ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
ইনকিলাব প্রতিবেদন সেই সাইদের বিরুদ্ধে যেকোনো মুহূর্তে মামলা শাস্তির বদলে পদোন্নতি

দায়মুক্তি দিতে দুদক কর্মকর্তা নিজেই সৃষ্টি করেন ভুয়া কাগজ!

Daily Inqilab বিশেষ সংবাদদাতা

১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তা নিজেই সৃষ্টি করেছেন জাল রেকর্ডপত্র। দাখিল করেছেন ভুল প্রতিবেদন। আর এই ‘জালিয়াতি’ ও ‘ভুল প্রতিবেদন’ প্রমাণও হয়েছে দুদকেরই অনুসন্ধানে। তা সত্ত্বেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রুজু হয়নি কোনো বিভাগীয় মামলা। বরং পরিচালক পদে দেয়া হয়েছে পদোন্নতি। পদায়ন করা হয়েছে বিশেষ অনুসন্ধান-তদন্তের মতো গুরুত্বপূূর্ণ পদে। এই পদ থেকে এখন ভোগ করছেন অবসর-পূর্ব ছুটি (পিআরএল)। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সূত্রটি জানায়, দুদকের হটলাইন-১০৬ এ প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে জনৈক মোহাম্মদ আবু সাইদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। রাজধানীর সূত্রাপুরস্থ ৩৪, নর্থ ব্রুক হল রোডের বাসিন্দা মোহাম্মদ মুজিবুল হকের পুত্র মোহাম্মদ আবু সাইদ। পেশায় তিনি নোট-গাইড ব্যবসায়ী। অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় দুদকের উপ-পরিচালক এসএমএম আখতার হামিদ ভুঞাকে। অনুসন্ধানে নেমে তিনি মোহাম্মদ আবু সাইদের বিপুল অবৈধ সম্পদের তেমন কোনো উৎস খুঁজে না পেয়ে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ দাখিলের সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে সুপারিশটি যাচাই এবং অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় তৎকালিন উপ-পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমানকে। তিনি এসএমএম আখতার হামিদ ভুঞার প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ আখ্যা দিয়ে অভিযোগ থেকে মোহাম্মদ আবু সাইদকে দায়মুক্তির সুপারিশ (পরিসমাপ্তি) করেন। এ প্রতিবেদনে তিনি নোট-গাইড ব্যবসায়ী আবু সাইদকে মৎস্য ও পোল্ট্রি খামারি হিসেবে উল্লেখ করেন। এর সপক্ষে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিজ এলাকা খুলনার রূপসা উপজেলার মোছাব্বারপুর, পশ্চিমপাড়া শীরগাতি, মধ্যপাড়া ডোমরা, পশ্চিম নন্দনপুর, পূর্বপাড়া খান মোহাম্মদপুর, পশ্চিম নন্দনপুর এবং আইচগাতি গ্রামে ‘তানভীর পোল্ট্রি’ নামে ৪৫ হাজার ৫২ বর্গ ফুটের ১৫টি পোল্ট্রি খামারের কাগজপত্র যুক্ত করেন। ‘তানভির ফিশারীজ’ নামে খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুসা গ্রামে ৫৩১ বিঘা জমির ওপর দু’টি মৎস্য খামারের কাগজপত্র দাখিল করেন। এভাবে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মোাহাম্মদ আবু সাইদের অন্তত ৫৭ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন।

এ বিষয়ে গতবছর ২৫ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘৫৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ/আবু সাইদের আশ্চর্য খামারে ডিম পাড়ছে একদিনের বাচ্চা! দায়মুক্তি দিচ্ছে দুদক?’ শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে কমিশন এসএম সাহিদুর রহমানের প্রতিবেদনে উল্লেখিত খামারসমূহ সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন দিতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে দেয়। দুদকের অনুসন্ধান-তদন্ত-৫-এর পরিচালক মুহাম্মদ ইউছুফের নেতৃত্বে গঠিত টিমে পরস্পর বিরোধী প্রতিবেদন দাখিলকারী উপ-পরিচালক এসএমএম আখতার হামিদ ভুঞা এবং উপ-পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমানকেও রাখা হয়। উক্ত টিম গতবছর এপ্রিলে খুলনার রূপসা এলাকা পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে দেখা যায়, এসএম সাহিদুর রহমান মোহাম্মদ আবু সাইদের যে পোল্ট্রি খামার এবং মৎস্য খামার রয়েছে-মর্মে কাগজপত্র দাখিল করেছেন তা সম্পূর্ণ ভুয়া। তার ৩২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার ২০৯ টাকার আয়ের বিপরীতে দেখানো মৎস্য ও পোল্ট্রি খামারের অস্তিত্বের যৌক্তিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সরেজমিন প্রাপ্ত খামারসমূহ ২০১৯/২০২০ সালে সৃষ্ট এবং এই খামারগুলোর তফসিল ও লোকেশন ভিন্ন। মূলত, দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে এ খামারগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃজনপূর্বক পরিচালিত হয়ে আসছে।

মুহাম্মদ ইউছুফের সরেজমিন পরিদর্শনে দুদক কর্মকর্তা এসএম সাহিদুর রহমানের জাল-জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি প্রমাণিত হয় চলতিবছর এপ্রিলেই। মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিলের দায়ে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি না করে উল্টো এই কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পদোন্নতির পর তিনি সসম্মানে অবসর-পূর্ব ছুটিতেও চলে যান। এর পরপরই সরেজমিন প্রতিবেদনটি কমিশন সভায় তোলা হয়। সম্প্রতি দুদকের তদন্ত-১-এর মহাপরিচালক মো: রেজানুর রহমান প্রতিবেদনটি কমিশনের সদয় সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করেন। গত সপ্তায় কমিশন মোহাম্মদ আবু সাইদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় মামলা রুজুর অনুমোদন দেয়। এ আলোকে যে কোনো মুহূর্তে মোহাম্মদ আবু সাইদের বিরুদ্ধে দায়ের হবে মামলা।

এদিকে মামলা অনুমোদন করা হলেও বড় যে অপরাধটি ধামাচাপা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দায়মুক্তি দিতে দুদক পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমানের ভুয়া কাগজপত্র সৃজন এবং মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল। সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মতে, এ কর্মকর্তা ১৮৬০ সালের দ-বিধির ২১৮ ধারায় অপরাধ করেছেন। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি হইতে বা কোনো সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্তি হইতে বাঁচাইবার উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক ভুল রেকর্ড বা লিপি প্রস্তুতকরণ : যে ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হইয়া এবং অনুরূপ সরকারি কর্মচারী হিসাবে কোনো রেকর্ড বা অনুবিধিলিপি প্রণয়নের ভারপ্রাপ্ত হইয়া জনগণ বা কোন ব্যক্তি বিশেষের লোকসান বা ক্ষতিসাধনকল্পে বা অনুরূপ লোকসান বা ক্ষতি সাধিত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে জানিয়া অথবা কোন ব্যক্তিকে আইনানুগ শাস্তি হইতে বাঁচাইবার উদ্দেশ্যে বা বাঁচাইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে জানিয়া কিংবা কোন সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্তি হইতে বা উক্ত সম্পত্তি আইনত অন্যবিধ যে ব্যয়ভারের অধীনে তাহা হইতে বাঁচাইবার উদ্দেশ্যে বা বাঁচাইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে জানিয়া, উক্ত রেকর্ড বা লিপি এইরূপ প্রণালিতে প্রস্তুত করে, যাহা সে মিথ্যা বলিয়া জানে, সেই ব্যক্তি যে কোন বর্ণনার কারাদ-ে-যাহার মেয়াদ তিন বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদ-ে বা উভয়বিধ দ-ে দ-িত হইবে। দ-বিধির সুস্পষ্ট ধারা সত্ত্বেও কমিশন সেটি পদদলিত করে। উপ-পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেয়। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে বলে অভিমত দেন সিনিয়র এই আইনজীবী।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার