ফিরছে চায়ের স্বর্ণযুগ
২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬ এএম
সরকারের উদ্যোগ ও অনুকূল আবহাওয়ায় দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। চা আমদানিকারক দেশ থেকে বাংলাদেশের আবার চা রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ বছর দেশের বাগানগুলোয় আশাতীত চা উৎপাদন বেড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে চা উৎপাদন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। যা গত বছরের চেয়ে দেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা শুধু দেশে নয়, বিশ্বের চা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে সবার ওপরে নিয়ে গেছে। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে এ বছর ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজির বেশি চা উৎপাদন হবে বলে আশা করছে চা বোর্ড। দেশেরে ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে এই অর্জন। আর উৎপাদনের এই ধারা বজায় রাখতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আবারও বিশ্ববাজার দখলে নিতে পারবে বাংলার চা। ফলে চায়ের স্বর্ণযুগ আবার ফিরে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন তারা।
গেল শীতের দিকে হঠাৎ মেলে প্রয়োজনীয় কাক্সিক্ষত বৃষ্টি। তাতেই আপন ছন্দে ফিরছে সবুজের রাজ্য খ্যাত চায়ের দুনিয়া। চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের প্রতিটি বাগানে মনকাড়া সবুজ সতেজতার দৃশ্য। পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে প্রুনিং (গাছের পাতা ও ডালপালা ছাঁটানো) করা প্রতিটি চা গাছে নতুন কুড়ি গজায়। মৌসুমের শুরুতে এমন দৃশ্যে হাসি ফুটেছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।
২০২১ সালে ১৬৮টি চা বাগান ও ছোট ছোট বাগান থেকে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। যদিও বিরূপ আবহাওয়া ও চা শ্রমিক ধর্মঘটে পরের বছর কমে যায় ফলন এবং ২০২২ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৩৮ লাখে কেজিতে ঠেকে। গেল কয়েক বছরে চা বোর্ড ১০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও পূরণ হয়নি। অবশেষে বিদায়ী বছরে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের রেকর্ড করলো। চা বোর্ড বলছে ২০২৩ সালে ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জাতের চারা, সেচ ব্যবস্থার পাশাপাশি চা শিল্পে বিপুল অঙ্কের কর্পোরেট বিনিয়োগে হয়েছে। সেই সঙ্গে চা বোর্ডের বিভিন্ন পদক্ষেপেও বেড়েছে উৎপাদন। ২০২৫ সালে ১৪ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য চা বোর্ডের। শ্রীমঙ্গলেই সরাসরি নিলাম হওয়ায় চায়ের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে না। আর গুণগত মান ঠিক রেখে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে চায়ের স্বর্ণযুগ আসবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি বছর অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে চা বাগানে। বৃষ্টিধারায় ভিজতে ভিজতে চায়ের সবুজ কুঁড়িগুলো ভালভাবেই ছড়াচ্ছে। আর এই কুঁড়িতেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। মুঠো মুঠো সবুজ কুঁড়িই ধরা দিচ্ছে চা শিল্পে সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে। ফলে দেশে চা উৎপাদনে স্বর্ণযুগ ফিরে আসছে।
ইস্পাহানি মালিকানাধীন জেরিন চা বাগানের ডিজিএম সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, এবার সময় মতো বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি চা শিল্পের জন্য বড় প্রয়োজন। বৃষ্টিতে এখন চা বাগানে সবুজের সবারোহ হচ্ছে। আশা করছি অতীতের চেয়েও এবার চা উৎপাদন বেশি হবে।
সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর সর্ব উত্তরের পাঁচ জেলা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। চা উৎপাদনের দিক থেকে সর্বশেষ গত দুই অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে উত্তরাঞ্চল। সমতলের চা উৎপাদনে প্রতিবছর উত্তরাঞ্চল একের পর এক রেকর্ড করছে। সমতলের চা ঘিরে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা।
তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি চাষিরা কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। এ অবস্থায় সমতলের চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সঙ্কট নিরসনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চাষিদের অভিযোগ, ভরা মৌসুমে কারখানাগুলো সিন্ডিকেট করে চাষিদের কাঁচা চা পাতার নায্যমূল্য না দিয়ে ঠকাচ্ছে। এতে অনেকে চা চাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। এমনকি কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে চা বাগান বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন।
মাথিউড়া চা বাগানের ম্যানেজার ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, চা শিল্পে মার্চ-এপ্রিলে বৃষ্টি মানে নতুন দিগন্তের সূচনা। চা গাছ প্রুনিং এর পরে বৃষ্টি হলেই চা গাছে নতুন কুড়ি আসে। এবার সময় মতো বৃষ্টি হয়েছে। চা উৎপাদনও অনেক ভালো হবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে উত্তরের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি। উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি, ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে।
এদিকে, সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসছে ভারতীয় শত শত মণ নিম্নমানের চা পাতা, আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় চা শিল্প। হবিগঞ্জের মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এসব ভারতীয় নিম্নমানের চা পাতা আসছে। ফলে বাগানে উৎপাদন বাড়লেও এ কারণে চা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। চোরাই পথে চা পাতা আসা বন্ধে বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তাতেও চোরাই পথে ভারতীয় চা-পাতা আসা অব্যাহত আছে। নিম্নমানের এসব চা পাতা আসা বন্ধ না হলে চা শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বাগান কর্তৃপক্ষ।
এরইমধ্যে বাগান কর্তৃপক্ষ চোরাই চা পাতার অনুপ্রবেশ রোধে প্রশাসনের বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। বাগান কর্তৃপক্ষের অভিযোগ- ভারত থেকে মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর, চৌমুহনী, মনতলা, তেলিয়াপাড়া এবং চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি, আমু, নালুয়া সীমান্ত দিয়ে শত শত মণ চোরাই চা পাতা দেশে ঢুকছে প্রতিদিন।
ভারতের নিম্নমানের চা পাতা এদেশে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। তাই একশ্রেণির ক্রেতারা এসব চা পাতা ক্রয় করছেন। এছাড়া এগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে সংঘবদ্ধ চক্র। চোরাই চা পাতাকে কেন্দ্র করে মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া, জগদীশপুর, নোয়াপাড়া, শ্রীমঙ্গল শহরের সোনার বাংলা রোড, উপজেলার সাতগাঁও ও সিন্দুরখান’সহ চায়ের অবৈধ একাধিক প্রক্রিয়াজাতকরণ গুদাম তৈরি করেছে চক্রের সদস্যরা।
শ্রীমঙ্গল ব্রোকার্স লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হেলাল মিয়া জানান, শুধু উৎপাদন নয়, চায়ের কোয়ালিটির উপরে গুরুত্ব দিয়ে চা উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এবং ভারতীয় চা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ না করতে পারে সেই দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিকূল আবহাওয়া তাকায় আমরা আশা করছি এবছর ভালো চা উৎপাদন হবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, এবার চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি। যা সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের চা উৎপাদন কোয়ালিটির উপরে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে মিটিং করা হবে। সময় মতো বৃষ্টি হয়েছে, বৃষ্টি চা শিল্পের জন্য একটি আশীর্বাদ। তবে, সেই বৃষ্টির পানি যেন চা বাগানে জমে না থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।###
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ
গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই
নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন
গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন
চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে
নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন
ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন
গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক
ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার