আজ ১৩ মার্চ; পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
১৩ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
আজ ১৩ মার্চ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ১৯০৩ সালের ৩০ অক্টোবর ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম মোহাম্মাদ জসীমউদ্দীন মোল্লা। তবে তিনি জসীমউদ্দীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ছিল ওই একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দীন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুটু। বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই- ইলাহী চৌধুরী তাঁর দুই জামাতা।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ছিলেন একজন বাঙালী কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক এবং লেখক। জসীমউদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার সম্পূর্ণ কৃতিত্বই তার। এজন্য তাকে পল্লীকবি' উপাধীতে ভূষিত করা হয়েছে। জসীমউদ্দীনের "নকশী কাঁথার মাঠ" (১৯২৯) ও "সোজন বাদিয়ার ঘাট" (১৯৩৩) বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। ১৯৭০ সালে UNESCO থেকে তাঁর “সোজন বাদিয়ার ঘাট” (১৯৩৩) ইংরেজী ভাষায় অনুবাদও প্ৰকাশ করে। কবির "মাটির কান্না" (১৯৫১) কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় সংস্করণও প্রকাশ পায়।
জসীমউদ্দীন প্রথমে ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সালে উত্তীর্ণ হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে বাংলায় বি. এ. এবং ১৯৩১ সালে এম. এ. সম্পন্ন করেন।
তিনি ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ড. দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) এর সাথে লোক- সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। তিনি একজন পূর্ববঙ্গ গীতিকার সংগ্রাহকও ছিলেন। তিনি ১০ হাজারেরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন। যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারিগান এবং মুর্শিদীগানে স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন।
১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) এর অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। এরপর বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি গুরু মৃত্যুঞ্জয় শিলেরও গুণগ্রাহী ছিলেন। জসীমউদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
জসীমউদ্দীন অতি অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় তিনি তার বহুল আলোচিত কবিতা "কবর" রচনা করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। গাঁয়ের লোকের দৃষ্টিতে গ্রাম্য জীবন এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীমউদ্দীন বিশেষভাবে পরিচিত। তার এই সুখ্যাতি তাকে পল্লীকবি উপাধী এনে দিয়েছে। তার কাব্যের গঠনপ্রণালী এবং বিষয়বস্তু পাঠককে বাংলা লোক সাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদন এনে দেয়। তার রচিত "নকশী কাঁথার মাঠ" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। নিজের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল এই রকম:
“দেশের অর্ধ শিক্ষিত আর শিক্ষিত সমাজ আমার পাঠক-পাঠিকা। তাহাদের কাছে আমি গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখ ও শোষণ-পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তাহাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ-সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্র্যের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।"
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে (১৯২০-১৯৭৫) উদ্দেশ্য করে "বঙ্গবন্ধু" শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। যা তার "ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে" কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। জানা যায়, গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তবে তা প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮৬ সালে। জসীমউদ্দীনের "নকশী কাঁথার মাঠ" (১৯২৯) কাব্যটি "দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট", "সোজন বাদিয়ার ঘাট" (১৯৩৩) কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজীতে "জিপ্সি ওয়ার্ফ" এছাড়াও তার "বাঙালীর হাসির গল্প" গ্রন্থটি "ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান" শিরোনামসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সোজন বাদিয়ার ঘাট” ইংরেজী অনুবাদ এবং প্ৰকাশ করে । তার "মাটির কান্না" (১৯৫১) কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষার সংস্করণও প্ৰকাশ পায়। এছাড়াও কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০, ১৯৬২) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়া-সহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন।
তার রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে- কাব্যগ্রন্থ: রাখালী (১৯২৭), নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), হাসু (১৯৩৮), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬) ইত্যাদি। নাটক : পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), মধুমালা (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯), ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮), আসমান সিংহ (১৯৮৬)। আত্মজীবনী: যাঁদের দেখেছি (১৯৫১), ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১), জীবন কথা (১৯৬৪), স্মৃতিপট (১৯৬৪), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)। উপন্যাস : বোবা কাহিনী (১৯৬৪)। ভ্রমণ কাহিনী: চলে মুসাফির (১৯৫২), হলদে পরীর দেশে (১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)। এছাড়াও রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), গাঙের পাড় (১৯৬৪), জারিগান (১৯৬৮), মুর্শিদীগান (১৯৭৭) ইত্যাদি গ্রন্থে তার অসংখ্য গান লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাংলার বিখ্যাত লোক-সংগীতের গায়ক আব্বাসউদ্দীন (১৯০১-১৯৫৯) তার সহযোগিতায় কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি কন্ঠে ধারণ করেছেন। ভাটিয়ালী ধারা-সহ জসীমউদ্দীন রেডিওর জন্যে অনেক আধুনিক গানও লিখেছেন। তিনি কবিবন্ধু গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) এর দ্বারা ইসলামিক সংগীত লিখতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বহু দেশাত্মবোধক গান লিখেছেন। তার লেখা অসংখ্য পল্লীগীতি এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমন:- আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে ইত্যাদি।
জসীমউদ্দীন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৮; মরণোত্তর) ভূষিত হন। তাকে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হলে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর তার জন্মদিনকে স্মরণ করে "জসীম মেলা" নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উদযাপন করা হয়। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ
পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত
দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক
রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিক্ষোভ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
পবিত্র কোরআন শরীফের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো-বিটিভি মহা পরিচালক
লালমোহনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে ৭০ বছরের বৃদ্ধ নিহত
বিচারের আগে ফ্যাসিস্ট আ. লীগের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই : নাহিদ
ড. ইউনূসকে নিয়ে এক দশক আগে যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি
গাজীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে হামলা, চার ইতালীয় সেনা আহত
এ আর রহমানের নামে মিথ্যাচার রটানোর অভিযোগে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন ছেলে এ আর আমিন
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোন ধর্মই নিরাপদ ছিল না-এড.আহমেদ আযম খান
শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাধ মানে না এমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত আছে : পুতিন
ঢাকা আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ
পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, হচ্ছে মামলা
ছয়-সাত মাসেই টিয়ার কাবিখার ২০০ কোটি লুটেছিলেন হাসিনা দোসর মহিবুর
আদানির দুই চুক্তি বাতিল করলো কেনিয়া
হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বাবুকে থাইল্যান্ড নেয়া হচ্ছে
দীর্ঘ ১৭ বছর পর মানিকগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত
কলাপাড়ায় নিম্নবিত্তদের স্বস্থি দিতে স্থাপন করা হলো সরাসরি কৃষকদের সবজি বাজার