ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
উচ্চমূল্যের বিল করে নিম্নমানের মেশিন সরবরাহের অভিযোগ

খুলনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ডিজিটাল হাজিরা ও মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস

Daily Inqilab আসাফুর রহমান কাজল, খুলনা অফিস

১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম

খুলনার ১ হাজার ১শ’ ৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেনা বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন এখন বিকল হয়ে পড়ে আছে। জেলায় এ খাতে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় দুই কোটি টাকা। শিক্ষা কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধির পছন্দের কোম্পানি থেকে নিম্নমানের মেশিন কিনতে বাধ্য করা, শর্ত অনুসারে সার্ভিসিং না করা ও শিক্ষকদের অনীহায় এসব হাজিরা মেশিন নষ্ট হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে কেনা বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিনগুলো বিকল, অন্যদিকে ক্লাসরুমের সংকট ও ত্রুটিপূর্ণ ল্যাপটপ-প্রজেক্টরের কারণে খুলনার অধিকাংশ স্কুলেই মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে ‘সলিড ওয়ার্কস’, ‘মার্চ এডুকেটস’, ‘ম্যানগ্রোভ অ্যাপারেলস্’সহ আরও কয়েকটি কোম্পানি খুলনা জেলার ১ হাজার ১শ’ ৫৯টি স্কুলে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন সরবরাহ করে। ১৫-২০ হাজার টাকায় নিম্নমানের মেশিন কেনা হলেও অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওই খাতে বিল করা হয় ৩৫-৪০ হাজার টাকা। এছাড়া মেশিনগুলো স্থাপনের সময় শর্ত অনুসারে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে সার্ভিসিং করাতে বলা হলেও কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা করতে রাজি হয়নি। উর্ধ্বতনদের তদারকি, শিক্ষকদের অনীহায় মেশিনগুলো অকেজো হয়ে যায়।
সরেজমিনে খুলনা সদর থানাধীন তালতলা এলাকার উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টুটপাড়া এলাকার জনকল্যাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিববাড়ি মোড় এলাকার মেহমানে আলীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক হাজিরা মেশিনগুলো নষ্ট দেখা যায়।
শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, স্কুলের সংস্কার খাতের অর্থাৎ সিøপের টাকায় কেনা হয় এই মেশিন। এই মেশিনগুলো কোনোটি ছয় মাসের মধ্যে কোনোটি এক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। ৬ হাজার টাকার জিনিস দেখানো হয়েছে ১৮-২০ হাজার টাকা। একইভাবে ল্যাপটপ প্রজেক্টেরের ক্ষেত্রেও ৪০ হাজার টাকার মালামাল ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে এর বিরোধিতা করে শিক্ষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির পছন্দের কোম্পানি থেকে নিম্নমানের মেশিন কিনতে বাধ্য করা হয়। ফলে মানহীন মেশিন কিনতে বাধ্য হন তারা। আর মানহীন মেশিন কেনায় কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়।
খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৯০টি স্কুলে ১৪ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে হাজিরা মেশিন কেনা হয়। যার প্রতিটির দাম পড়ে ১৫ হাজার ৮শ’ টাকা। একই মেশিন কিনতে দিঘলিয়া উপজেলার ৫০টি স্কুলে ব্যয় করা হয় ১২ লাখ টাকা, যার প্রতিটির মূল্য পড়ে ২৪ হাজার টাকা। একইভাবে রূপসা উপজেলার ৬২টি স্কুলে এ খাতে ব্যয় হয় ১৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, যার প্রতিটির মূল্য পড়ে সাড়ে ২২ হাজার টাকা।
একই মানের মেশিনের ভিন্ন ভিন্ন দাম প্রসঙ্গে ‘ম্যানগ্রোভ এ্যাপারেলস’ কোম্পানির সহকারী ব্যবস্থাপক মবিন আহমেদ জানান, স্কুলগুলো যেনতেনভাবে দায়সারাগোছের মেশিন বসিয়ে মোটা অঙ্কের বিল করে দিতে বলে। এতে অনেক কোম্পানি নিম্নমানের মেশিন দিয়েছে স্কুলগুলোতে। অনেকে আবার শুরুতে অফলাইন মেশিন বসায় কিন্তু তা অফিস থেকে মনিটরিং করতে না পারায় সেগুলো বদলে অনলাইন মেশিন বসাতে হয়। দ্বিতীয় দফায় কম টাকায় নিম্নমানের মেশিন বসিয়েছেন অনেকে।
খুলনা মহানগীর খালিশপুর এলাকার ‘সলিড ওয়ার্কস’ নামে একটি কোম্পানি খুলনার সদর ও ডুমুরিয়ার বেশ কিছু স্কুলে হাজিরা মেশিন সরবরাহের কাজ পায়। শিক্ষা কর্মকর্তারা ও প্রভাবশালী শিক্ষকরা কোম্পানিগুলোকে স্কুলের সংখ্যা ভাগ করে দিয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের সরবরাহকৃত মেশিনগুলোও কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, মেশিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ থাকায় অনেক স্কুলই কোম্পানির সাথে আঁতাতের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের বিল করে নিম্নমানের মেশিন সরবরাহ নিয়েছে।
একই ধরনের কোম্পানির প্রতিনিধি মেহেদী হাসান জানান, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনীহাও বড় কারণ। স্কুলে উপস্থিতির ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা শুরু হওয়ায় অনীহা দেখা দেয় অনেকের মধ্যে। ফলে শর্ত অনুযায়ী প্রথম বছরের মেশিনের ফ্রি সার্ভিসিং, দ্বিতীয় বছর থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইন্টারনেট সুবিধাসহ সার্ভিসিং সুবিধা নেয়নি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে বর্তমানে কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি অস্তিত্ব সংকটে। এরই মধ্যে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের হাজিরা মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। সীমাহীন দুর্নীতি হলেও কোনো জবাবদিহিতায় পড়তে হয়নি কাউকেই।
অন্যদিকে নষ্ট ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরই এখন বোঝা হয়ে উঠেছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের। নগরীর মেহমানে আলীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শফিউর রহমান জানান, নগরীর সোনাডাঙ্গা ক্লাস্টারের ২৩টি স্কুলের মধ্যে হাতেগোনা ৫-৬টি স্কুলে মাল্টিমিডিয়ার ক্লাস হয়। বাকি স্কুলগুলোতে কোনোটির ল্যাপটপ নষ্ট কোনোটির প্রজেক্টর নষ্ট হয়ে গেছে। যার তালিকা শিক্ষা অফিসে দেয়া হয়েছে।
নগরীর সাত রাস্তার মোড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ কোয়ার্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা বলেন, বেশ কিছু জটিলতায় অনেক সময় নিয়মিত ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ায় তারা বিরক্ত হয়। এছাড়া মাঝে মধ্যে প্রজেক্টর বা ল্যাপটপ নষ্ট থাকে। তখন ক্লাস নেয়া যায় না। দেড় মাস ধরে স্কুলের প্রজেক্টর নষ্ট। এ কারণে ক্লাস নেয়া যাচ্ছে না।
২০১৮ সালে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. এনামুল কাদের খান স্বাক্ষরিত ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ সালের একটি নির্দেশনায় সিøপ ফান্ড হতে সকল জেলা ও উপজেলায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপনের জন্য বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এটি স্থাপনের পর মনিটরিং এর ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
প্রাথমিকের খুলনা বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোসলেম উদ্দিন ইনকিলাবকে জানান, অধিকাংশ স্কুলের হাজিরা মেশিন এখন নষ্ট হয়ে গেছে। সিøপের টাকায় কেনা মেশিনগুলো কোনোটি ছয় মাসের মধ্যে কোনোটি এক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম টাকায় নিম্নমানের হাজিরা মেশিন কেনার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের গুরুত্ব অনেক। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনার প্রতিবন্ধকতার সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খুলনা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আশরাফ-উজ্জামান বলেন, জনগণের অর্থায়নে পরিচালিত সরকারি এসব প্রকল্পের প্রয়োজন উপলব্ধি করেই এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পে এ ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন বা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা পালন করেননি, তারা সবাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ক্ষেত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সরকারি অর্থ মানে জনগণের অর্থ। ফলে এ ভাবে লোপাট কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

 

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন