সিয়াম ও কুরআন
২৯ মার্চ ২০২৩, ০৭:১৮ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪২ এএম

মু’মিন ভাই-বোনেরা! ভুলে যাবেন না আল কুরআনের কারণেই রমযানের এত মর্যাদা। আপনি রমযানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়ার শক্তি অর্জন করলেন, কিন্তু আপনি জানেন না কোনটি তাকওয়ার পথ আর কোনটি তাগুতের পথ। কোনটি আলোর পথ আর কোনটি অন্ধকারের পথ, কোনটি আল্লাহর রেজামন্দির পথ আর কোনটি আল্লাহর গযবের পথ। হালাল-হারামের পার্থক্য করার ক্ষমতা আপনার নাই। আপনার মনে থাকার কথা যে, রমযানে তাকওয়াকে শাণিত করার প্রাক্কালেই কুরআন নাযিল করা হয়েছিল। যাতে আপনি তাকওয়া অর্জনের পাশাপাশি সামগ্রীকভাবে ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ করার জ্ঞানও আহরণ করতে পারেন। তাকওয়া মানে আল্লাহর নাফরমানী থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। এই কুরআন বলে দেবে কোনটি আলো ও কোনটি অন্ধকারের পথ। সুতরাং রোযা রাখুন, তাকওয়া অর্জন করুন এবং সাথে সাথে বেশী বেশী করে আল কুরআনকে বুঝে অর্থ অনুধাবন করে তেলাওয়াত করুন। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের উপর। আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হবে।” (সুরা বাকারা-১৮৩)
সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা অর্থাৎ মানুষ যাতে তাঁর সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্ল্হা তা’আয়াকে ভয় করে। আল্লাহ কোন কাজে রাজি ও খুশি হন সে পথে চলা এবং যে পথে চললে আল্লাহ অখুশি হন, সে পথ পরিহার করা। কিন্তু মানুষ সেই পথই যদি না চেনে এবং ভালো-মন্দের পার্থক্যই না জানে তবে কিভাবে চলবে। তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হলো ঠিকই কিন্তু সে জানে না কোনটি তাকওয়ার পথ আর কোনটি তাকওয়ার বিপরিত পথ। এ জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা রমযানের রোযা ফরয করার সাথে সাথে আল কুরআন নাযিল করে সেই পথ বাতলে দিয়েছে। আল্লাাহ তা’আলা বলেন “রমাদান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা-১৮৫)
রমাদান মাস মানে কুরআনের মাস। রমযান এলেই মনে পড়ে আল্লাহ রাহমানুর রাহিম দয়া করে মানব জাতির পথের দিশা এবং মুক্তির সঠিক পথ ও বাতিল পথের পার্থক্য নিরুপণের জন্য আল কুরআনের মত একটি নিয়ামত দান করেছেন। আমরা প্রতিদিন সুরাতুল ফাতেহায় আবেদন করছি “(হে আল্লাহ) তুমি আমাদেরকে সরল সঠিক পথের দিশা দাও।” (সুরা ফাতেহা-৫) এই আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলে দেন, “আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল-কুরআন) তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই, ইহা তাকওয়াদারী বা মুত্তাকী লোকদের পথ দেখাবে।” (সুরা বাকারা ১-২) উল্লেখিত সুরা বাকারার ১৮৩ ও ১৮৫ নং আয়াতে যথাক্রমে রমাদানের রোযা ফরজ ও হক-বাতিলের পার্থক্য নিরূপণের জন্য কুরআন নাযিল বিষয়টি দ্বারা আল কুরআন ও রমাদানের রোযার মধ্যে একটি সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইঙ্গিত হলো, কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রমযানের রোযা পালন করা হলে রোযার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুর্ণ হবে না। রোযা মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করবে, আর আল কুরআন এ ধরণের তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী লোকদের অন্ধকারে নিশ্চিন্তে পথ চলার শক্তি ও আলো যোগাবে। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হলো, রমাদানেই কুরআন নাযিল করা হলো। তাহলে আমরা বলতে পারি, আল কুরআনের কাজ হলো. প্রাথমিকভাবে সৈন্যবাহিনীতে লোক নিয়োগ দান করে রমাদানের রোযার হাতে ছেড়ে দেবে এবং রমাদানের রোযা একটি মাস একে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা তথা দক্ষ সৈনিকে রূপান্তর বা তৈরী করে আবার কুরআনের হাতে সোপর্দ করবে। এবার আল কুরআন তাকে সামনে পথ চলার কর্মসূচী বাতলে দেবে। কুরআন তাকে বলে দেবে কোনটি জান্নাতের পথ, আর কোনটি তাগুতের পথ। যেমন আল কুরআনের ঘোষণা “আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।”
পুরো রমাদান মাসে জাঁকজমকের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন এবং রোযার গুণাগুণ ও মহিমা বর্ণনা করা হবে। কিন্তু যার কারণে রমাদান এত মর্যাদা পেল সে মধ্যমনি আল কুরআনের কথা ভুলে যাওয়া হয়। রমাদান তো ফরয করা হয়েছে আল কুরআনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করার ট্রেনিং হিসেবে। শুধুমাত্র রমাদান নয় এমনিভাবে আমরা যতগুলো ইবাদাত পালন করে থাকি যেমন নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ, প্রতিটি ইবাদাতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো, সেই একটিই আর তা হলো, আল-কুরআন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদর্শ সৈনিকে পরিণত করা। কিন্তু আমরা এ মুল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে স্রেফ একটি অনুষ্ঠানে পরিণত করেছি। এভাবে লক্ষ্যহীন রোযা ও অন্যান্য ইবাদাত আমরা জীবনভর পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু ইবাদাতগুলোর ফায়দা পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন সালাত খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা, যাকাত পবিত্রতা দান করা এবং রোযা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছেনা। আর প্রতিটি ইবাদাত যেহেতু দক্ষ সৈনিকে প্রস্তুত করতে পারেনি তাই কুরআনও আমাদেরকে পথ দেখাতে পারছে না। এমনি ভাবে আমরা যারা রমাদানের রোযাকে আল কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি এবং আল কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ও মানতে এবং সে অনুযায়ী জীবন গঠন করতে চাই না। তাই রোযা ও আল কুরআন যৌথভাবে আমাদেরকে তাকওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারছে না। অথচ তাকওয়া এমন একটা জিনিষ, এমন একটা শক্তি, যার উপর ভিত্তি করে মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে, ন্যায় কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারে। নিজের ক্ষতি হবে, এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তাকওয়া। কিন্তু মানুষের যদি এ জ্ঞানই না থাকে যে, কিসে তার ক্ষতি কিসে তার ভাল, তবে সে কিভাবে বিরত থাকবে ? কুরআন হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী একটি কষ্টিপাথর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন “রমাদান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী।”
সুতরাং রমাদান মাস থেকে পুরোপুরি ফায়দা হাছিল করার জন্য সর্বপ্রথম রমাদানের গুরুত্ব, বরকত এবং মর্যাদা সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত হতে হবে। এ পবিত্র মাসে আমরা যা কিছু ইবাদাত এবং কর্মকান্ডে লিপ্ত হই, এসব কিছুর মাধ্যমে আমাদের মধ্যে তাকওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। যে তাকওয়া আমাদেরকে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান এবং কুরআনের মিশনকে পরিপূর্ণ করার যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। সেজন্য কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ পূবেই বলা হয়েছে যে, এ পবিত্র মাসের রোযাসহ সব কিছুই কুরআনের সাথে কেন্দ্রীভূত করে দেয়া হয়েছে। এ মাসের অধিকাংশ সময় আমাদেরকে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তা বুঝে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কুরআনের প্রতি এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কুরআনই একমাত্র ব্যক্তি, সমাজ, যুগ পাল্টে দিতে সক্ষম। এবং কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যার স্পর্শে যে কোন ব্যক্তি, সমাজ ও যুগ পরিবর্তন হতে বাধ্য। যেমন:-
সোনালী সমাজ বিনির্মাণ: পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘণ্যতম অধ্যায় হল জাহেলিয়াত, পাশবিকতা ও হিংস্রতা, শিরক ও পৌত্তলিকতা ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-কুরআন এর বদৌলতে একে পাল্টে সোনালী যুগ বিনির্মাণ করেছিলেন। যে যুগ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলছেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ হল আমার যুগ।”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা বৃদ্ধি: এ কুরআনের কারণে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মানিত হয়েছেন। কারণ তিনি প্রথম নিজের স্কন্ধে এর গুরুভার দায়িত্ব নেন। “আমি আকাশ পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এ আমানত (আল-কুরআন তথা খেলাফতের দায়িত্ব) পেশ করলাম। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হল না, তারা ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মানুষ তার স্কন্ধে তুলে নিল।” (সুরা আহযাব-৭২) “ইয়াসিন। (এই) জ্ঞানগর্ভ কুরআনের শপথ, তুমি অবশ্যই রাসুলদের একজন, নি:সন্দেহে তুমি সরল পথের উপর (প্রতিষ্ঠিত) রয়েছো। পরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকেই এই (কুরআন) অবতরণ।” (সুরা ইয়াসিন ১-৫)
সোনার মানুষ গঠন: ব্যক্তি সমুদ্রের সাইক্লোন সম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আল্লাহর নবীকে হত্যার জন্য ঝড়ের বেগে যাচ্ছিলেন, আল কুরআন সে ঝড়কে মাঝপথে থামিয়ে দিলো। অর্ধেকটা পৃথিবীর শাসনভার কুরআন তাঁর হাতে তুলে দিলো। আর এ কুরআন তাকে কোথায় নিয়ে গেলো যে, আল্লাহর নবী সার্টিফাই করছেন এভাবে “আমার পরে যদি কোন নবী আসতো তবে তিনি হতেন ওমর। শুধু কি তাই আল কুরআনের এক নাম “ফোরকান” (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) আর হযরত ওমর রা: উপাধী হলো “ফারুক” (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।
মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি: রমযান মাস এত মর্যাদাবান হলো আল-কুরআন অবতীর্ণের কারণে। “রমযান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা-১৮৫)
রাত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি: যে রাত্রিতে কুরআন নাযিল হলো, সে রাত্রি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “এ মর্যাদাপূর্ণ রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সুরা ক্বদর-৩) তাও আল কুরআনের কারণেই। অতএব, রমাদান মাস মানে কুরআনের মাস। এ মাসে আল কুরআনের উৎসব শুরু হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রত্যেককে অত্যন্ত তাৎপর্যের সাথে এ উৎসব উপভোগ করার তৌফিক দিন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক, কলামিস্ট
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

নোয়াখালীর চৌমুহনী হকার্স মার্কেটে আগুনে পুড়ল ৬ দোকান

কেরানীগঞ্জে মৌসুমি ব্রিকসে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান

পেঁয়াজ চাষে ব্যাপক সাফল্য শ্রীপুরের মুন্সী জাহাঙ্গীরের

রমজানের দ্বিতীয় জুমায় আল-আকসায় নামাজ আদায় ৮০ হাজার মুসল্লির

মাত্র দুই মিনিটেই সড়ক ক্লিয়ার করে চক্রান্ত নস্যাৎ

তৃতীয় দিনেও কর্মব্যস্ত জাতিসংঘ মহাসচিব

আবরার হত্যা: আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় রোববার

যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখতে হামাসকে ইসরাইলের নতুন শর্ত

পেকুয়ায় এতিম হাফেজদের সম্মানে ব্যতিক্রম আয়োজন

যুদ্ধ শেষের ভালো সম্ভাবনা দেখছেন জেলেনস্কি

সুযোগ পেলেই আমরা ড. ইউনূসকে শূলে চড়াই: সারজিস

জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন আজ

রোজায় হাড়ের যত্ন ও হাড়ের ব্যথা থেকে মুক্তির উপায়

জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক দুপুরে

অভিনয় শিখতে যুক্তরাষ্ট্রের পথে পারসা ইভানা

গাজীপুরে অটোরিকশা-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ৩

খলিল মাহমুদের মুক্তির দাবিতে ট্রাম্প টাওয়ারে ইহুদিদের বিক্ষোভ

সৈয়দপুরে ভয়াবহ আগুনে দুইটি পরিবারের সর্বস্ব পুড়েছাই

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বৈষম্যের অভিযোগ