল ও দুর্বোধ্য হলেও সার্বিকভাবে পাঠক পঠন ক্ষমতায় ঋদ্ধ এবং সংযত। অবিরল সৃষ্টিমুখর ও মননদীপ্ত লেখককেই খুঁজে পাই। বৈচিত্র্য ও গভীরতা, সাধনা ও নিমগ্নতায় তার তুল্য মানুষ সমগ্র বাংলা ভাষার সাহিত্যেই কম পাওয়া যাবে। কারণ, দেখা গেছে কবিতায় যিনি এতটা নিবিষ্ট তার পক্ষে ধারাবাহিকভাবে কথাসাহিত্যে এতটা সক্রিয় থাকা কঠিন। আবার গবেষণায় যিনি এতটা বিচিত্রচারী, তার পক্ষে কবিতা ও কথাসাহিত্যে এতটা সৃষ্টিক্ষম থাকা খুব কঠিন।

রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির গ্রন্থের ভূমিকায় আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন, বাংলা সাহিত্যের সবিশেষ স্বাতন্ত্র চিহ্নিত শক্তিমান লেখকদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির গ্রন্থটি প্রণীত হয়েছে। বিষয় মূলত ছোট গল্প ও উপন্যাস হলেও এখানে ধৃত লেখকদের একটি স্বাতন্ত্রীক ও সামগ্রিক মানসালেখ্য বিবৃত করতে প্রয়াস পেয়েছি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমার বেড়ে ওঠা জীবনের শৈশব-কৈশোর আমার কয়েকজন বন্ধু, শিক্ষক ও সমকালীন সাহিত্য মেধাদের প্রসঙ্গ ও চকিতে উল্লেখিত হয়েছে- অনেকটাই আনুষঙ্গিকতার অনিবার্য সাপেক্ষ। আব্দুল মান্নান সৈয়দ রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, কবিতা নিয়ে যেমন আলোচনা-সমালোচনা করেছেন তেমনি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে আরও বেশি আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। নজরুল সমগ্র রচনায় তার অবদান জাতি আজীবন মনে রাখবে। কাজী নজরুল ইসলামের সুহেলিকা’ শিরোনামে এক সাহিত্য সমালোচনায় আব্দুল মান্নানের স্বগোক্তি ছিল এইথথ কবি হিসেবে নজরুল কোনো আদর্শে স্থির থাকেননি। ঔপন্যাসিক হিসেবেও। এক অবিরল চালষ্ণুতাই তার আত্মিক ও সাহিত্যিক চরিত্র। নজরুলের ঔপন্যাসের আলোচনায় তাই একথা সতত স্মরণীয় তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রেসের দ্বারা আন্দোলিত অভিভূত হয়েছেন, কিন্তু প্রেমকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেননি। বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে আলোড়িত হয়েছেন, ধার্মিক আধ্যাত্মিক ব্যাপারে লিপ্ত হয়েছেন; তার শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লববাদে ঝুঁকে ছিলেন এবং তার বন্ধু মুজজাফর আহমদের দ্বারা উদ্বোধিত হয়ে সাম্যবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন- কিন্তু কোথাও নোঙর ফেলেননি।” বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ছিল আব্দুল মান্নান সৈয়দের অগাধ ধারণা ছিল। তিনি যুগ সচেতন সাহিত্যিক। ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর দশ প্রবন্ধের দশদিক প্রবন্ধে লেখক শাহাবুদ্দীন নাগরী বলছেন, ‘কবি’ হিসেবেই থেকে যেতে পারতেন আমৃত্যু, কিন্তু যাঁর স্বভাব সব দরোজা-জানালা খুলে খুলে দেখা, তিনি কি শুধু কবিতার ঘোরের ভেতরেই মগ্ন থাকতে পারেন? অথবা এমনও হতে পারে তাঁর ভেতরে ‘কবি’ হিসেবে বেঁচে থাকবার আত্মবিশ্বাস ক্রমেই খর্ব হয়ে যাচ্ছিল! আব্দুল মান্নানের সাহিত্যকে অনেকেই জটিল ও রহস্যময় বলে আখ্যায়িত করেছেন কেননা তার কলম ঋষিপ্রতিম রণেশ দাসগুপ্তকে নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা যেমন করেছে তেমনি করেছে শাহাদাত হোসেন কিংবা ফররুখ আহমদের ইসলামি কবিতা নিয়ে দুটো দিকই সাহিত্য মুদ্রার এপিট ওপিট তবুও তিনি যেন সমালোচকেরও সমালোচক নিগূঢ় আলোচক। তাঁর সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার বলেছেন, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ একাধারে ছিলেন সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যিক। বিশেষ করে কবিতা ও ছোটগল্পে তার সৃষ্টিশীলতা এক সময় সাহিত্যামোদী পাঠকদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। সাহিত্যে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র কর্তৃক ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার; ১৯৯৮ সালে নজরুল পুরস্কার (চুরুলিয়া, বর্ধমান, পশ্চিম বাংলা); ২০০১ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক নজরুল পদক; ২০০০ সালে তালিম হোসেন পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার এবং ২০০২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পৌরুষদীপ্ত ও ব্যক্তিত্বময় এই কবি ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপী, সদা হাস্যময় ও আমৃত্যু চঞ্চল হৃদয়ের তীব্র অভিমানী ছিলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে পরলোক গমন করেন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
নষ্ট সময়
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ : বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের কারিগর
কবিতা
বাসের টিকিট ও মফিজের ভাবনা
আরও
X

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ, গঠন করবে উদ্যোক্তা তহবিল

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ, গঠন করবে উদ্যোক্তা তহবিল

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বরখাস্ত

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বরখাস্ত

৯ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ, অব্যাহত থাকতে পারে

৯ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ, অব্যাহত থাকতে পারে

ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চাঞ্চল্যকর কৌশল আ. লীগের পলাতক নেতাদের!

ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চাঞ্চল্যকর কৌশল আ. লীগের পলাতক নেতাদের!

ভারতে সোনার দাম পতনের আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস

ভারতে সোনার দাম পতনের আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস

বাগেরহাটের চিতলমারীতে বহুতল ভবনে আগুন, ১ নারীর মৃত্যু

বাগেরহাটের চিতলমারীতে বহুতল ভবনে আগুন, ১ নারীর মৃত্যু

যশোরে পুকুর থেকে নবজাতকের মরদেহউদ্ধার

যশোরে পুকুর থেকে নবজাতকের মরদেহউদ্ধার

বিশ্বনাথে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে অপপ্রচার : তিন সংগঠনের প্রতিবাদ

বিশ্বনাথে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে অপপ্রচার : তিন সংগঠনের প্রতিবাদ

গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রশিবিরের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রশিবিরের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী হামলা ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শরীয়তপুরে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী হামলা ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শরীয়তপুরে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ মিছিল

গাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে জয়পুরহাটে বিক্ষোভ মিছিল

গাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে জয়পুরহাটে বিক্ষোভ মিছিল

দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরলেন নাসির

দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরলেন নাসির

কটিয়াদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক প্রেষণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত!

কটিয়াদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক প্রেষণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত!

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ও মানববন্ধন

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ও মানববন্ধন

সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য পর্যটন কেন্দ্রের নড়বড়ে সিঁড়ি যেন পর্যটকদের মরন ফাঁদ

সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য পর্যটন কেন্দ্রের নড়বড়ে সিঁড়ি যেন পর্যটকদের মরন ফাঁদ

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ইসরায়েলকে অবিলম্বে গণহত্যা-জবরদখল থামাতে হবে : সাদা দল

ইসরায়েলকে অবিলম্বে গণহত্যা-জবরদখল থামাতে হবে : সাদা দল

গোয়ালন্দে ইজিবাইক ও চাঁদার টাকাসহ আটক ৩

গোয়ালন্দে ইজিবাইক ও চাঁদার টাকাসহ আটক ৩

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মিছিল-স্লোগানে উত্তাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মিছিল-স্লোগানে উত্তাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়