নিরীক্ষালালিত অন্তঃরূপশক্তির ফল্গুধারা
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৮ পিএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
সময় নিয়তই সমুখে ধাবমান এবং ক্রমপরিবর্তনশীল। আর সময়ের সাথে প্রকৃতি, প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট সবকিছুর ধারাও সদা পরিবর্তমান। মানুষের জীবনধারা থেকে শুরু করে যাপনের কলাকৌশল সবই যেন সময় ও কাল দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছে। খুব স্বভাবতই পরিবর্তনের ¯্রােতে ধাবিত হয়, হচ্ছে সমাজের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের মতো সৃজনশীল কর্মকা-ও। আবার সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা কবিতার রদবদল হরহামেশাই ঘটছে, চলছে নতুন নতুন নিরীক্ষা। ব্যঞ্জনাময় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ, গদ্য, সনেট, কলেবর, আবহ ইত্যাদির নানা ভাঙচুরের মাধ্যমে নিত্য-নতুন বিনির্মাণের কলা-কৌশলে কবিতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে সাজান নিরীক্ষাপ্রবণ কাব্য প্রণেতারা। কবিতাকে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা দুরূহ ব্যাপার। কাব্যকৃতির মূল্যায়ণ বিষয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘যিনি ছন্দে কিছু রচনা করতে পারেন তাকেই কবি বলে মেনে নেয়া যায়; কবিতার শিল্পমূল্য নির্ণয় করবে মহাকাল যখন অর্থগৌরব আবিষ্কার করবে অনাগত কালের সমধর্মী পাঠক।’ আবার বলা হয়ে থাকে ছন্দ এক ধরনের প্রতারক বা অর্থহীন প্রলাপকেও মাধুর্য দিতে পারে। অন্যদিকে গদ্যাক্রান্ত আধুনিক চালের কবিতায় প্রবন্ধের মতো যুক্তি ও ধারানুক্রম বক্তব্যের পারম্পর্য সৃষ্টিতেও কবিতা নান্দনিক হয়ে উঠতে পারে। মূলত কবিতা এবটি বোধÑ যার মূল না বুঝতে পারলে কবিতাকে বোঝা যায় না। সম্ভব নয়।
ধ্রুব সত্য এই যে, নিয়ত পরিবর্তনশীলতাই পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম। সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে যাপনের যাবতীয় অনুষঙ্গের বিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, সংকোচন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন- এসবই বদলে যাওয়া কালের ধারার চিরায়ত তাড়া। আর বিশেষ ঘটনা এবং স্মরণ্য প্রতিভা হয় কালের মুখপাত্র। যা স্বকালে সে ¯্রষ্টার স্বরূপ চেনায় এবং চিরকালে তাই-ই স্থির হয়ে যায়। অতীত ইতিহাস সাক্ষী। পুরাতন ছেড়ে নতুনের আকর্ষণ মানুষের সহজাত স্বভাব। সাহিত্যের কালান্তরের পবির্তনের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রাচীন থেকে সাম্প্রতিক- এই দুয়ের ব্যবধানের মাঝে ভাষা, শব্দ, বাক্য, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, বিষয়, গঠনসহ নানাবিধ দিকের পরিবর্তন, সংযোজন, পরিমার্জন গতিধারায় বহমান। প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জের যুগ, লৌহ যুগ পেরিয়ে আজ চলছে অতি আধুনিক ডিজিটাল যুগ।
সময় ও কালপরম্পরায় সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সম্প্রতি ‘নতুন ধারার’ কবিতায়। চলছে একুশ শতকের অতি আধুনিককাল। তথাকথিত আধুনিকতার বাহানায় নষ্ট নাগরিকতা, নাস্তিক্যবাদ, মার্কসবাদ, ফ্রয়েডিয় যৌনতত্ত্ববাদ, হেগেলের বস্তুবাদতত্ত্বের পুরনো ভাবধারাকে ডিঙ্গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, নতুন বিষয়ে শুরু হওয়া এই ‘নতুন ধারা’র প্রবর্তক কবি ফাহিম ফিরোজ। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নাম লেখাতে চলেছেন নিজ প্রতিভায় সময়োপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ একটি ‘ইশতেহার’ তৈরি করে। এ ধারার কিছু বৈশিষ্ট্য অন্যসব কবিতা থেকে আলাদাতর মাত্রা দিয়েছে। নতুন ধারার কবিতার মূল উপজীব্য প্রান্তিক মানুষ, স্বজন-বন্ধু, গ্রাম বাংলার নানা বিষয় ও প্রকৃতি, দেশজ ঋজুচৈতন্য, সম্পর্কবাচক শব্দ, চিত্রকল্প ও ধ্বনির সাংগীতিক বিন্যাস। আছে নারী ও নিসর্গের সংসর্গের মেলবন্ধনে সমাজিক বাস্তবতার গূঢ় নির্যাসকে ঢেলে কাব্যশরীরে সাজিয়ে নেওয়া। জেনে নেওয়া যাক এ নতুন ধারার বৈশিষ্ট্যসমূহ :
প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো :
১। বহুরৈখিকতা একটি কবিতায় বিবিধ অনুষঙ্গ। যেমন- চা বিক্রেতা রমজি বলছে, ও পাড়ার নাফিসার মা হাসছে, এরকম। আধুনিক কবিতায় এটা ছিল না। তারা ঘনিষ্ঠজনদের কথা আনতেন না। অথচ বিষয়ের সাথে তারা সংশ্লিষ্ট। কিন্তু নতুন ধারার কবিতায় তা রয়েছে।
২. সর্ম্পক ও আত্মীয়বাচক শব্দ আধুনিক কবিতায় ছিল না। নতুন ধারার কবিতায় আছে।
৩। বহু ভাষিকতা অতীতের কবিতায় নেই। একটি কবিতায় তখন একটি ভাষাই ছিল। এখন তার সাথে নতুন ধারায় যোগ হয়েছে প্রমিতের সাথে লোক ভাষা।
৪। শব্দ নিয়ে খেলা বা নতুন শব্দ তৈরি। আধুনিক কবিরা খুব কম নতুন শব্দ তৈরি করেছেন। তাও কয়েকজন কবি মাত্র। যা হিসেবে ফেলা যায় না।
এসব কারণে নতুন ধারার কবিতা হাজার বছরের বাংলা কবিতা থেকে একেবারে আলাদা। খুব সহজেই চেনা যায় নতুন ধারার কবিতা। এবং এখানেই সফল নতুন ধারা।
উপ-বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১। নতুন ধারায় ধর্ম ও অধর্ম থাকবে।
২। বাস্তব ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী।
৩। পুরো নয় আংশিক নন্দনতত্ত্ব সর্মথন।
৪। শিল্পের প্রতি নতজানু- বিয়ং এ (রহস্যময়তায়) আস্থাশীল।
৫। কাঠামো শিথিল হবে।
৬। ইতিহাস - ঐতিহ্য - প্রগতি- দর্শন নির্ভর।
তো...? কী মনে হলো? নিয়মটা খুবই সাধারণ ও সাদামাটা। নতুন ধারার মূল কাঁচামাল আমাদের সার্বক্ষণিক আলাপি ভাষার সাথে অনুপাতহারে কম বেশি প্রমিত শব্দে ও বাক্যের মিশ্রণ। কঠিন নয়, একদম সরল সোজা। এবার ভাবুন, আমাদের জাতির পিতার ভাষণ কেন সর্বকালের সর্বজনীন হলো? জানেন কি, কী এর রহস্য? রহস্য বা কারণÑ যা-ই বলি না কেন, তা খুব সাধারণ। একটু বুঝিয়ে বলি, তাঁর ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণটি ছিল প্রমিত-আঞ্চলিক ভাষার সুন্দর সমন্বয়। তার কিয়দংশ নি¤েœ দেওয়া হলো বোঝার সুবিধার্থে : (বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অংশবিশেষ)
‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।...২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে।...আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।...আর যদি আমার লোকেদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।...সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।...মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’
একটু লক্ষ করুন, কতো সুন্দর করে সহজভাবে সর্বসাধারণের জন্যে আঞ্চলিক-প্রমিতের সমন্বয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। একে অনায়াসেই নতুন ধারার গদ্য বলা যেতে পারে।
এবার নতুন ধারার কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া হলো বোঝার সুবিধার্থেই :
১। ‘তখন শহরের ঝুলন্ত সেতু দিয়া আমাগো লরি ছুটতেইÑ পরিচিত/ ওসি কিম, আলী, দেবুদারা পকেটে ঝাপটে ধরে আঙুল!/ লতাবুর নতুন ধারার সামার সেমিনার উপভোগ্য ছিল কিন্তু ফিরতি/ টিকিট এমজি থামতেই সব স্বপ্ন শুকনা বাঁশের লাহান ফাইটা গেছে ফ্যাসফাস ডেড্ডের!’ (এমজি একটা দুঃস্বপ্ন/ রেশম লতা)
২। ‘গাছের চামড়া তুলে নিলো কেউ?/ নাকি আমরাই ত্বক? ব্যথারা এখন/ জিলাপির প্যাঁচ মারে হাড়ের গভীরে!/ চাইয়া চাইয়া দেখলাম,/আইছিলো গেটে; তবে ঝড় হয়ে উড়ে গেলো...(মৃতদিন/ ফাহিম ফিরোজ)
৩। ‘তন্দ্রাগামী শৈলী বিজ্ঞান ঘরসংসার/ আঁচড়ায়া গুছায়া কিরোম পরিপাটি করতিই/ মইরমখালার জীবনে শ্বসটান ওইঠে যায়.../... ছাড়ছে; ছাড়ছে কঠোর বিধিনিষেধ.../ আহা! মানবজন্ম-ব্যাচেলার জীবন! ফুঁ দেবার/ বাঁশের সোজা শাখা/ মূক বোবা অথচ সুরেলা! (ব্যাচেলার জীবন/ কবির আহাম্মদ রুমী)
৫। আমার তালই মশাই কৈ ছিলেন/গামছা পড়া লোকগুলো কখনো উচা আসনে বসে না (উৎপেলেন্দু পাল)
এ-ও সত্য যে, যা কিছু নতুন সৃষ্টি, হোক তা সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞান তাতে কম বেশি মন্দ-ভালো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে। এবং এটাই স্বাভাবিক। হচ্ছে এই নতুন ধারা নিয়েও। তবে একথাও ঠিক যে, মন্দের কোনো শত্রু হয় না কিন্তু ভালোর শত্রুর অভাব নেই। তাই, যখন যে কাজে নিন্দুকের পদচারণা থাকবে তখনই বোঝা যাবে, কাজটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। (আমার নিজস্ব অভিমত) সেদিক থেকে বলা চলে নতুন ধারা সঠিক পথেই চলছে। আর নতুনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারাটাই তো সময়ের পায়ে পায়ে নিজেকে এগিয়ে নেয়া। অতীত প্রেক্ষাপটের আলোকে নতুনের সাথে তাল মেলাতে পারে প্রবীণ নয়, নবীনরাই। এক্ষেত্রেও সমভাবে পরিলক্ষিত। কোনো ব্যাপার না। সময় ঠিক একদিন প্রবীণদেরও এ ধারায় অভ্যস্ত হতে সাহায্য করবে। এমন আশা করতেই পারি। তবুও পরিশেষে, আদর্শগত দ্বন্দ্বমুক্ত এ নতুন ধারায় দল মত নির্বিশেষে সবার আমন্ত্রণ। আমরা বাঙালি, ষোলোআনা খাঁটি বাঙালি- এটাই আমাদের অহং আর এই অহংবোধকে জাগিয়ে তুলতে এবং ভবিষ্যতে স্থায়ী করতে নতুন ধারাই একমাত্র পথ। জয়তু নতুন ধারা।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ