সাহিত্যে সমালোচনা ভীতি কাটানোর উপায়
১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:৩১ এএম | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:৩১ এএম

সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সমালোচনা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু অনেক লেখকই সমালোচনার ভয়ে নিজের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেন। এই ভীতি কাটিয়ে উঠতে এবং নিজেকে আরও ভালো একজন লেখক হিসেবে গড়ে তুলতে এই সমালোচনা ভীতিকে অবশ্যই জয় করতে হবে। এটা না করতে পারলে সাহিত্য জগতে আপনার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সমালোচনাকে ভয় পেলে আপনার লেখক সত্তার মৃত্যু অবধারিত। তাই আজ আমরা এই ভীতি কাটিয়ে উঠার জন্য কিছু কার্যকর উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
এ বিষয়ে সর্বাগ্রে যে কথাটি বলতে চাই তা হল, লেখকের উচিত সমালোচনাকে একটি নেতিবাচক বিষয় হিসেবে না দেখে বরং নিজেকে উন্নত এবং বিকশিত করার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, প্রত্যেকের মতামতই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেইসব মতামত বিশ্লেষণ করে নিজের জন্য ইতিবাচক কিছু একটা খুঁজে বের করতে হবে। সমালোচনাকে ভালোবাসতে হবে। স্বচ্ছ এবং উদার মনে গ্রহণ করতে হবে। কবি কাঙাল হরিনাথ লিখেছেন, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন”। আমি মনে করি কবি যথার্থ বলেছেন। তুচ্ছ ছাইয়ে যেখানে রতœ পাওয়ার সম্ভবনা আছে ; সেখানে গঠনমূলক সমালোচনায় অবশ্যই আপনার জন্য গুপ্তধন আছে। আর গুপ্তধনকে হেলায় না হারিয়ে নিজের লেখার উন্নতির সোপান হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেই আপনি সফলকাম।
সাহিত্যে সমালোচনা ভীতি কাটিয়ে উঠার জন্য নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখা খুবই জরুরি। মনে রাখতে হবে, আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনও হারে না। কিন্তু ভীরু এবং কাপুরুষ বারবার বারবার হারে এবং মরে। অবশ্য শুধু সাহিত্য জগৎ নয়; বরং জীবনের সকল পর্যায়ে এই আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা চাই। নিজের লেখা এবং কাজের উপর আত্মবিশ্বাস না থাকলে বালির বাঁধের মতোন সামান্য সমালোচনাতেই ভেঙে পড়ার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। তাই যতই সমালোচনা আসুক না কেন হাসিমুখে নিজের স্বরলিপি ধরে রাখা উচিত। কারণ প্রত্যেক লেখকেরই নিজস্ব একটি শৈলী থাকে। লেখার আলাদা ধারা এবং বৈশিষ্ট্য থাকে। যা সকলেরই পছন্দ হবে, এমন কোনো কথা নয়। আপনার নিজের পছন্দ এবং ভালো লাগা-কে প্রাধান্য দিয়ে লিখতে থাকুন; দেখবেন অন্যদের-ও আপনার লেখা ভালো লাগছে। তবে সকল মানুষের ভালো লাগবে; এমন প্রত্যাশা করা নিছক বোকামি বই অন্য কিছু নয়।
আপনার লেখা সমালোচনার পিছনে কী কারণ রয়েছে তার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিত। সমালোচক কী বলতে চাইছেন, কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে তা বুঝার চেষ্টা করলে সমস্যা সমাধান করা সহজ হবে। আরও সহজ ভাবে বললে বলতে হবে,
একজন রোগী যখন ডাক্তারের কাছে যান তখন প্রথমেই ডাক্তার ঔষধ লিখে দেন না। নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেন। তারপর রোগ নির্ণয় করে ঔষধ লিখেন। লেখালেখির ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঠিক একই রকম। সমালোচনার কারণ বের করে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
আমরা অনেকেই যে ভুলটা করে থাকি সেটা হল সমালোচক অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনাকে ব্যক্তিগত শত্রুতার খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেন। ইচ্ছে করেই লেখককে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে যাচ্ছেতাই সমালোচনা করেন। যা অবশ্যই সমালোচনার রীতি বহির্ভুত। আবার অনেক সময় লেখক নিজেও সমালোচনাকারীর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে থাকেন। ফলশ্রুতিতে সমালোচনাকারীর সামান্য সমালোচনা বা একটু তির্যক বিশ্লেষণও তার ইগোতে লাগে এবং তিনি খেপে যান। উভয় ক্ষেত্রেই বিষয়টি অনুচিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই উভয় পক্ষেরই উচিত সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে না নিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
ইদানিং কালের কবি এবং সাহিত্যিকদের একটা বড় সমস্যা হল তারা অন্যের লেখা পড়তে চান না বা পড়েন না। হামবড়া একটা ভাবসাব অনেকের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। অথচ কবি হরিশচন্দ্র মিত্র তার “বড় কে” কবিতায় লিখেছেন, আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।/ বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার/ সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।/ গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে/ বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে। আমরা যদি কবির মতন ভাবতে পারি, তাহলে হয়ত আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে অন্যের গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাতে পারব। তাই আমাদের উচিত অন্য লেখকদের লেখা পড়ে তাদের লেখার শৈলী এবং ভাষা ব্যবহার সম্পর্ক ধারণা লাভ করা।
আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে আড়াল করে রাখি অথবা নিজেকে অতিরিক্ত প্রকাশ করি। যাতে করে অন্যের নিকট নিজেকে আলাদা হিসাবে পরিচিত করানো যায়। এই দুটি ধারণাই ভুল। আমাদের উচিত এসব হীনমন্যতা থেকে বের হয়ে আসা। অন্য লেখকদের সাথে মিশে থাকা। তাহলে নিজের লেখা সম্পর্কে তাদের মতামত জানা যাবে। এছাড়াও তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন ধারণা পাওয়া যায়।
সাহিত্যে সমালোচনা ভীতি কাটিয়ে উঠার আরও একটি মোক্ষম উপায় হল, প্রথম দিকে পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম ব্যবহার করে নিজের লেখা বিভিন্ন জার্নাল বা পত্রিকায় পাঠানো। এতে করে সমালোচনা পাওয়ার ভয় যেমন থাকবে না; তেমনি অলক্ষে থেকে নিজের লেখা সম্পর্কে বোদ্ধাজনের মতামতও বেশ উপভোগ করা যাবে। মনে রাখতে হবে সাহিত্যচর্চা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায়ের সাথে চর্চা করে যেতে পারলে সফলতা অবশ্যই আসবে। সমালোচনাকে ভয় না করে নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
সাহিত্য সমালোচনাকে শিক্ষার একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, প্রতিটি সমালোচনা আপনার লেখার দক্ষতা বৃদ্ধির এক একটি হাতিয়ার এবং সুযোগ। এটি আপনাকে আপনার নিজের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। সমালোচক কেন আপনার লেখা সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেছেন, সেটা বুঝার চেষ্টা করুন। একজন সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি আপনার নিজের লেখাটি পড়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন আপনার চোখ, মন, মানস সমালোচকের মত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে। আর ঠিক তখন আপনি সফল হতে শুরু করবেন।
কথায় আছে, গাইতে গাইতে গায়েন। তাই আপনাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, একদিনে যেমন কেউ গায়ক হয় না; তেমনি একদিনে কেউ লেখকও হয় না। সুতরাং একরাতে আপনি একজন নিখুঁত কবি কিংবা লেখক হয়ে উঠবেন না। লেখার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে সময় লাগে। ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে। সাহিত্যের প্রতি আপনার আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা, একদিন আপনাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করবে। তাছাড়া নিজেকে আরও ভালোভাবে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য আপনি কোনো লেখক সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হতে পারেন। অন্যান্য লেখকদের সাথে মিশতে থাকুন। তাদের সাথে আলোচনা করুন, তাদের লেখা পড়ুন এবং তাদের কাছ থেকে শিখুন। একটি লেখার দৈনিক লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। প্রতিদিন সময় ধরে লেখার অভ্যাস করুন। এটি আপনাকে ধারাবাহিকভাবে লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। সবশেষে বলতে চাই, সাহিত্যে টিকে থাকতে হলে আপনাকে অবশ্যই এই সমালোচনা ভীতি কাটিয়ে উঠতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। এরজন্য প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ এবং খ্যাতিমান মেন্টর খুঁজে নিন। যিনি আপনাকে নির্দেশনা দিতে পারেন এবং আপনার লেখালেখির উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে পারেন। তবে আরও একটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। আর তা হল, আমাদের জেনে রাখা ভালো যে, কেবল দোষ কিংবা ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার নাম সমালোচনা নয়। বরং সমালোচনা হল, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভুল সংশোধনের উপায় বাতলে দেওয়া। প্রথমত ভুলের বিভিন্ন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা এবং সেই ক্ষেত্র অনুযায়ী ভুল সংশোধনের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা। যেহেতু ভুল অনেকেই ধরতে পারে; কিন্তু পরামর্শ সবাই দিতে পারে না। যেহেতু সমালোচক হলেন প্রকৃত অর্থে একজন বন্ধু বিশেষ ; তাই দিক নির্দেশনার কাজটিও তাকেই করতে হবে। তাই আশা করা যায়, এভাবেই একজন সমালোচক লেখকের শত্রু নয়; বরং প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করা পর্যন্ত বিএনপির সকল নেতাকর্মীকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে-বাদল

নতুন পদ্ধতিতে রেলের টিকিটিং ব্যবস্থা, তবে কি এবার রোধ হবে কালোবাজারি?

রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে ঃ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

সরকারকে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আহ্বান তারেক রহমানের

বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে ঃ মামুনুল হক

নাগরিকত্ব আইন বদলে ফেলতে এ বার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ ট্রাম্প

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কষ্ট আমরা বুঝি' - ড. ফায়েজ

সিদ্ধিরগঞ্জে জালকুড়ি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ৮ দোকান পুড়ে ছাই

লাখো রোহিঙ্গাদের ইফতার স্থানে প্রবেশের হুড়োহুড়িতে নিহত ১ আহত ২

ভূরুঙ্গামারীতে নদ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন

বাংলাদেশের ব্যবসায়িদের ফল-মিষ্টি দিলেন আগরতলা পৌরসভার মেয়র

পতিত স্বৈরাচারের দোসররা একেক সময় একেক নামে আবির্ভাব হচ্ছে: খায়ের ভূঁইয়া

আল হিকমাহ ইসলামিক অলিম্পিয়াড পুরুষ্কারে ভূষিত হলো নোয়াখালী মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা

মাগুরায় শিশু আছিয়ার নির্মম মৃত্যু: রাবি শিক্ষক ফোরামের বিচার দাবি

কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন মার্ক কার্নি

ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে, নইলে সংকট বাড়বে: শিপন

কয়েকজন ছাত্রনেতা মনে করে ৫ আগষ্টের আগে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রই ছিলো না: ইশরাক

ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত থাকলে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না - আমিনুল হক

আল-আকসা মসজিদে ৮০ হাজার মুসল্লির জুমার নামাজ আদায়

থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই শুরু মেয়েদের